জিএসপি প্লাস পেতে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট কৌশল থাকা প্রয়োজন

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে এ সুপারিশ করেছে। তবে, বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে বের হতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ছবি: সংগৃহীত

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে এ সুপারিশ করেছে। তবে, বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে বের হতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত হিসেবে উন্নয়ন অংশীদার দেশগুলোর দেওয়া বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশ এলডিসির তালিকা থেকে বের হলে অনেক বাণিজ্য সুবিধা থাকবে না। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রপ্তানিকৃত পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা। রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা বাদ যাওয়ার ফলে তা বাণিজ্যের ওপর কিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সেটিই এখন বাংলাদেশের সব রপ্তানিকারকদের আগ্রহ ও আশঙ্কার বিষয়।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানিকৃত পোশাকের ৬২ শতাংশ ও মোট রপ্তানির ৫৬ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের বাজার। বিশাল বাণিজ্যিক সুবিধাগুলো হারানো বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সক্ষমতার জন্য এক বিশাল হুমকি। কাজেই বিশ্ববাজারে বিশেষ করে ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাণিজ্য সুবিধা হারানোর ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিযোগী সক্ষমতার ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা মোকাবিলা করাই হবে স্বল্পন্নোত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

স্বল্প আয় ও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৫ সালে ‘স্পেশাল ইনসেনটিভ অ্যারেঞ্জমেন্ট ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা চালু করে। যা জিএসপি প্লাস হিসেবে সমধিক পরিচিত। জিএসপি প্লাসের অধীনে ইউরোপের বাজারে ট্যারিফ লাইনের ৬৬ শতাংশ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। বর্তমানে মাত্র আটটি দেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা পাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এ সুবিধা পাচ্ছে।

বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার জন্য কীভাবে এবং কতটা প্রস্তুত হচ্ছে? অনেকেই ধারণা করছেন, বাংলাদেশ ‘এভরিথিং বাট আরমস (ইবিএ)’ স্কিমের আওতায় ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত বাণিজ্যিক সুবিধা ভোগ করতে পারবে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো যে, ইইউ ২০২৩ সালের মধ্যে নতুন জিএসপি প্লাস নীতি প্রণয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যার ফলে হয়তো বাংলাদেশের জন্য ইবিএ সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে অব্যাহত থাকবে না।

জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে বাংলাদেশকে বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে। একটি দেশকে অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক পূরণ করতে হবে। অর্থাৎ, একটি দেশের শীর্ষ সাতটি পণ্যের মোট রপ্তানিমূল্য জিএসপির আওতায় রপ্তানিকৃত পণ্যের মোট মূল্যের ৭৫ শতাংশ হতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জিএসপির আওতায় রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য রপ্তানিকৃত পণ্যের মোট মূল্যের ৯৫ শতাংশ। কাজেই জিএসপি প্লাস পাওয়ার এই একটি সূচকে বাংলাদেশ যোগ্য।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। সেটি হচ্ছে ইইউ থেকে এলডিসি যেসব জিএসপি সুবিধা পায়, তার সাত দশমিক চার শতাংশের বেশি হিস্যা হলে জিএসপি প্লাসের জন্য যোগ্য হবে না। বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে অন্যতম পোশাক সরবরাহকারী দেশ। কাজেই এখানে বাংলাদেশের হিস্যা বর্তমানে প্রায় ২৬ শতাংশ। তবে, ইইউ জিএসপি প্লাস নিয়ে যখন নতুন আইন করবে, এ বিষয়ে পরিবর্তন আনলে বাংলাদেশ সুবিধা পাবে। সুতরাং এই শর্ত পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশকে এখনই ইইউর সঙ্গে আলাপ করতে হবে।

বিদ্যমান ইবিএ স্কিমের আওতায় এলডিসিভুক্ত দেশগুলো ‘রুলস অব অরিজিন’র শর্ত সাপেক্ষে ‘সিঙ্গেল টান্সফরমেশন’র অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পায়। কিন্তু, জিএসপি প্লাসের অধীনে এই অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পেতে হলে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে ‘ডাবল টান্সফরমেশন’র শর্ত পূরণ করতে হয়। অর্থাৎ, এলডিসি পরবর্তী যুগে শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করতে হলে বাংলাদেশকে প্রথমে সুতা থেকে বস্ত্রে তৈরি করতে হবে এবং সেই বস্ত্র ব্যবহার করে পোশাক বানাতে হবে। এটি আমাদের বাণিজ্য সক্ষমতার জন্য সম্ভাবনাময়। তবে, সেক্ষেত্রে আমাদের পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের বিদ্যমান কাঠামোগত পরির্বতনের কথা বিবেচনা করতে হবে।

কঠিন টেকনিক্যাল বা কারিগরি ইস্যুগুলো ছাড়াও আরও অনেক জটিল ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বা টেকসই উন্নয়ন এবং ‘সুশাসন’ সম্পর্কিত সমগুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। এই শর্তগুলোকে সামষ্টিকভাবে ‘সাসটেইনেবল রিকয়ারমেন্ট’ বলা হয়। এখানে সামাজিক ও পরিবেশগত বিবেচ্যগুলো আরও বিস্তৃত বিষয়।

কাজেই নিশ্চিন্তে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। আসন্ন পরিস্থিতি ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের জোর দিতে হবে।

সরকার ও সব বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে প্রয়োজনীয় ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করতে হবে। যার দ্বারা জিএসপি প্লাস সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ‘অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা’ ও ‘আমদানি হিস্যা’ সূচকের বিষয়ে যথাযথ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা যায়।

পোশাক শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা পশ্চাদপদ শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য ৮০ শতাংশ নিটওয়্যার পণ্য ‘ডাবল টান্সফরমেশন’র মাধ্যামে তৈরি হচ্ছে। অর্থাৎ, সুতা থেকে বস্ত্র তৈরি করে তা দিয়ে পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু, ওভেন পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কাজেই জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে হলে আমাদের বস্ত্রখাতে ঘাটতি পূরণ করার জন্য ‘কৌশলগত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

জিএসপি প্লাসের আওতাধীন ‘রুলস অব অরিজিন’র ক্ষেত্রে ডাবল টান্সফরমেশনের শর্ত পূরণের বিকল্প উপায়ও রয়েছে। এর একটি হচ্ছে আঞ্চলিক উৎস থেকে সুতা ও বস্ত্র সংগ্রহ করে ডাবল টান্সফরমেশনের শর্ত পূরণের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে বস্ত্র আমদানি করার মাধ্যমে ডাবল টান্সফরমেশনের শর্ত পূরণ করা সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারত অন্যতম বৃহৎ বস্ত্র ও পোশাক তৈরির কাঁচামাল সরবরাহকারী। তবে, নিজ দেশের বস্ত্র শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশ সঙ্গত কারণে ভারত থেকে বস্ত্র আমদানির বিকল্পটি এখন পর্যন্ত এড়িয়ে চলছে। কিন্তু, জিএসপি প্লাস সুবিধা নেওয়ার জন্য ভারত থেকে আমরা কী পরিমাণ বস্ত্র ও কাঁচামাল আমদানি করব, তা আমাদের নির্ধারণ করতে হবে।

ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, এমন দেশগুলো থেকে আমদানি করলেও এ শর্ত পূরণ হবে। এক্ষেত্রে এশিয়ার দুই দেশ— ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ার ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। এই দুই দেশ থেকে বাংলাদেশ বস্ত্র আমদানির কথা বিবেচনা করা যায়। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বস্ত্র আমাদানি করলে দামের দিক থেকে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতা কতটা থাকবে, তা অবশ্যই আমাদের হিসাব করে দেখতে হবে। ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করাটা ততটা সহজ হবে না। কারণ বিশ্ব পোশাক রপ্তানির বাজারে ভিয়েতনাম বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রতিযোগী দেশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলেছে।

পাশাপাশি পরিষ্কার জ্বালানি, কার্বন নিরপেক্ষতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, ইউরোপের গ্রিন ডিল, চক্রকার অর্থনীতির কাঠামোর মতো বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নে সরকার ও শিল্প সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের একটি সুস্পষ্ট কৌশল থাকা বাঞ্ছনীয়।

ইউরোপের বাজারে স্থায়ীভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির কথাও বাংলাদেশ বিবেচনা করতে পারে। তবে, ইউরোপের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি অনেকটাই রাজনৈতিক। আর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন একটি সময়সাপেক্ষ দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও চুক্তি সম্পাদনকারী পক্ষদ্বয়ের শিল্পগুলোর মধ্যকার বাণিজ্যিক ভারসাম্যের জটিল হিসাব-নিকাশের বিষয় রয়েছে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে আমাদের সরকারের ও ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের এখন পর্যন্ত যে প্রাথমিক জ্ঞান ও প্রস্তুতি রয়েছে, তাতে কোন পর্যায়ে বাংলাদেশ ইউরোপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার কথা বিবেচনা করবে, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। তবে, সরকার ও ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করা এখনই উপযুক্ত সময়। অন্ততপক্ষে নিজেদের মধ্যে হলেও সে আলোচনা এখনই শুরু করা উচিত।

মোস্তাফিজ উদ্দিন: ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

3h ago