সমন্বয়হীনতার দেশে লকডাউন ও মুভমেন্ট পাস

ট্রাফিক সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা আর ট্রাফিক লাইটের সংকেত একটা আরেকটার সঙ্গে মেলে না। কেন বলুন তো? গাড়িচালক সহকর্মীর এমন প্রশ্ন শুনে উল্টো প্রশ্ন করেছিলাম, কেন? তিনি বলেছিলেন, বাতি জ্বালায় সিটি করপোরেশন আর হাত তোলে পুলিশ। দুই জনের মধ্যে কোনো মিলমিশ (সমন্বয়) নেই।
বিমানবন্দর সড়কে যানজটের চিত্রটি ১৫ এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে তুলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের আলোকচিত্রী আনিসুর রহমান।

ট্রাফিক সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা আর ট্রাফিক লাইটের সংকেত একটা আরেকটার সঙ্গে মেলে না। কেন বলুন তো? গাড়িচালক সহকর্মীর এমন প্রশ্ন শুনে উল্টো প্রশ্ন করেছিলাম, কেন? তিনি বলেছিলেন, বাতি জ্বালায় সিটি করপোরেশন আর হাত তোলে পুলিশ। দুই জনের মধ্যে কোনো মিলমিশ (সমন্বয়) নেই।

সমন্বয়ের এই সংকট আমাদের নাগরিক জীবনের সবখানেই। গ্যাস কোম্পানি রাস্তা খুঁড়ে রাখে, ওয়াসা রাস্তা খুঁড়ে রাখে; অথচ রাস্তার মালিক সিটি করপোরেশন। আজ যে রাস্তা ঝকঝকে কার্পেটিং করা হলো, মাসখানেক বাদেই সেই রাস্তা খুঁড়ছে সরকারেরই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান। অথচ দুটো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় থাকলে খোঁড়াখুঁড়ির কাজটা আগে করে পরে কার্পেটিংটা করা যেত।

লকডাউন-বিষয়ক ঘোষণা ও তারপর একের পর এক সম্পূরক ঘোষণা মিলে সাধারণ নাগরিকেরা বিভিন্ন বিষয়ে এখন বিভ্রান্ত। সরকার একটি সার্বিক নির্দেশনা যদি একবারে জনগণের সামনে পেশ করত, তাহলে তাদের জন্য সেটা মেনে চলা সহজ হতো। কিন্তু, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ভিন্ন ভিন্ন ঘোষণা ও নির্দেশনা দেওয়ায় চূড়ান্তভাবে কোন বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, কী কী নির্দেশনা নাগরিকদের মেনে চলতে হবে, সেটা মনে রাখা নাগরিকের জন্যে কঠিন হয়ে গেছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে, এরকম কথা বলা ছিল। কিন্তু, তার বদলে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে আগেই সেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে সেগুলোকে সমন্বয় করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি সার্বিক নির্দেশনা দিতে পারত।

এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে ‘মুভমেন্ট পাস’। পুলিশ মহাপরিদর্শকের ভাষায় নাগরিকদের ‘অপ্রয়োজনীয় ও অনিয়ন্ত্রিত’ যাতায়াত বন্ধ করতে এই ব্যবস্থা। উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নেই। কিন্তু, বিপত্তি বাধল অন্য যায়গায়। খোদ পুলিশের সদস্যরাও ঠিকমতো জানলেন না কার কার মুভমেন্ট পাস লাগবে আর কার কার লাগবে না। কোভিড চিকিৎসককে জরিমানা করা ও পরবর্তীতে সেই টাকা ফেরত দেওয়ার ঘটনা সবাই জানি। সবাই জানি না এরকম ঘটনা নিশ্চয়ই আরও অনেক ঘটেছে।

‘এরই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে বিধিনিষেধের আওতামুক্ত ব্যক্তি কারা ও প্রতিষ্ঠান কোনগুলো।’ (প্রথম আলো, ১৫ এপ্রিল ২০২১)। এই রিপোর্টেই জানানো হচ্ছে, ‘চেকপোস্টে যেসব পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্রিফিং করার জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধ করা হয়েছে’।

সেই তালিকাতেও কিন্তু টিকাগ্রহণকারী ব্যক্তির চলাচলে মুভমেন্ট পাস লাগবে না এটা পরিষ্কার করে বলা নেই। হয়তো তালিকার চার নম্বরের ‘কোভিড টিকা/চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি/স্টাফ’ কথাটার মধ্যে এটা কাভার করা হয়েছে। যদিও শব্দের ব্যবহারে এটা সেবাদানকারীকে যতটা বোঝায়, সেবাগ্রহণকারীকে ততটা বোঝায় না। সরকারের প্রথম ঘোষণায় ‘টিকাগ্রহণকারী কার্ডসহ টিকা নিতে বাসার বাইরে যেতে পারবে’ এটা বলা ছিল। কিন্তু, মুভমেন্ট পাসের ওয়েবসাইটে বাসার বাইরে যাওয়ার কারণের ঘরে টিকা নিতে যাওয়াকে ড্রপ-ডাউন মেন্যুতে একটি অপশন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে সহজেই মনে হতে পারে, টিকা নিতে যাওয়ার জন্যে এই পাস লাগবে। এই দ্বিধায় পড়ে গতকাল অনেক টিকাগ্রহণকারী পাস সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন।

বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ মানুষ টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিচ্ছেন; আরও প্রায় ৫০ হাজার মানুষ টিকার প্রথম ডোজ নিচ্ছেন (দ্য ডেইলি স্টার; ১৬ এপ্রিল ২০২১)। তার মানে লকডাউনের সাত দিনে ১০ লাখ মানুষের টিকা নেওয়ার তারিখ পড়বে এবং প্রত্যেককে এই বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। মুভমেন্ট পাসের বিষয়টা পরিষ্কার করলে এই ১০ লাখ মানুষ উপকৃত হবেন।

গতকাল সকাল পর্যন্ত মুভমেন্ট পাসের ওয়েবসাইটে ১৬ কোটি হিট হয়েছিল। যদিও আবেদনের সংখ্যা এর তুলনায় অনেক কম— চার লাখের মতো। ওয়েবসাইটে হিটের সংখ্যা ও আবেদনের সংখ্যার এই পার্থক্যের কারণ এমন নয় যে মানুষ প্রয়োজন না থাকলেও কৌতূহলবশত এই সাইটে ঢুকছে। বরং এর একটা বড় কারণ, ওয়েবসাইটে একবার বা দুইবার ঢুকে কাজটি সেরে বেরোনো সম্ভব হচ্ছে না। একই মানুষকে অনেকবার চেষ্টা করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ পুলিশের মতো একটি দায়িত্বশীল সংস্থা একটি সার্ভিস চালু করার আগে কোনো বাস্তবসম্মত সমীক্ষা করবে না, এটা বিশ্বাস করা যায় না। দেশব্যাপী লকডাউনের মধ্যে প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় যদি হয় এই পাস সংগ্রহ, তাহলে কী পরিমাণ লোক আবেদন করতে পারে, সেটাকে সামাল দেওয়ার জন্যে কী পরিমাণ প্রযুক্তিগত ও জনবল সামর্থ্য দরকার, সেটা আরও একটু বিবেচনায় নিয়ে এরকম একটি সার্ভিস চালু করলে  জনভোগান্তি কম হতো। প্রতি মিনিটে গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ ওয়েবসাইটে হিট করেছেন। অধিকাংশই বারবার চেষ্টা করেও আবেদন প্রক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি। কেউ কেউ হয়তো সারাদিন রোজা রেখে ইফতারের পর বসে এই প্রায়-অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

সরকারেরই দুটো মন্ত্রণালয়— স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসএমএস করে ডাকছে, টিকা নিতে অমুক তারিখে, অমুক জায়গায় আসুন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, অন্য যেই ডাকুক, বাইরে বেরোতে গেলে আমার অনুমতি লাগবে।

বেরোনোর অনুমতির ফয়সালা মন্ত্রণালয় পর্যায়ে হলে ব্যক্তিপর্যায়ে এই কষ্ট আর থাকে না। বেরোনোর অনুমতি নিশ্চিত করে তারপর যদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসএমএস দেয়, তাহলেই তো সমস্যাটা আর হয় না। অথবা টিকা নেওয়ার আমন্ত্রণের এসএমএস আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাসা থেকে বেরোনোর অনুমতি দিয়ে আরেকটি এসএমএস পাঠানো যেত। এর জন্যে দরকার ছিল দুটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়। রাষ্ট্র যে সমস্যা এক জায়গা থেকে সমাধান করতে পারত, লাখো নাগরিককে লাখো জায়গায় বসে সেই সমস্যায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষত যে ১৮ শ্রেণির মানুষের চলাচলে মুভমেন্ট পাস প্রয়োজন নেই বলে ঘোষণা করা হলো, সেখানেও বিষয়টি খুব পরিষ্কার নয়।

আরেকটি বিকল্প ছিল টিকা নেওয়ার জন্যে যাতে কাউকে বেরোতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করা। করোনার টিকা তো অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস এবং সরকার একাই এই সার্ভিস দিচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে যাদের টিকার তারিখ পড়ছে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারত সরকার। যদিও স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর বর্তমান যে চাপ, তাতে এই আশা করাটা খুব দুরাশা হবে।

ঘর থেকে বেরোনোর অনুমতি পেতে গেলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে। এটা এক ধরনের ডিজিটাল ডিভাইডের সৃষ্টি করছে সন্দেহ নেই। সমাজের অপেক্ষাকৃত সুবিধাপ্রাপ্ত ও লেখাপড়া জানা মানুষেরাই সরকারের এই সেবা নিতে পারবেন। প্রান্তিক, দরিদ্র মানুষ এই সেবা কীভাবে নেবেন? ধরা যাক, পরিবারের একজন রিকশাচালক, আরেকজন গৃহকর্মী। থাকেন বস্তিতে। তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে মুভমেন্ট পাস নিতে পারবেন, এমনটা আশা করাটা একটু বেশি প্রত্যাশা হয়ে যাবে। প্রান্তিক মানুষের জন্যে একটা বিকল্প রাখা দরকার ছিল।

প্রান্তিকে প্রতিদিন আয় করে সংসার চালানো মানুষের জন্যে এবার অবশ্য সরকার তেমন কোনো সহায়তাও দিচ্ছে না। গতবছর সরকার সেটা করেছিল। সমাজের অপেক্ষাকৃত সক্ষম মানুষেরাও করেছিলেন। অপরাধীকেও যদি রাষ্ট্রের নির্দেশে ঘরের মধ্যে বন্দি থাকতে হয়, তার খাওয়া-পরার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেয়। একেবারে গরিব মানুষের জন্যে এই কয়টা দিনের খাবারের দায়িত্ব কি রাষ্ট্র নিতে পারত না?

তাপস বড়ুয়া, প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর, এথিক্যাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই); গার্মেন্টস সেক্টরে কোভিড রেসপন্স প্রজেক্টে কাজ করছেন

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

আরও পড়ুন:

করোনাকালে সচল: গার্মেন্টস খাত থেকে শেখার আছে

আবার লকডাউন: এবার দায় দেবো কাকে?

Comments

The Daily Star  | English

Our civil society needs to do more to challenge power structures

Over the last year, human rights defenders, demonstrators, and dissenters have been met with harassment, physical aggression, detainment, and maltreatment by the authorities.

8h ago