মুক্তমনা লেখক অনন্ত হত্যা: বিচারের অপেক্ষায় ৬ বছর

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে মুক্তচিন্তার ধারক লেখক-ব্লগার-প্রকাশকদের প্রকাশ্যে হত্যার এক ঘৃণ্য কার্যক্রম শুরু করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।
ananta-bijoy
অনন্ত বিজয় দাশ। ছবি: একুশ তাপাদার/স্টার

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে মুক্তচিন্তার ধারক লেখক-ব্লগার-প্রকাশকদের প্রকাশ্যে হত্যার এক ঘৃণ্য কার্যক্রম শুরু করে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম।

২০১৬ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা হত্যাযজ্ঞে নিহত হন আট জন মুক্তমনা ব্যক্তিত্ব, যার মধ্যে ২০১৫ সালে সাত মাসের ব্যবধানেই হত্যা করা হয় চার জনকে।

আজ বুধবার বিজ্ঞানমনস্ক-যুক্তিবাদী লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর। সেই ভয়াল ২০১৫ সালের এই দিনেই সিলেট শহরের সুবিদবাজার এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা হয় এই মুক্তমনা লেখককে।

এ হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ছয় বছর পর আজও অনন্ত বিজয় দাশের হত্যার বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন তার পরিবারের সদস্য, স্বজন, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলার ২৯ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আসামি ও সাক্ষীদের অনুপস্থিতি ছাড়াও সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বার বার পিছিয়ে যাচ্ছে সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ, বিলম্বিত হচ্ছে বিচার প্রক্রিয়া।

অনন্ত হত্যার দুই বছরের মাথায় ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন তার বাবা রবীন্দ্র কুমার দাশ। তার মা পিযুষ রাণী দাশও দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ এবং কিছুদিন আগে ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অনন্তর বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশও অসুস্থ এবং এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কথা বলতে অসম্মতি জানিয়েছেন।

অনন্ত বিজয়ের দুলাভাই সমর বিজয় শী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘অনন্তর মা, ভাই, বোনসহ স্বজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রতীক্ষায় আছি।’

২০১৫ সালের ১২ মে সকালে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য বোন পঞ্চত্রপা দাশকে সঙ্গে নিয়ে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার নুরানি আবাসিক এলাকার বাসা থেকে গলি ধরে প্রধান সড়কের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্র নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন হামলাকারী।

এলাকার দস্তিদার বাড়ি দিঘীর পাড়ে বোনের সামনেই কুপিয়ে তাকে হত্যা করে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা। পরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়।

সে রাতেই সিলেটের বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন অনন্ত বিজয় দাশের ভাই রত্নেশ্বর দাশ। মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে থানা পুলিশের কাছে থাকলেও পরে পুলিশ সদরদপ্তরের নির্দেশের পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।

তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি’র পরিদর্শক আরমান আলী ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর আদালতে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করলে আদালত পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর পুনরায় তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ৯ মে সম্পূরক অভিযোগপত্র দিলে আদালত তা গ্রহণ করেন।

এ অভিযোগপত্রে অনন্ত বিজয় দাশ হত্যায় অভিযুক্ত করা হয় শফিউর রহমান ফারাবী, মান্নান ইয়াহইয়া ওরফে মান্নান রাহী, আবুল খায়ের রশীদ আহমেদ, আবুল হোসেন ওরফে আবুল হুসাইন, হারুনুর রশীদ এবং ফয়সল আহমেদকে।

এদের মধ্যে ফারাবী এবং আবুল খায়ের জেলে। অভিযুক্ত মান্নান, যে এই মামলায় দণ্ডবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তিনি ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। মামলার বাকি তিন আসামি এখনো পলাতক।

মামলার বিচার প্রাথমিক অবস্থায় কয়েক বছর সিলেটের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পরিচালিত হলেও পরে সিলেটে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০২০ সালের শুরুর দিকে মামলাটি এই ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

অনন্ত বিজয় হত্যাকাণ্ডে বাদীপক্ষের আইনজীবী এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মামলাটি বিশেষ এই ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর পর অনেকটা গতি পেয়েছে, তবুও এখনো নানা কারণে মামলার তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক লকডাউনে আদালতের কার্যক্রম স্থগিত থাকার কারণে দুটি তারিখ পিছিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ঈদের পর লকডাউন শিথিল করা হলে আদালত আবারও সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য নতুন দিন ধার্য করবেন। আমরা আশাবাদী কয়েক মাসের মধ্যেই এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হবে এবং দ্রুতই ট্রাইব্যুনাল প্রকাশ্যে এ ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে অনন্ত বিজয়ের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন।’

রবীন্দ্র কুমার দাশ ও পীযূষ রানী দাশের দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে সবার ছোট অনন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর পূবালী ব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগ দেন।

সিলেটে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা অনন্ত ‘মুক্তমনা’ ব্লগে লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন অনলাইনে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ও যুক্তিনির্ভর লেখালেখি করতেন।

সিলেট থেকে প্রকাশিত বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘যুক্তি’ সম্পাদনা করতেন অনন্ত বিজয়। তার লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে— ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়’, ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ’ ও ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’।

অনন্ত হত্যার এক বছর পর, তার হত্যার স্থানে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। এরপর থেকে প্রতিবছর এ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেই অনন্ত বিজয়কে স্মরণ করেন তার বন্ধু-শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

প্রতি বছরের মতো এ বছরও অনন্ত বিজয় দাশ স্মরণে আজ বিকেল ৩টায় এ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন তারা।

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at shoe factory in Ctg

A fire broke out at a factory that produces shoe accessories on Bayezid Bostami Road in Chattogram city this afternoon

1h ago