মুক্তিযুদ্ধের ঈদ যেমন ছিল

আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের জীবনে বছরের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বাঙালি মুসলমানদের জীবনে আজ যেমন ঈদ এসেছে, ঠিক তেমনই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়েও স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল ঈদুল ফিতর। মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল ঈদুল ফিতরই পালিত হয়েছিল, ঈদুল ফিতরের পর ঈদুল আজহা এসেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঈদের দিন এসেছিল ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর। দিনটি ছিল শনিবার।
মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকায় আউটার স্টেডিয়ামে ঈদ জামাতে মুসল্লিদের একাংশ। ছবি: জয় বাংলা থেকে নেওয়া

আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের জীবনে বছরের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বাঙালি মুসলমানদের জীবনে আজ যেমন ঈদ এসেছে, ঠিক তেমনই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়েও স্বাভাবিকভাবেই এসেছিল ঈদুল ফিতর। মুক্তিযুদ্ধের সময় কেবল ঈদুল ফিতরই পালিত হয়েছিল, ঈদুল ফিতরের পর ঈদুল আজহা এসেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ঈদ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঈদের দিন এসেছিল ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর। দিনটি ছিল শনিবার।

দেশবাসী সেবার প্রথমবারের মতো ঈদ উৎযাপন করল তীব্র আতঙ্ক, উৎকণ্ঠায়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন সম্মুখ সমরে, রণাঙ্গনে। শরণার্থীরা ঈদ কাটিয়েছেন শরণার্থী শিবিরে। মানুষ বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছে নিজ নিজ ঘরে। সেবার ঈদ এসেছিল একদম ভিন্ন আর ভীষণ অচেনা রূপে। মুক্তিযুদ্ধের সেই ঈদ কেমন ছিল?

মুক্তিযুদ্ধের ঈদ ছিল পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের জন্যে চরম পরীক্ষা। বিশেষ করে সারা রমজান মাসজুড়েও পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দালালেরা চালিয়েছে একের পর এক গণহত্যা, লুটপাট, বর্বরতা আর   ধর্ষণের মহোৎসব। সারাদেশের মানুষ এদিনও তাকিয়ে ছিল মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের দিকে। এদিন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে কুড়িগ্রামের রায়গঞ্জ যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন ছয় নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা  আশফাকুস সামাদ বীর উত্তমসহ রণাঙ্গনের বহু মুক্তিযোদ্ধা।

ঈদের দিন মুক্তিযোদ্ধারা পুরো দেশজুড়ে তীব্র আক্রমণ প্রতি আক্রমণ গড়ে তুলেছিল। মুক্তিফৌজ এদিন উত্তর চব্বিষ পরগনার বসন্তপুর সীমান্ত চৌকির দখল নিয়ে নেয়। অন্যদিকে উত্তর চব্বিশ পরগনার হিঙ্গলগঞ্জ থেকে ভারতীয় বাহিনী ইছামতি নদী অতিক্রম করে যোগ দেয় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। এদিন মুক্তিবাহিনীর হাতে বসন্তপুর ও কালীগঞ্জ মুক্ত হয়।

একাত্তরের ১৯ নভেম্বর ৩০ রোজার দিন উকসার দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে মুক্তিবাহিনী। সে সময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় এক পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদারেরা পিছু হটে ইছামতির পূর্ব পাড়ে অবস্থান নেয়। সেদিন সারারাত মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদারদের যুদ্ধ চলে। ঈদের দিন বেলা ১২টার দিকে কালীগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারেরা।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’র ২৮তম সংখ্যা। ছবি: জয় বাংলা থেকে নেওয়া

কালীগঞ্জের ওয়াপদা কলোনিতে এক কোম্পানি হানাদার সেনার সঙ্গে পাকিস্তানি রেঞ্জার ও বেশ কিছু রাজাকার অবস্থান নিয়েছিল। উকসা বিওপি ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন নুরুল হুদা তখন এটি আক্রমণ করতে রওনা হন। এক কলাম যোদ্ধা নিয়ে বসন্তপুর হয়ে কালীগঞ্জ পৌঁছান তিনি। দু প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাছাকাছি অবস্থান নেন লেফট্যানেন্ট আহসানউল্লাহ ও নায়েক সুবেদার সোবহান। আরেক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে তাদের সঙ্গী হন নায়েক সুবেদার গফুর। ভোর পাঁচটায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। হিঙ্গলগঞ্জ থেকে তাদের আর্টিলারি সাপোর্ট দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৃতীয় রাজপুত। দুই ঘণ্টার এই যুদ্ধ শেষে ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা বন্দি হয়।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের  মুখপাত্র  সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পরবর্তীতে এক প্রতিবেদনের শিরোনামে লিখেছিলো, ‘সাত মাস পর পাক বাহিনীর দখলে থেকে ঈদের দিন কালীগঞ্জ মুক্ত হলো।’

ঈদের দিন রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ৩৮ মুক্তিযোদ্ধাকে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদারেরা। এর আগে ২৭ অক্টোবর সিরু মিয়া দারোগা, তার ছেলে কামাল ও দাউদকান্দি থানা বিএলএফ কমান্ডার শহিদ নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় আটক করে রাজাকারেরা। এরপর তারা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে তাদের তুলে দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে নিয়ে যাওয়ার পর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালান হয়। এরপর ঈদের দিন রাতে সেই ৩৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে শেষদফা নির্যাতন চালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহরের পৈরতলা খাল পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে হানাদারেরা।

ঈদের দিন কলকাতায় থিয়েটার রোডে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সদর দপ্তরের সামনে ঈদ জামাতে অংশ নেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মুক্তিবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীসহ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। নামাজ শেষে তারা কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

ঈদের আগের দিন তথা ২৯ রমজান কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র সাপ্তাহিক জয় বাংলা। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বাণী এই উপলক্ষ্যে বক্স আইটেম করে পত্রিকাটি।

‘এই ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক’ এই শিরোনামে লেখা হয়, ‘আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্যের তাণ্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভুমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদের আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সবাই যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হোক আমাদের প্রার্থনা।’

ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি করছেন তাজউদ্দীন আহমেদ ও এম এ জি ওসমানী। ছবি: জয় বাংলা থেকে নেওয়া

জয় বাংলার সম্পাদকীয় পাতায় বঙ্গবন্ধুর একটি বাণীও প্রকাশিত হয়েছিল। যে বাণীর শিরোনাম ছিল ‘উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ’। মূলত এটি বঙ্গবন্ধুর আগের একটি বাণী। কারণ, তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বঙ্গবন্ধুর বাণীতে লেখা ছিল, ‘সাপ্তাহিক জয় বাংলার ২৮তম সংখ্যায় সম্পাদকীয় কলামে “উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ” শিরোনামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাণীও প্রকাশ করে। যদিও বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের জেলে বন্দি।’

বঙ্গবন্ধুর বাণীতে বলা হয়— ‘আমি নিজেকে বাঙালি ভাবতে গর্ববোধ করি। বহতা নদীর মতো আমাদের সংস্কৃতির ধারাও বেগবতী ও প্রাণাবেগপূর্ণ। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলে বাঙালি আবার বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াবে। বাঙালী হওয়ার সঙ্গে ধর্মে মুসলমান থাকার কোন বিরোধ নেই। একটি আমার ধর্ম। অন্যটি জাতি পরিচয়। ধর্ম আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচার। জাতি পরিচয় আমার সমষ্ঠিগত ঐতিহ্য। একজন হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালী অথবা বৌদ্ধ বা খিস্টান বাঙালি মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, তাদের ধর্মমত শুধু আলাদা কিন্তু খাদ্য, রুচি, ভৌগোলিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, বর্ণ ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিক থেকে তারা অভিন্ন।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন মাহবুব আলম। তিনি তার লেখা ‘গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে’ গ্রন্থে লিখেছেন ঈদের দিন যুদ্ধের কথা। যেখানে তিনি তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য এক সম্প্রীতির কথা। মুক্তিযুদ্ধের নামাজরত অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদারদের হামলার শঙ্কা ছিল, তাই অন্য ধর্মাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধারা ঈদের দিন নামাজরত মুসল্লি মুক্তিযোদ্ধাদের পাহারা দিছে।

মাহবুবে আলম তার গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে গ্রন্থে লিখেছেন— ‘রমযান মাস শেষ হয়ে আসে। ঈদুল ফিতর এসে যায়। যুদ্ধের ভিতর দিয়েই একটা রোযার মাস পার হয়ে গেলো।... ঈদ এসে গেলো। ছেলেরা ঈদ উৎসব পালনের জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছে এরকমের যে, ঈদের দিন পাক আর্মি ব্যাপকভাবে হামলা করবে সীমান্ত এলাকাগুলো জুড়ে। গুজবটা যেভাবেই ছড়াক, যথেষ্ট বিচলিত করে তোলে আমাদের। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঈদের নামাযের জন্য জামাতে দাঁড়াবে ঠিক সে সময়ই নাকি করা হবে এই হামলা!

যুদ্ধের মাঠে শত্রুবাহিনীর সম্ভাব্য কোনো তৎপরতাকেই অবিশ্বাস করা যায় না। ঈদের দিন মুক্তিবাহিনীর দল যখন ঈদ উৎসবে মেতে থাকবে, তারা নামায পড়তে দলবদ্ধভাবে কোথাও সমবেত হবে, তখনই সুযোগ বুঝে তারা হামলে পড়বে অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। খবর যখন রটেছে, এ ধরনের হামলা তখন পাকবাহিনীর তরফ থেকে হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই পাকবাহিনীর তরফ থেকে এ ধরনের সম্ভাব্য হামলাকে সামনে রেখে আমরা ঈদুল ফিতর উৎসবে উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেই। ঈদ মুসলমানদের জন্য প্রধান উত্সবের দিন। জন্ম থেকেই সবাই এই উত্সব পালন করে এসেছে যার যেমন সঙ্গতি, সে অনুযায়ীই। এখানেও যুদ্ধের মাঠে ছেলেরা ঈদ উত্সব পালনের জন্য মেতে উঠেছে। ঈদের নামায পড়া হবে না, ঈদের উৎসব হবে না, ভালো খাওয়া-দাওয়া হবে না, ঈদের দিন সবাই হাতিয়ার হাতে শত্রুর অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসে থাকবে, এরকম একটা কিছু কেউই যেন মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। যুদ্ধের মাঠে, দিনরাত ক্লান্তিহীন যুদ্ধ প্রক্রিয়ার ভেতর ছেলেদের রিক্রিয়েশান বলতে কিছু নেই। দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের একঘেয়ে কাজ। অপারেশন আর যুদ্ধ। এক হাইড আউট থেকে অন্য হাইড আউট। গোলাবারুদ আর হাতিয়ার বয়ে বেড়ানো। ছুটি নেই, আরাম নেই, বিশ্রাম নেই। বড়ো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর জীবন সবার। এর মধ্যে ঈদের উত্সব একটা খুশির আবহ নিয়ে এসেছে। ছেলেদের এই খুশির ভাগ থেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছে করে না। পিন্টুসহ বসে তাই সিদ্ধান্ত নেই। আর সেটা এ রকমের : ঈদের দিন নামায হবে, বড়ো ধরনের আহার-বিহারের আয়োজন করা হবে। মোদ্দা কথা, ঈদ উৎসব পালন করা হবে যথাসাধ্য ভালোভাবেই। সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও করে ফেলে সবাই একসঙ্গে বসে।

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাণী। ছবি: জয় বাংলা থেকে নেওয়া

সিদ্ধান্ত হয় ঈদের আগের দিন সবগুলো দল দু’ভাগে ভাগ হবে এবং সমবেত হবে দু’জায়গায়। নালাগঞ্জ আর গুয়াবাড়িতে। ছেলেরা তাদের নিজেদের মতো করেই ঈদ উৎসব পালন করবে। তবে নামায পড়বে একেবারে সীমান্তের ধার ঘেঁষে। গুয়াবাড়িতে সমবেত ছেলেরা ভারতীয় সীমান্তে উঁচু গড়ের পাদদেশে গিয়ে জামাত পড়বে। নালাগঞ্জে জামাত হবে আমগাছ তলায় পুকুরের পাড়ে। মুসলমান ছেলেরা যখন ঈদের জামাতে দাঁড়াবে, তখন হিন্দু ছেলেরা কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে হাতিয়ার হাতে সতর্ক প্রহরায় থাকবে। হিন্দু সহযোদ্ধাদের দেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে মুসলমান ছেলেরা নামায পড়বে।

এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়ির একরামুলের কাছে। সোনারবানে ঈদে বড় আয়োজনের আহারাদির বাজেট নিয়ে বসে মিনহাজ। সকালে রান্না হবে সেমাই। দুপুরে কোর্মা-পোলাও ইত্যাদি। আর সে অনুসারেই হিসাব-নিকাশ করে লম্বা একটা ফর্দ তৈরি করে ফেলে সে। হিন্দু ছেলেরা রয়েছে, সেহেতু গরু চলবে না। গ্রামের বন্ধুরা তাদের শুভেচ্ছাস্বরূপ পাঠিয়ে দেয় ৪টা খাসি। এরমধ্যে দুটো পাঠিয়ে দেয়া হয় গুয়াবাড়িতে সেখানকার ছেলেদের জন্য বকর ও শামসুদ্দিনের কাছে। নালাগঞ্জে মুসা আর চৌধুরীও সেভাবেই তৈরি হয়। হিন্দু ছেলেরা তাদের মুসলমান ভাইদের নামাযের সময় পাহারা দেবার দায়িত্ব পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে ওঠে। ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এই যুদ্ধের মাঠে জীবন-মরনের মাঝখানেই সবার বসবাস। এক ধর্মের মানুষ ধর্মীয় আচরণ পালন করবে, আর তাদের নিরাপদ রাখার জন্য ভিন্ন ধর্মের মানুষ হাতিয়ার হাতে পাহারা দেবে, আমার কাছে এ এক অভাবনীয় আর মহামানবিক ঘটনা বলে মনে হয়। হিন্দু ছেলেদের সংখ্যা বেশি না হলেও ঈদের জামাতের সময় তাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্য দিয়েই তারা তাদের মুসলমান ভাইদের কিভাবে নিরাপত্তা বিধান করবে, তার পরিকল্পনায় মেতে ওঠে।

ঈদের দিনের সকাল। উৎসববমুখর পরিবেশ। সবাই আনন্দে উচ্ছল। পাশাপাশি চরম উত্তেজনা পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ হতে পারে। ভারতের নেতৃত্বে ৮-১০ জন হিন্দু ছেলে এগিয়ে খালের পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেয়। সকাল ন’টায় ঈদের জামাত শুরু হয় পুকুর পাড়ে। আমি নিজে দাঁড়াতে এবং লাঠি ধরে চলাফেরা করতে পারলেও নামায পড়তে পারি না। ওরা সবাই ঈদগাহের মতো জায়গায় পরম পবিত্র মনে নামাযে দাঁড়ায়। আমিও লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি জামাতের কাছাকাছি অবস্থানে। যা হোক, যুদ্ধের মাঠেও তাহলে আমরা নামায পড়তে পারছি। গভীর এক প্রশান্তিতে ভরে ওঠে মন। সতৃষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমি তাকিয়ে থাকি ঈদের জামাতের দিকে।’

মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুন্নবী খান বীর বিক্রম মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলাকালীন বাহিনীতে। তিনি তার ‘একাত্তরের ঈদের এই দিনে’ প্রবন্ধ লিখেছেন—

‘একাত্তরের ২০ নভেম্বর রোজ শনিবার ছিল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের দিন। ঈদের এই দিনে আমি তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা, ইকো এবং ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার কোম্পানির সৈনিকদের নিয়ে সিলেটের তামাবিল-ডাউকি সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি রাধানগরকে ঘিরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত ছিলাম। ...২০ নভেম্বর পবিত্র ঈদের দিনে আমরা আশা করেছিলাম অন্তত এইদিন পাকিস্তানিরা আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ বা সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ছিল এর বিপরীত দৃশ্য। ঈদের দিন সকাল থেকেই পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিটি অবস্থানেই ব্যাপকভাবে আর্টিলারির গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। আমাদের কোনো অবস্থানেই মুক্তিযোদ্ধারা জামাতের সাহায্যে ঈদের নামায পড়ার সুযোগ পায়নি। তাছাড়া ঈদের দিনে গোসল করা, নতুন জামা-কাপড় পরা বা মিষ্টি-সুজি-সেমাই খাওয়া বা উন্নতমানের খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দুপুরের দিকে দূরবর্তী গ্রাম থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা কিছুটা উন্নতমানের খিচুড়ি ভার বয়ে নিয়ে এসেছিল। আর্টিলারির গোলা-গুলির মধ্যেই খিচুড়ির টুকরীগুলো বিভিন্ন প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছানো হয়।

২০ নভেম্বর ঈদের দিনে দুপুর ১টার দিকে পাকিস্তানিরা গোয়াইন ঘাট থেকে আসা গ্রাম্য সড়কপথকে আড়াল করে ব্যাপক আর্টিলারি এবং মর্টারের গোলার ফায়ার কভারে আমাদের ছাত্তার গ্রামের প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর এক ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করে। ধীরস্থির প্রকৃতির সুবেদার আলী আকবর ছিলেন ঐ এলাকার প্রতিরক্ষা কাজে নিয়োজিত। আমি ঐ সময় দুয়ারীখেল গ্রামের অবস্থানে বাংকারে বসে খিচুড়ি  খাচ্ছিলাম। তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে সুবেদার আলী আকবরের অবস্থানের উদ্দেশে রওয়ানা দিই। যাবার পথে ছিল সুবেদার বদির প্লাটুন। সুবেদার বদি এবং তার প্লাটুন থেকে দুটি সেকশনকে সাথে নিয়ে তড়িতে সুবেদার আলী আকবরের অবস্থানে পৌঁছি। একটি অবস্থান থেকে বাইনোকুলারের সাহায্যে দেখতে পাই যে রাস্তার ওপর দু’টি মেশিনগান স্থাপন করে তার ফায়ার কভারে পাকিস্তানিদের একটি বিশাল দল রাস্তাকে আড়াল করে দ্রুতগতিতে আমার ছাত্তার গ্রাম অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। সুবেদার বদিকে সুবেদার আলী আকবরের সাহায্যে রেখে আমি পিছনে দুয়ারীখেল গ্রামে ৩ ইঞ্চি মর্টার দু’টির অবস্থানে দৌড়ে পৌঁছে যাই। মর্টার দুটির স্থান কিছুটা পরিবর্তন করে দ্রুত অগ্রসরমাণ পাকিস্তানিদের ওপর গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করি। ওদিকে সুবেদার বদি এবং সুবেদার আলী আকবরের অবস্থানগুলি থেকেও গোলা নিক্ষেপ শুরু হয়। মুহূর্তেই পাকিস্তানিরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছু হটতে শুরু করে। সুবেদার বদি গ্রাম্য রাস্তার কভারে গোয়াইন সড়ক পর্যন্ত পাকিস্তানিদের ধাওয়া করে ফিরে আসেন।’

ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি করছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। ছবি: জয় বাংলা থেকে নেওয়া

ঈদের দিন উপলক্ষে বিশেষ বাণী দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি বলেন, ‘দেশের জনগণের দুর্দমনীয় সাহস ও সেনাবাহিনীর জেহাদী শক্তি আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার কবচ।’ সে সময় তিনি আরও বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত দেশপ্রেমিক সৈনিকদের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। একইসঙ্গে আহ্বান করি ভারতে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরে আসবেন। উদ্বাস্তুদের সকল প্রকার সহযোগিতা ও পুনর্বাসন করা হবে।’

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আবদুল মোতালেব মালিক ঈদের দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে ঈদের নামাজের আগে আগত মুসল্লিদের উদ্দেশে এক ভাষণে বলেন, ‘ঈদের শিক্ষার মাধ্যমেই আমরা জাতীয় সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। দেশরক্ষায় যুদ্ধরত যেসব সৈনিক তাদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে মিলিত হতে পারছেন না, তাদের এই ত্যাগ জাতি চিরদিন স্মরণ করবে। এদেশের এক শ্রেণির নেতারা জনগণকে বিপথে পরিচালনা করছে। জনগণের অধিকার আদায়ের নামে তারা জয় বাংলা ধ্বনি তুলছে, যা পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ও অখণ্ডতা বিপন্ন করে তুলছে।’

ঈদ উপলক্ষে সেদিন যুদ্ধে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের বেতন ও রেশন বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করে পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন। পাকিস্তান অবজারভারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানি কমান্ডারদের বেতন নির্ধারিত হয় ২৫৫ রুপি (রেশনসহ) আর রেশনছাড়া নির্ধারিত হয় ৩০০ রুপি। অন্যদিকে, প্লাটুন কমান্ডারদের রেশনসহ নির্ধারিত হয় ১৩৫ রুপি ও রেশনছাড়া ১৮৫ রুপি। সাধারণ রাজাকারদের জন্য ছিল ৭৫ রুপি থেকে ১২০ রুপি।

সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’য় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের বাণী। ছবি: জয় বাংলা থেকে নেওয়া

শহীদজননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঈদ নিয়ে। তিনি লিখেছেন, ‘আজ ঈদ। ঈদের কোনো আয়োজন নেই আমাদের বাসায়। কারো জামাকাপড় কেনা হয়নি। দরজা জানালার পর্দা কাচা হয়নি। বসার ঘরের টেবিলে রাখা হয়নি আতরদান। শরীফ, জামি ঈদের নামাজও পড়তে যায়নি। কিন্তু আমি খুব ভোরে উঠে ঈদের সেমাই, জর্দা রেঁধেছি। যদি রুমীর সহযোদ্ধা কেউ আজ আসে এ বাড়িতে? বাবা-মা-ভাই-বোন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কোন গেরিলা যদি রাতের অন্ধকারে আসে এ বাড়ীতে? তাদেরকে খাওয়ানোর জন্য আমি রেঁধেছি পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব। তারা কেউ এলে আমি চুপিচুপি নিজের হাতে বেড়ে খাওয়াবো। তাদের জামায় লাগিয়ে দেবার জন্য একশিশি আতরও আমি কিনে লুকিয়ে রেখেছি।’

তথ্যসূত্র:

একাত্তরের দিনগুলি— জাহানারা ইমাম

গেরিলা থেকে সম্মুখ যুদ্ধে— মাহবুবে আলম

একাত্তরের ঈদের এই দিনে— কর্নেল নুরুন্নবী খান (বীর বিক্রম)                                                                                                                                                      
সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ২৮তম সংখ্যা, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ২১ নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ নভেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম খণ্ড, একাদশ খণ্ড

কেমন ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ঈদের দিন?— আহমাদ ইশতিয়াকের ব্লগ (https://www.somewhereinblog.net/blog/AahmadIstiak/30155787)

Comments

The Daily Star  | English

Chattogram shoe factory fire under control

A fire that broke out at a shoe accessories manufacturing factory on Bayezid Bostami Road in Chattogram city this afternoon was brought under control after two hours.

2h ago