কেন এই বিষোদগার?

কবরী অভিনীত সিনেমা দেখেননি, বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ আছেন বলে আমার জানা নেই। বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা, যারা বাংলা সিনেমা দেখে না, তারা অন্তত তার নাম শুনেছেন। তিনি দেশ সেরা তারকা, মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য, পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। মিতা হক একুশে পদকপ্রাপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সারাটা জীবন গান নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। আর একটি কন্যা শিশুর জন্ম দিয়ে চলে গেলেন ৭১ টেলিভিশনের তরুণ সহযোগী প্রযোজক রিফাত সুলতানা। রেখে গেছেন আরও দুই অবুঝ শিশু। এই তিন জনই মারা গেলেন করোনায়।

কবরী অভিনীত সিনেমা দেখেননি, বাংলাদেশে এমন কোনো মানুষ আছেন বলে আমার জানা নেই। বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা, যারা বাংলা সিনেমা দেখে না, তারা অন্তত তার নাম শুনেছেন। তিনি দেশ সেরা তারকা, মুক্তিযোদ্ধা, সংসদ সদস্য, পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। মিতা হক একুশে পদকপ্রাপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। সারাটা জীবন গান নিয়ে কাটিয়ে দিলেন। আর একটি কন্যা শিশুর জন্ম দিয়ে চলে গেলেন ৭১ টেলিভিশনের তরুণ সহযোগী প্রযোজক রিফাত সুলতানা। রেখে গেছেন আরও দুই অবুঝ শিশু। এই তিন জনই মারা গেলেন করোনায়।

তিন জন নারী চলে গেলেন চিরতরে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুটিকতক মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল নোংরা কথার ঝুড়ি নিয়ে। কবরীর অপরাধ তিনি সিনেমা করতেন। মিতা হকের অপরাধ তিনি টিপ পরে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন। আর রিফাতের অপরাধ তিনি ৭১ টেলিভিশনে কাজ করতেন। কাজেই তারা সবাই ভয়াবহ গর্হিত কাজ করেছেন।

অবাক হয়ে দেখলাম মানুষ কীভাবে করোনায় তাদের চলে যাওয়াটাকে আল্লাহর ‘গজব’ বলে আখ্যায়িত করছেন। বিশ্বে কয়েক লাখ মানুষ করোনায় চলে গেলেন। কত পরিবার সর্বশান্ত হয়েছে। এই তিন জন নারীর মৃত্যু নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত, রুচিহীন ও অশ্লীল মন্তব্য আমাকে ‘আবারও’ ব্যথিত করলো।

‘আবারও’ শব্দটা এই জন্য ব্যবহার করলাম যে ২০১৮ সালে যখন প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে চলে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী, তখনও দেখেছি অনলাইনে প্রকাশিত তার মৃত্যুর খবরের নিচে অজস্র কদর্য ও রুচিহীন মন্তব্য। বাদ পড়লেন না ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনীর মতো নির্মল মনের একজন মানুষ, একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। অনেকেই তার মৃত্যুর খবরের নিচে হাসির প্রতীক ব্যবহার করেছেন। কেউ লিখেছেন, তাকে বাঁশ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে। কেউ মনে করেন, ফেরাউনের মৃত্যু হয়েছে। লিখেছেন, নাস্তিক নারী, তার জানাজা কেন পড়ানো হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ভালো ও সুখকর মন্তব্যও অনেক আছে।

অনেকের হয়তো মনে হতে পারে, কেন আমি আলাদা করে খবরের চেয়ে খবরের নিচের মন্তব্যের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি? হ্যাঁ, আমি এখন অনেক খবরের বা নিবন্ধের নিচে এই মন্তব্যগুলো দেখি। আর বোঝার চেষ্টা করি, আমার চারপাশের মানুষ কীভাবে বিকৃত মন-মানসিকতার ধারক ও বাহক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কতটা রুচিহীন কথা তারা লিখতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, গণমাধ্যমে।

যারা এসব লিখছে, তারা এদেশের মানুষ। আপনার আমার পরিচিত, আত্মীয় বা প্রতিবেশী। এই ধরনের নোংরা মনের মানুষগুলোর সংখ্যা অল্প নয়, বরং অনেক বেশি। তাদের অধিকাংশই ভুল বানানে, আঞ্চলিক ভাষায়, ভুল বা মিসলিডিং তথ্য দিয়ে লিখে যাচ্ছেন। যা দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, তারা অশিক্ষিত ও বেয়াদব এবং নোংরা মানসিকতার।

অনেকে মনে করেন, তারা আর সমাজের কয়টা মানুষ? তাদের পাত্তা দেয়া উচিত না। পাত্তা না দিতে পারলে আমার চেয়ে সুখী কেউ হতো না। কিন্তু পারছি না। তারা মিতা হক, কবরী এবং রিফাতকেও ছাড়লো না। এই অসভ্যগুলো কি জানে যে কবরী সারাজীবন তার মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তানকে আগলে রেখেই সব দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মিতা হক বুকে করে জড়িয়ে রেখেছিলেন তার একমাত্র ছোট ভাই রাজনকে। যে রাজন একজন অসুস্থ মানুষ। মিতা হক ছাড়া যার কোনো আশ্রয় নেই।

জাফর ইকবাল স্যার যেদিন করোনা পজিটিভ বলে খবর এলো, সেদিনও ঠিক একইভাবে বিভিন্ন কুৎসিত মন্তব্যের ঝড় বয়ে গেছে। স্যারকে নাস্তিক, শিক্ষাগরু নামে ডেকেছেন তারা।

আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি, মানুষের এই বিবেকহীনতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখে। আতংকিত বোধ করছি এসব পিশাচ মৌলবাদীদের উত্থান দেখে। আমরা পাত্তা না দিতে দিতে বা ভয় পেতে পেতে এদের সংখ্যা এখন অগণিত। ফেসবুকে ভালো কমেন্টের চেয়ে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল কমেন্ট অনেক বেশি। নারী অধিকারের ইস্যুতে কোনো লেখা ছাপা হলে, বুঝে- না বুঝে বাজে মন্তব্য করতেই থাকে।

যে কোনো মানুষের তার নিজস্ব মত প্রকাশের অধিকার আছে, মন্তব্য করারও অধিকার আছে। কিন্তু তাই বলে যা ইচ্ছা তাই লিখবে, নোংরা কথা লিখবে, সাম্প্রদায়িকতা ছড়াবে? তাদের এসব ঘৃণ্য মন্তব্য একথাই প্রমাণ করে যে তারা লুকিয়ে থাকা হামলাকারী। যে কোনো সময় তারা থাবা বসাবে এবং বসিয়েছেও। কাজেই তাদের সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। এই শ্রেণিটি এতটাই অসহিষ্ণু হয়ে গেছে যে সাধারণ মানুষের অসাম্প্রদায়িক, মুক্তমনা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো লেখাই তারা সহ্য করতে পারেন না।

ভারতীয় নায়িকা শ্রীদেবীর মৃত্যুর পর ‘ভিসিআর যুগের’ এই নায়িকাকে নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী লেখা ছাপা হলো। শ্রীদেবীর সিনেমা দেখে সবাই, কিন্তু অসংখ্য বাজে মন্তব্য জমা হলো শ্রীদেবী ও লেখককে গালি দিয়ে। আমি নিশ্চিত যে এদের অনেকেই এখনও ভারতীয় সিনেমা দেখে, সিরিয়াল দেখে, নায়ক-নায়িকার অঙ্গভঙ্গি দেখে, চিকিৎসা নেয়, বেড়াতে যায়, ভারতীয় গরুর মাংস খায় এবং পণ্য ব্যবহার করে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরণের মন্তব্য একধরনের অপরাধমূলক কাজ। দেশের বর্তমান আইনের আওতায় তাদের শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু তাদের শাস্তির ব্যাপারে কখনো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর হতে দেখিনি, যতোটা তৎপর মুক্তমনা ব্লগার আটকের ব্যাপারে।

 অনলাইনগুলো এবং সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে যেসব মন্তব্য আসছে, সেগুলোরও এডিটিং ও গেট কিপিং জরুরি হয়ে পড়েছে। জানি না তারা কোন পদ্ধতিতে এটা করবেন, কিন্তু করতে হবে। তারা হিংসা ও দ্বেষ ছড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছেন এই মন্তব্যের স্থানটিকে।

শেষপর্যন্ত এটাও দেখলাম, ভারতে করোনায় প্রতিদিন সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যুতে এই গ্রুপটা উল্লাস করছে। বলছে, হিন্দুদের শাস্তি হচ্ছে। শ্মশানের আগুন দেখে বলছে, দোযখের আগুন। কতটা ঘৃণ্য মানসিকতার হলে এমন মন্তব্য করতে পারে। তাদের চোখে পড়েনি, ভারতে করোনা রোগীদের থাকার জন্য মসজিদ খুলে দেওয়া হয়েছে?

কবে এই অমানুষগুলো বুঝবে, মানি মানুষের মান এভাবে গালাগালি করে নষ্ট করা যায় না। কবে কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে সুর তুলে বলবে, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Secondary schools, colleges to open from Sunday amid heatwave

The government today decided to reopen secondary schools, colleges, madrasas, and technical education institutions and asked the authorities concerned to resume regular classes and activities in those institutes from Sunday amid the ongoing heatwave

18m ago