২৬ জুন ১৯৭১: ভারতে শরণার্থী ৬৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯৮

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৬ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভার অধিবেশনে বলেন, ‘পাকিস্তানের ওপর রাজনৈতিক চাপ দেওয়া ছাড়া এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সম্প্রতি আমি বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছিলাম। এসময় প্রতিটি দেশের সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমি বাংলাদেশের বিষয়ে কথা বলেছি। তারা মনে করছেন বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোনো পদক্ষেপ নিলেই কেবল এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। বেশ কয়েকটি চুক্তিতে আমরা বলেছি আমরা চাই, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সব প্রকার সামরিক কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, শরণার্থীদের স্রোত বন্ধ করতে হবে। শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে তাদের নিজ নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্বনেতারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, তারা সব প্রকার সমস্যা সমাধানে নিজ নিজ দেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। একইসঙ্গে অনেকে শরণার্থীদের জন্য সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা বলেছেন ষাট লাখ শরণার্থীর কারণে ভারত বিপদে পড়েছে আমরা জানি। আমরা ভারতকে সর্বপ্রকারে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।’
২৬ জুন ভারতের ত্রাণ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, পূর্ববাংলা থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯৮ জনে। ছবি: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৬ জুন গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভার অধিবেশনে বলেন, ‘পাকিস্তানের ওপর রাজনৈতিক চাপ দেওয়া ছাড়া এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সম্প্রতি আমি বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছিলাম। এসময় প্রতিটি দেশের সরকার প্রধান ও রাষ্ট্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমি বাংলাদেশের বিষয়ে কথা বলেছি। তারা মনে করছেন বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোনো পদক্ষেপ নিলেই কেবল এই সমস্যা সমাধান সম্ভব। বেশ কয়েকটি চুক্তিতে আমরা বলেছি আমরা চাই, বাংলাদেশে পাকিস্তানের সব প্রকার সামরিক কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, শরণার্থীদের স্রোত বন্ধ করতে হবে। শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে তাদের নিজ নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্বনেতারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, তারা সব প্রকার সমস্যা সমাধানে নিজ নিজ দেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। একইসঙ্গে অনেকে শরণার্থীদের জন্য সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা বলেছেন ষাট লাখ শরণার্থীর কারণে ভারত বিপদে পড়েছে আমরা জানি। আমরা ভারতকে সর্বপ্রকারে সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।’

ঢাকায় এদিন

২৬ জুন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম এক বক্তব্যে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানের মর্যাদার ওপর আঘাত হেনেছে। বিশ্বব্যাংক এখন পাকিস্তানকে বিভক্তি করতে চাইছে। কিন্তু, আমাদের জনগণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। ভারতের প্ররোচনায় বিশ্ব ব্যাংক এখন পাকিস্তানকে দেওয়া সমস্ত সহায়তা ও ঋণ বন্ধ করতে চাইছে। এটি যে ভারতের প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই না তা প্রকাশ্য সত্য।’

সারাদেশে এদিন

২৬ জুন সামরিক প্রশাসনের চীফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ নাটোর সফর করেন। এসময় তিনি নাটোরের শান্তি কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে শান্তি কমিটির সদস্যরা বলেন, ‘তারা জীবিত থাকতে নাটোরে কোনো দুষ্কৃতিকারী দুর্বৃত্ত আশ্রয় নিতে পারবে না।’

২৬ জুন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি মুজিবনগর থেকে এক বিবৃতিতে বলে, আমরা বাংলাদেশের জনসাধারণের মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আবেদন জানাই। আমরা বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক এবং সংগ্রামী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একটি ফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী লীগকে এগিয়ে আসতে হবে। ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে এমন একটি ফ্রন্ট গড়ে তুলতে কমিউনিস্ট পার্টি চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ ধরনের চেষ্টা শুধু বাংলাদেশের জনগণকেই আরও অনুপ্রাণিত করবে না, বিশ্ব জনমতকেও সংগ্রামের সমর্থক করে তুলবে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে। দুঃখের কথা, চীন প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বও এই সামরিক জান্তাকে সাহায্য করছে। আমরা আশা করব- জাতিসংঘ অতি দ্রুতই কোনো পদক্ষেপ নেবে।

২৬ জুন খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কালান্তর প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষাসহ সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে। অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যও দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখার জন্য এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ও শরণার্থীদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, সমর্থক এবং জনসাধারণকে আহ্বান জানানো হয়েছে। অধিবেশন শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সংহতি জানানো সারা ভারতবর্ষের জনগণের এখন জরুরি কর্তব্য বলে কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পরিষদ মনে করেন। প্রায় ষাট লক্ষাধিক মানুষ ইয়াহিয়ার অত্যাচারের মুখে দেশ ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে তাদের দেশকে যথাসত্বর মুক্ত করতে পারেন, তার জন্য তাদের অস্ত্র, সামরিক শিক্ষা ও অন্যান্য সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে। এর ফলেই গৃহহীন মানুষ তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারবে বলে পরিষদ মনে করে।

ভারতে এদিন

২৬ জুন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দিল্লি কূটনৈতিক মিশনের প্রধান সচিব কে এম শেহাবউদ্দিন এক বিবৃতিতে বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিতে হবে, গণহত্যা বন্ধ করতে হবে আর এজন্য সর্বপ্রথম মুসলিম বিশ্বকেই এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে গণহত্যা বন্ধে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, যেন তারা গণহত্যা বন্ধে বাধ্য হয়।’

২৬ জুন পশ্চিমবঙ্গের শান্তি সংসদ এক বিবৃতিতে বলে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্রবোঝাই দুটি জাহাজ পাকিস্তানে পাঠানোতে আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য করার অর্থ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

২৬ জুন দিল্লিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির পক্ষে জনমত গঠনে ও পূর্ব পাকিস্তানে সমস্ত প্রকার নিপীড়ন বন্ধে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়  সর্বোদয় পার্টির নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকে। আগামী ১৮, ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর তিনদিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে বলে জানায় এই কমিটি। 

২৬ জুন ভারতের ত্রাণ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে বলে, পূর্ববাংলা থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯৮ জনে। 

২৬ জুন কলকাতা বিমানবন্দরে ব্রিটিশ শিশু ত্রাণ তহবিলের সহসভাপতি ও ভারতের সাবেক ভাইসরয় লর্ড কার্জনের মেয়ে লেডি আলেকজান্দ্রা মেটকাফ পূর্ববাংলা থেকে আগত শরণার্থী শিশুদের সাহায্য প্রদানের ঘোষণা দেন।

২৬ জুন আফ্রো–এশিয়া সংহতি সংস্থার ভারতীয় চ্যাপ্টারের সহ-সভাপতি অরুণা আসফ আলী চ্যাপ্টারের সভাপতি কে ডি মালবাকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে তাদের বক্তব্য প্রদানের অনুমতি না দেওয়াটা ন্যাক্কারজনক কাজ হয়েছে। ভারতীয় প্রতিনিধিদল পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব সম্পর্কে যা বলেছে, তা ফলপ্রসূ হয়নি। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে দামেস্ক বৈঠকে যে প্রস্তাব নেওয়া হয়, তা পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থার কর্ম সমিতি ইচ্ছা করে পাকিস্তানের নিন্দা করা থেকে বিরত থেকেছে। এ অবস্থায় ভারত ওই সংস্থার সদস্য হিসেবে থাকবে কিনা, তা নতুন করে ভাবা উচিত। সম্প্রতি সিরিয়ার দামেস্কে অনুষ্ঠিত সংস্থার বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যাপারে যেভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করা হয়েছে এবং ভারতীয় প্রতিনিধিদলকে উপেক্ষা করা হয়েছে, তাতে আমরা ভীষণ বিরক্ত। এটি করা কোনভাবেই উচিৎ হয়নি। পাকিস্তান যা করছে তা বিশ্ববাসী তো দেখছেই প্রতিনিয়ত। 

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২৬ জুন চিলির প্রেসিডেন্ট ড. সালভেদর আলেন্দে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে একটি চিঠি পাঠান।

এই চিঠিতে ড. সালভেদর আলেন্দে জাতিসংঘ মহাসচিবকে পাকিস্তানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানান। তিনি বলেন, ‘পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের নিজ নিজ গৃহে ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘের উচিত উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া।’

২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, গত ২২ জুন পদ্মা নামের যে জাহাজ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্র নিয়ে করাচীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে, সেই জাহাজে গুলি, যুদ্ধবিমানের কিছু যন্ত্রাংশ ও স্থলপথে সামরিক যানবাহনের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রয়েছে। এরইমধ্যে পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে, আমাদের প্রতিরক্ষা দপ্তর জানিয়েছে, জাহাজে কোনো সামরিক বিমান নেই।

লাইসেন্স মঞ্জুরের বিষয়ে তিনি বলেন, দুটো লাইসেন্সের আবেদন প্রথমে অসতর্ক অবস্থায় মঞ্জুর করা হলেও, সেই দুটো লাইসেন্সই বাতিল করা হয়েছে। 

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৬ জুন ময়মনসিংহে হাবিলদার রেফাজউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে মুক্তাগাছা থানা আক্রমণ করেন। এসময় থানায় প্রহরারত পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর। এসময় চার পুলিশ নিহত ও বেশ কজন আহত হয়। শেষমেশ পুলিশ থানা ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনী থানা দখল করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেয়।

২৬ জুন কুমিল্লায় সুবেদার ওয়ালীউল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল কাফলাতলী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এসময় বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। পরে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প দখলে নেয়।

২৬ জুন সুবেদার বি আর চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সিলেট-তামাবিল সড়কে শ্রীপুরে হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় দুই দলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হেরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা পিছু হটে চলে যায়। শ্রীপুরের পূর্ণ দখল নেয় মুক্তিবাহিনী।   

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, সপ্তম দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড 

দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ জুন ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৭ জুন ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Default loans

High bad loans a 'big threat' to financial sector: BB

The central bank said in quarterly review on money and exchange rate

3h ago