বিদেশ যাত্রায় ভুল প্রক্রিয়া, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি

দুই বছরের চুক্তি নিয়ে উন্নত জীবনের আশায় আঁখি বেগম (ছদ্মনাম) ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন।
স্টার ফাইল ফটো

দুই বছরের চুক্তি নিয়ে উন্নত জীবনের আশায় আঁখি বেগম (ছদ্মনাম) ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে সৌদি আরবের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন।

কিন্তু সৌদি যাওয়ার তিন মাসের মাথায় ২৭ বছর বয়সী মুন্সিগঞ্জের আঁখি দেশে ফিরে আসেন। কারণ দেশ ছাড়ার আগে যে ধরণের প্রতিশ্রুতি তাকে দেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে সৌদি আরবের কর্মপরিবেশের কোনো মিল ছিল না।

রিয়াদে ১০ সদস্যের একটা পরিবারে অতিরিক্ত কাজের চাপ, তার সঙ্গে জীবন ধারণের জন্য খাবার ও কাপড়ের অভাবের মতো বিভিন্ন বিষয় এই গৃহকর্মীকে দ্রুত তার মালিকের বাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য করে।

পরবর্তীতে আঁখিকে পালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করে সৌদি পুলিশ। দুই সপ্তাহ জেলে কাটিয়ে সৌদি আরবের বাংলাদেশ মিশন থেকে ‘আউট পাস’ নিয়ে মুক্ত হন তিনি।

তিন সন্তানের মা আঁখি বলেন, ‘আমি ওই মালিকের বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। কারণ ওখানকার পরিবেশ  আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।’

আঁখির এই পরিস্থিতির সঙ্গে গত কয়েক বছরে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে আসা প্রবাসী নারী শ্রমিকদের মিল রয়েছে। তারা প্রত্যেকে নিজেদের জীবনের বাঁক পরিবর্তনের জন্য দেশ ছাড়লেও খালি হাত আর ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

‘ভুলে ভরা’ নিয়োগ প্রক্রিয়া

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) এক প্রতিবেদন অনুসারে দুই বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ১৫১ জনের মতো প্রবাসী নারী শ্রমিক নিপীড়নমূলক কর্মপরিবেশসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখে এক বছরের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন। এই হার প্রায় ৫৮ শতাংশ।

গত মার্চ মাসে প্রকাশিত ‘অ্যাকসেস টু জাস্টিস ফর বাংলাদেশি মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারস: অপুরচুনিটিজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ছাড়া ৫৬ জন নারী ফিরে এসেছেন প্রথম বারের মতো দেশ ছাড়ার এক থেকে দুই বছরের মধ্যে। ৩২ জন দেশে ফিরেছেন দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে। আর ২৩ জন ফিরেছেন তিন বছরের বেশি সময় পর।

তৃণমূল পর্যায়ের অভিবাসী নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ওকাপ ফরিদপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জের ২৬২ জন নারী শ্রমিকের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করে। যারা ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশ ছেড়েছিলেন। তাদের বেশিরভাগ ২০১৮ ও ১৯ সালের মধ্যে দেশে ফিরে আসেন।

জরিপের ফলাফল বলছে, এসব নারী শ্রমিকদের দেশে ফিরে আসার কারণগুলোর মধ্যে আছে মজুরি না পাওয়া, অসুস্থতা, শারীরিক নির্যাতন, যৌন হেনস্থা ও অতিরিক্ত কাজের চাপ।

ওকাপ চেয়ারপার্সন শাকিরুল ইসলাম বলেন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এক বছরের মধ্যে ১৫১ জন নারীর দেশে ফিরে আসার মূল কারণ নিয়োগে ‘ভুল’ প্রক্রিয়া।

শাকিরুল গত মাসে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, এই নারীদের মধ্যে কাউকে তার চাকরি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছিল, কাউকে অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আর অন্যদের পাঠানো হয়েছিল উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই।

ওকাপ প্রধান জানান, ১৫১ জন প্রবাসী নারী শ্রমিকের অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৮১ জন ফিরে আসেন দেশ ছাড়ার তিন মাসের মধ্যে। এ ছাড়া ৩১ জন তিন থেকে ছয় মাস ও ৩৯ জন ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে ফিরে আসেন।

প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ৯৫ শতাংশ নারী শ্রমিককে নিয়োগ দেওয়া হয় স্থানীয় সাব এজেন্টদের মাধ্যমে, তিন শতাংশ সরাসরি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে আর দুই শতাংশ যান পারিবারিক সদস্যদের মাধ্যমে।

ঘরে-বাইরে একই অনিয়ম

ওকাপের প্রতিবেদন বলছে, দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের ৮৮ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের সঙ্গে কাজের ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি। কেবল অনানুষ্ঠানিক আলোচনার ভিত্তিতে তাদের  কাজের ধরন, দায়িত্ব, মালিক, মজুরি ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে জানানো হয়েছিল।

৪৫ শতাংশ নারী জানান, এজেন্ট ও সাব এজেন্টরা তাদের যে পরিমাণ মজুরি দেওয়ায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটা তারা পাননি।

সরকারি নিয়ম অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে যেকোনো দেশে নারী শ্রমিক নিয়োগের বিষয়টি বিনামূল্যে হওয়ার কথা। কিন্তু জরিপে অংশ নেওয়া ৬৫ শতাংশ নারী জানান, তারা এ জন্য পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছেন। দুই শতাংশ নারী দিয়েছেন এক লাখ টাকার বেশি।

এ ছাড়া প্রায় ৪৩ শতাংশ নারী বলেছেন, এজেন্ট ও সাব এজেন্টরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদের সীমিত জানা-বোঝার বিষয়টির অপব্যবহার করেছে। সেই সঙ্গে মজুরি, মালিক ও তাদের পরিবার এবং কাজের চাপ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছে।

ফিরে আসা ১৫৬ জন নারী জানান, তারা মাঝে মধ্যেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আর যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন ১৬ শতাংশ।

তাদের মধ্যে ১৩৩ জন নারী জানান, প্রতিদিন তাদের ১৪ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। এ ছাড়া ৩৬ শতাংশ নারী এক মাসের মজুরি পাওনা থাকা অবস্থায় কর্মস্থল থেকে পালান।

এর বাইরে ১৮ শতাংশ নারীকে ভুয়া চিকিৎসা সনদ দিয়ে বাইরে পাঠানো হয়।

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়মকারীদের শাস্তি হয় না

দেশে ফিরে আসা ১২৩ জন নারী ২০১৯ সালে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) সালিশি মামলা করেছিলেন। এসব মামলায় বেশিরভাগ অভিযোগ ছিল পাওনা মজুরি ফিরে পাওয়া এবং জোরপূর্বক কাজ, নির্যাতন, যৌন নিগ্রহ ও চিকিৎসা খরচের ক্ষতিপূরণ আদায় সংক্রান্ত।

এর মধ্যে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৩১ শতাংশ অভিযোগের সুরাহা হয়েছিল। বাকিগুলো তখন পর্যন্ত অনিষ্পন্ন ছিল।

ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল সম্প্রতি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য এসব অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সামনে আনা উচিত।

শাকিরুলের অভিমত, যেহেতু অবৈধ নিয়োগের এই চর্চা শ্রমিকদের ফিরে আসার জন্য দায়ী, তাই এর সুবিচারের জন্য বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণা বলছে যে নারী শ্রমিকদের ফিরে আসার পেছনে এ ধরণের অনিয়মই দায়ী। সুতরাং এটার দায় অবশ্যই তাদের নিতে হবে।’

ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের সুবিচার নিশ্চিতের জন্য ওকাপ প্রধান একটা নিরপেক্ষ সালিশি ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরামর্শ দেন। তার ভাষ্য, বিএমইটির যে সালিশি আদালত আছে সেখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। কারণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এই সংস্থাটিও জড়িত।

যোগাযোগ করা হলে বিএমইটির মহাপরিচালক শামসুল আলম সম্প্রতি বলেন, এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা পেলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে তারা নিয়মিত ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।

শামসুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে আরও বলেন, যদি কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয় তাহলে তাদের তলব করা হয়।

‘কর্মচুক্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া গেলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। পাশাপাশি দায়ী এজেন্সিগুলোর লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়,’ যোগ করেন তিনি।

 

প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Reference Institute for Chemical Measurements (BRiCM) developed a dengue rapid antigen kit

Diagnose dengue with ease at home

People who suspect that they have dengue may soon breathe a little easier as they will not have to take on the hassle of a hospital visit to confirm or dispel the fear.

10h ago