জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি: আরও কঠিন হবে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন
একটি রাশিয়ান প্রবাদে বলা হয়েছে, একজন গরিব মানুষ কীভাবে খাবার সংগ্রহ করেন সেই খবর কেউ রাখেন না। সরকার হঠাৎ করেই ডিজেল, কেরোসিন এবং তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর প্রবাদটিকে আরও যথার্থ মনে হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় অন্যান্য পণ্য ও পরিষেবার দামও বাড়তে পারে। অর্থাৎ জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্ত দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তশ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা এবং নিত্য ব্যয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। অথচ তারা এখনো মহামারির আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
তেমন একজন নিম্নআয়ের মানুষ বিল্লাল হোসেন এবং তার জীবিকা কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল।
রাজধানীর মিরপুরে বিল্লালের একটি অস্থায়ী চায়ের দোকান আছে। সেখানে তিনি কেরোসিনচালিত স্টোভ দিয়ে দোকানটি চালান। গতকাল থেকে জ্বালানির মূল্য লিটারে ১৫ টাকা বাড়ায় বিল্লালের মাথার ওপর একপ্রকার আকাশ ভেঙে পড়েছে।
বিল্লাল প্রতি কাপ চা ৫ টাকায় বিক্রি করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি যে, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পেলেও চায়ের দাম বাড়াতে পারছেন না তিনি।
দ্য ডেইলি স্টারের কাছে বিল্লাল হোসেন প্রশ্ন করেন, 'আজ থেকে আমি যদি প্রতি কাপ চায়ের দাম ১০ টাকা করি তাহলে কী কেউ আমার দোকানে আসবে? সরকার কী কখনো আমাদের মতো নিম্নআয়ের মানুষের কথা ভাবে?'
এই চা বিক্রেতা মহামারির সময় নেওয়া ঋণ এখনো পরিশোধ করতে পারেননি।
রাস্তার পাশে বা ফুটপাতে বিল্লালের মতো অনেকেই এভাবে চা বিক্রি করেন এবং সাধারণ মানুষ তার প্রধান ক্রেতা। অথচ জ্বালানির মূল্য বাড়ায় চায়ের দাম না বাড়লেও চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
বাংলাদেশে, চাষাবাদের জন্যে ব্যবহৃত প্রায় সব যন্ত্রচালিত লাঙল এবং সেচ যন্ত্র ডিজেলচালিত। ডিজেলের দাম গতকাল থেকে লিটারে ১৫ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে।
সুতরাং, শুষ্ক মৌসুমের ফসল বোরোর উৎপাদন ব্যয় প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে এবং অবশ্যই ভোক্তাদের কাছে সেভাবেই পৌঁছাবে। উল্লেখ্য, দেশের মোট চাল উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি বোরো মৌসুমে উৎপাদিত হয়।
এছাড়া, খামার থেকে বাজারে চাল এবং অন্যান্য পণ্য পরিবহন ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। কারণ পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ট্রাক এবং কাভার্ড ভ্যানগুলো ডিজেলে চলে।
বছরে ব্যবহৃত ৪০ লাখ টন ডিজেলের প্রায় ৭২ শতাংশ পরিবহন খাতে ব্যবহৃত হয়।
ট্রাক ভাড়া ছাড়াও দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের অন্যতম পরিবহন মাধ্যম বাস ভাড়াও বৃদ্ধি পাবে। ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও বেড়েছে।
সংক্ষেপে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত তাদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে ও তারা এটি পূরণের সামর্থ্য রাখে না। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশনের প্রায় ২০ কোটি টাকা দৈনিক লোকসান আটকাতে এসব করা হচ্ছে। যেটি ২০১৪-১৫ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যে ৪৩ হাজার ১৩৬ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে।
বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রক কমিশনের গতকালের উদ্যোগ অনেকটা দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের ক্ষতস্থানে লবণ ঘষার মতো। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দামের সামঞ্জস্য রাখতে এপ্রিল থেকে এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো এলপিজির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিলো বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রক কমিশন।
জ্বালানি বিপণনের সবচেয়ে সাধারণ মাধ্যম ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৫৪ টাকা বেড়ে এখন ১ হাজার ৩১৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
জ্বালানির ত্রিমুখী মূল্যবৃদ্ধি অসংযতভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি টানা তৃতীয় মাসে ৫.৫৯ শতাংশ বেড়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'এই মুহূর্তে এটা কাম্য নয়।'
মূল্যস্ফীতি বাড়ছে জানিয়ে বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ইতোমধ্যে পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও উচ্চপর্যায়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে কেরোসিন এবং ডিজেলের দাম বৃদ্ধি নিম্নআয়ের মানুষ কোণঠাসা হয়ে পড়বে।
সরকারকে তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান এসএম নাজের হোসেন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম কম ছিল, কিন্তু সরকার তখন সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে অভ্যন্তরীণ দাম কমায়নি।
তিনি সরকারকে বিপিসিকে ভর্তুকি প্রদানের পরামর্শ দেন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দাম বাড়ানোর পরিবর্তে এই সংস্থাটি ২ হাজার ৩২১ কোটি টাকা লোকসান করেছিলে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম কৃষকদের উৎপাদন ব্যয় ন্যায়সঙ্গত স্তরে রাখতে সেচের জন্য নগদ ভর্তুকি দেওয়ার আহ্বান জানান।
২০০৯-১০ সালে কৃষকরা ৮০০ টাকা পেয়েছিলে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে কৃষকদের নগদ ভর্তুকি পাওয়ার উদাহরণ আছে। সরকারের উচিত বোরো মৌসুম শুরুর আগে ভর্তুকি ঘোষণা করা।'
প্রাক্তন খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল বলেন, কৃষকরা নভেম্বর-ডিসেম্বরে বোরো চাষের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তাই ব্যবহৃত ডিজেলের জন্য সরকার ভর্তুকি ঘোষণা করলে তাদের ফসল চাষে আগ্রহ বাড়বে।
এদিকে, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড-ট্যাংক-লরি প্রাইম মুভারস ওনার্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল আজ সকাল ৬টা থেকে দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করছে।
এই সংগঠনের আহ্বায়ক রুস্তম আলি খান বলেছেন, মহামারিতে পরিবহন মালিকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তারা যখন লোকসান কাটিয়ে উঠছিল, ঠিক তখনই সরকার দুটি বৃহত্তম সেতুর টোল বাড়িয়েছে।
তিনি বলেন, 'আর এখন পরিবহন মালিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করা পর্যন্ত আমরা ধর্মঘট চালিয়ে যাব।'
পরিবহন মালিকদের আরেকটি প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন নেতা বলেছেন, আজ থেকে সব ধরনের পরিবহন কার্যক্রম স্থগিত থাকবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, কেন্দ্র থেকে ধর্মঘট ডাকা না হলেও, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে জেলা শাখাগুলো আজ থেকে পরিবহন না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানকে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির পর বাস ভাড়া পুনরায় ঠিক করতে চিঠি লিখেছে মালিক সমিতি।
মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ তার লিখিত আবেদনে বলেছেন, গত ৮ বছরে সরকার বাস ভাড়া না বাড়ালেও যানবাহনের সব অংশের খরচসহ কর কয়েকগুণ বেড়েছে।
এনায়েত আরও বলেন, এরপর মহামারিতে লকডাউন পরিবহন ব্যবসাকে কোণঠাসা করে দিয়েছে। তাই ভাড়া না বাড়ালে বাস চালানো সম্ভব হবে না।
যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, রোববার সমিতির সঙ্গে এ বিষয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
তবে, ইতোমধ্যে অনেক বাস এবং লঞ্চের ভাড়া বেড়েছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আল কাচির বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের একটি বাস সার্ভিস ৩৬ টাকা থেকে ভাড়া বাড়িয়ে ৫০ টাকা করেছে।
আমাদের খুলনা সংবাদদাতাও ভাড়া বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপথ (যাত্রীবাহী) অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদল বলেন, বিভিন্ন এলাকায় লঞ্চ মালিকরা ইতোমধ্যে ভাড়া বাড়িয়েছে। যদিও তাদের কেন্দ্রীয় সমিতি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
বাদল আরও বলেছেন, এই বিষয়ে আজ একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ আগামী সোমবার লঞ্চ ভাড়া পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে একটি বৈঠক ডেকেছে।
এদিকে, বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশন সরকারকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে।
Comments