১২৭তম তিরোধান দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

মানবতাবাদের গুরু লালন সাঁই

সহজিয়া সাধনা মানুষের অন্তর থেকে সৃষ্টি। আর এই সাধনায় গতি সঞ্চার হয়েছে মধ্যযুগে। যার মহামিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষ। যুগে যুগে নানা ধর্ম ও মত সৃষ্টিও এখানেই। জ্ঞানপথ, যোগপথ, ভক্তিপথ ও কর্মপথসহ সব পথেরই সন্ধান দিয়েছেন ভারতবর্ষের সাধকরা।
লালন সাঁই
মানবধর্ম আর মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার সার্থক রূপকার লালন সাঁই কেবল মানবাত্মার মুক্তির জন্যই সংগ্রাম করেননি তাঁর সাধনার মূলমন্ত্র ‘আত্মং বিদ্ধিং’, যার অর্থ ‘নিজেকে চেনো’। ছবি: স্টার

সহজিয়া সাধনা মানুষের অন্তর থেকে সৃষ্টি। আর এই সাধনায় গতি সঞ্চার হয়েছে মধ্যযুগে। যার মহামিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষ। যুগে যুগে নানা ধর্ম ও মত সৃষ্টিও এখানেই। জ্ঞানপথ, যোগপথ, ভক্তিপথ ও কর্মপথসহ সব পথেরই সন্ধান দিয়েছেন ভারতবর্ষের সাধকরা। এখানে শক্তির সঙ্গে জ্ঞানের, জ্ঞানের সঙ্গে ভক্তির ও ভক্তির সঙ্গে কর্মের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়; চৈতন্যোত্তরকালে এখানে কয়েকটি ক্ষুদ্র ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে আউল, বাউল, সাঁই, দরবেশ, কর্তাভজা ও সহজিয়াকে প্রধান ধরা হয়।

তবে নদীয়ার স্রোতধারায় বাউল সাধনায় ফকির লালন সাঁইজির আধ্যাত্ম গান ও সাধন ভজনে সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। সেসময় তাঁর আধ্যাত্ম জ্ঞান পরিমাপ করা সম্ভবপর না হলেও তাঁর তত্ত্বকথার সুরাচ্ছাদিত গানের বাণী সাধারণ মানুষের আনুগত্য এনেছে। এই ধারাবাহিকতা থেমে নেই, ক্রমেই বেড়ে চলেছে তাঁর ভক্ত-শিষ্য ও অনুসারী। এই সাধকের ঘরানায় গানের জগতে দীক্ষিত হয়েছেন অসংখ্য বাউল। তাঁরা আজও কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর ছেউড়িয়া আখড়ার প্রাণ।

লৌকিক বাংলার সাংস্কৃতিক পুরোধা ব্যক্তিত্ব লালন সাঁই ছিলেন মূলত গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। আর সেখানে তাঁর সাধনা ও উপলব্ধির মাধ্যমে জাগরণের যে তরঙ্গ তুলেছিলেন তা বিস্ময়কর। তবে তাঁর সমাজচিন্তা, মানবপ্রেম এবং মনুষ্যত্ববোধের পরিচয় আজও উপেক্ষিত। এরপরও অতি নগরায়নের বিজ্ঞানমনস্ক পৃথিবীর গতিময় মানুষেরা লালনের কাছে নতিস্বীকার করছেন। দেশ-বিদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষ এই আধ্যাত্মিক সাধকের দর্শন অনুসরণ করতে আসছেন। গ্রামীণ জনপদে লালন ফকির লোকায়ত জীবনের প্রভাবে মানব সমাজের একাংশকে যে একীভূত করেছেন তা অতুলনীয়। সহজ ভাবনার ভাববাদী মানুষেরা এই সাধককে স্মরণ করতে তাঁর আখড়ায় আসেন ফাল্গুন-চৈত্র মাসে দোলপূর্ণিমা উৎসব ও কার্তিক মাসে লালন সাঁইজির তিরোধান দিবসের (স্মরণ) মহোৎসবে।

লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ –সহ মোট ২১টি গান সর্বপ্রথম মুখের শব্দ থেকে কাগজে ছাপার অক্ষরে ঠাঁই পেয়েছিল তাঁর ভাবশিষ্য ও ঘনিষ্ঠ সহচর কাঙাল হরিনাথের এম.এন প্রেসের মুদ্রণে। আমরা লালন সাঁইজির গানের অন্যতম সংগ্রাহক হিসেবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও জানতে পারি। প্রায় শ’খানেকের ওপর এই মরমি সাধকের গানের সংগ্রাহক রবীন্দ্রনাথ নিজেই। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ‘হারমনি’ বিভাগে রবীন্দ্রনাথ নিজেই লালনের কুড়িটি গান প্রকাশ করেন। সাঁইজির গান শুনে কবিগুরু যে রীতিমতো বিমোহিত হয়েছেন তা বলাই বাহুল্য। ভাবসাগরে ডুব দিয়ে তাই বিলক্ষণ জেনেছেন ও বুঝেছেন লালন দর্শন ফুরাবার নয়। নিরন্তর প্রবহমান সে উৎস। উৎসমূলে যা প্রগাঢ় শক্তিমত্তা নিয়ে প্রস্ফুটিত তা-ই গানে গানে বিকশিত হয়েছে শতদলে। আর এ কারণেই হয়তো লালনের গান প্রথম রবীন্দ্রনাথই বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’, গানটি কবিগুরু ইংরেজিতে ভাষান্তর করে সবার সামনে এই মহান মরমী সাধক ও দার্শনিককে তুলে ধরেন। ফলে দেশীয় পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও এ মানবতাবাদী গায়ক, সাধক ও দার্শনিকের চিন্তা-চেতনা এবং জীবন দর্শন আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে ধীরে ধীরে সাঁইজি সমগ্র বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে থাকেন। এখন তো বিশ্বব্যাপী লালন দর্শন নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চলছে।

মানুষকে বিভক্তির বেড়াজালে না জড়িয়ে শুধু মানুষ হিসেবে দেখার কারণেই হয়তো তিনি মানুষকে গুরুভাবে ভজতে বলেছেন। কারণ, তাতেই লুকায়িত রয়েছে শাশ্বত প্রেমের অমিয়ধারা, মানবমুক্তি যার ফল। বর্তমান যুগে তিনি মানুষকে দেখেছেন অবতার হিসেবে। বলেছেন, দিব্যজ্ঞানী না হলে কেউ তা জানতে পারে না। মানুষ ভজনা ও মানব সেবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সে জ্ঞান। কারণ, নিরাকার বিধাতাই যে মানুষের মাঝে সাকার হয়ে ধরা দেন সাঁইজি তা তুলে ধরলেন এভাবে, সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার/মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/নদী কিংবা বিল বাঁওড় খাল/সর্বস্থলে একই একজন.../দিব্যজ্ঞানী হয় তবে জানতে পায়/কলিযুগে হলেন মানুষ অবতার’।

Fakir Lalon Sain Shah
লালন সাঁই, ছবি: স্টার

লালন সাঁইয়ের গানের একটি আলাদা তাৎপর্য হল, সাধারণত এ গানগুলোর শেষ দিকে এসে লালন তাঁর নিজের নামে পদ রচনা করেছেন। এর ফলে যা হয়েছে তা হল, তাঁর গান আর অন্য কেউ নিজের বলে চালিয়ে দিতে পারবেন না। যেমন, বহুল পরিচিত একটি গানে লালন শেষ দিকে বলেছেন, ‘জগত বেড়ে জাতের কথা,/লোকে গৌরব করে যথা তথা/লালন সে জাতের ফাতা ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে/সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’

লালন তাঁর গানে আত্মতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, জাতিভেদ বিষয়ক যুক্তি, ব্যাখ্যা ও সূক্ষ্ম অথচ তির্যক উপমা উপস্থাপন করেছেন। লালন স্পষ্টভাবে বিশ্বাস করতেন- সৃষ্টির মাঝেই স্রষ্টাকে পাওয়া যায়। এ কারণে চণ্ডীদাসের অমর বাণীর (‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’) –এর মতো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে তাঁর গানে। তিনি কখনোই জাতিত্বের সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ থাকতে চাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতি ও জাতের সীমাবদ্ধতা মানুষকে আলাদা, অকর্মণ্য এবং কূপমণ্ডূক করে রাখে। তাঁর গানে এসব প্রতিফলন স্পষ্ট ও অসম্ভব তীব্রতর-

জাত না গেলে পাইনে হরি/কিছার জাতের গৌরব করি/ছুঁসনে বলিয়ে/লালন কয় জাত হাতে পেলে/পুড়াতাম আগুন দিয়ে জাতের বিপক্ষে এ রকম তীব্র বাণী তিনি লালন করেছিলেন গানের মধ্যে। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ তাঁকে যাতনা দিয়েছিলো সেটি উক্ত অংশ প্রমাণ করে।

ধর্মচেতনা মধ্যযুগীয় মরমি সাধকদের যেরূপ আশ্রয় দিয়েছিলো লালন সাঁইও তাদের একজন। লালন ধর্মীয় সীমাবদ্ধতার বাইরে মুক্তির পথ খুঁজেছেন। তাঁর কণ্ঠে সুরারোপিত হয়ে তৈরি হয়েছে মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ জয়গান।

মানবধর্ম আর মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক এবং অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার সার্থক রূপকার লালন সাঁই কেবল মানবাত্মার মুক্তির জন্যই সংগ্রাম করেননি তাঁর সাধনার মূলমন্ত্র ‘আত্মং বিদ্ধিং’। যার অর্থ ‘নিজেকে চেনো’। দেহের ভেতর আত্মার বসতি। সবাই টের পেলেও সে আত্মাকে কেউ স্পর্শ করেনি কিংবা খালি চোখে দেখতে পায়নি। লালন তাঁর গানে এ ভাবধারাই প্রকাশ করলেন, বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথা/এক পড়শি বসত করে/আমি একদিন না দেখিলাম তারে

যার চেতনাকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে/দেখতে আমি পাইনি/বাহির পানে চোখ মেলেছি/হৃদয় পানে চাইনি এবং আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে/তাই হেরি তায় সকলখানে

আধ্যাত্মচেতনা আর ঐশ্বর্যের মাধুর্যে লালন সাঁই যে মরমি জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর মহাপ্রয়াণের এক শতাব্দীর বেশী সময় পেরুলেও গানের চেতনায় কোনো ভাটা পড়েনি মানুষের মাঝে। চর্যাপদের মতো তাঁর গানের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি দিনের পর দিন মানুষের বোধকে ত্বরান্বিত করেছে সাম্যবাদিতা আর অসাম্প্রদায়িকতার দিকে। জাতভেদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লালন সাঁইয়ের গান এক নীরব মূলমন্ত্র, চেতনার শাণিত মারণাস্ত্র। মানুষকে ধর্মের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত করে লালন দর্শন মানুষকে শেখায় যুক্তিবাদী তথা বাস্তববাদী হতে।

একদিন আশা করি- লালন দর্শন ব্যাপক প্রসারিত হয়ে মানুষের অজ্ঞানতা ঘুচাবে, মুক্ত করবে অন্ধকার। বিকশিত করবে বিশ্বমানবতা ও মানুষের সাম্যচিন্তার বিবেককে।

Read the English version of this article

Comments

The Daily Star  | English
High temperature days record in Bangladesh

High Temperature Days: Barring miracle, record of 76yrs breaks today

At least 23 days of this month were heatwave days, which equals the record set in 2019 for the entire year.

13h ago