জাদুঘর থেকে চিত্রকলাকে যিনি পৌঁছে দিলেন মধ্যবিত্তের অন্দরে

চিত্রকলাকে জাদুঘরের দেয়াল থেকে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন মধ্যবিত্তের ঘরে। শিল্পের রস, শিল্পবোধ, আর শিল্পানুরাগী মন যে কেবল উচ্চবিত্তের জন্যই নয় তিনিই বাঙ্গালীকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। বাংলার বিখ্যাত লোকচিত্র কালীঘাট পটচিত্র শিল্পকে তিনিই বিশ্বনন্দিত করে তুলেছিলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাকে সম্বোধন করতেন "শিল্পের দেবতা" বলে।
শিল্পে আত্মমগ্ন যামিনী রায়। ছবি: সংগৃহীত

চিত্রকলাকে জাদুঘরের দেয়াল থেকে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন মধ্যবিত্তের ঘরে। শিল্পের রস, শিল্পবোধ, আর শিল্পানুরাগী মন যে কেবল উচ্চবিত্তের জন্যই নয় তিনিই বাঙ্গালীকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন। বাংলার বিখ্যাত লোকচিত্র কালীঘাট পটচিত্র শিল্পকে তিনিই বিশ্বনন্দিত করে তুলেছিলেন।  শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন তাকে সম্বোধন করতেন "শিল্পের দেবতা" বলে।

চিত্রশিল্পী যামিনী রায়। জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বেলিয়াতোড়ে ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল এক মধ্যবিত্ত জমিদার পরিবারে। তার বাবা রামতরণ রায় নিজেও ছিলেন শিল্প অনুরাগী। মা নগেন্দ্রমালা দেবী। তার বাবা রামতরণ রায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু শিল্পকর্ম আর কৃষকের জীবন যাপন করবেন বলে। ইংরেজি জানা, ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া রামতরণ রায় গ্রামে ফিরে তুলা চাষ শুরু করলেন। নিজের হাতে তুলা থেকে সুতা তৈরি করে গ্রামের কারিগরদের দিয়ে ধুতি শাড়ি তৈরি করতেন। শৈশবেই যামিনী রায়ের মধ্যে শিল্পী সত্ত্বার ছাপ পড়েছিল। শৈশবে তার শিল্পবোধ গড়ার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তার বাবা। তার বাবাই মূলত তাকে আঁকতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাইতো ছোটবেলায় ঘরের মেঝে থেকে, ঘরের দেয়াল, মাটির পাত্র কোনকিছুই বাদ যেতো না তার আঁকাআঁকি থেকে। সবচেয়ে উৎসবের মুহূর্ত হতো দুর্গাপূজার সময়। অবস্থাসম্পন্ন প্রায় সব ঘরেই দুর্গাপূজার ঠাকুর তৈরি হতো। প্রতিমা শিল্পীরা আসতেন ঠাকুর গড়ার কাজে। প্রতিমা শিল্পীদের হাতের নিখুঁত কাজ ভীষণ আগ্রহের সঙ্গে বুঁদ হয়ে দেখতেন যামিনী রায়। কেবল নিজ বাড়িই নয়, আশপাশের বাড়িতে যেতেন ঠাকুর তৈরির দৃশ্য দেখতে।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যামিনী রায়। ছবি: সংগৃহীত

শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ নজর কেড়েছিল জেলা প্রশাসকের। তিনিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তাকে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ভর্তি হতে। যামিনী রায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে বেলিয়াতোড় থেকে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। সেই সময় ওই প্রতিষ্ঠানের ভাইস-প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন কিংবদন্তী শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজেই ‘ক্লাসিকাল আর্ট ফর্ম’ নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন যামিনী রায়।

সে সময় তার বড় ভাই কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন, বিলাসী জীবন। অথচ তিনি ভাইয়ের বাড়িতে উঠলেন না। বিলাসী জীবনের মায়া ত্যাগ করে উত্তর কলকাতায় ভাড়া নিলেন একটি ঘর। রুটিরুজির জন্য কতো কিছুই না করতে হয়েছিলো তাকে। ইহুদি ব্যবসায়ীর অর্ডারি কার্ড এঁকেছেন। ১০০ কার্ড আঁকলে ১০ থেকে ১২ আনা পেতেন। সেই টাকায় এক প্লেট ভাত পাওয়া যেত। উত্তর কলকাতারই এক বাড়িতে বসে  লিথোগ্রাফির কাজ করেছেন। কলকাতার শ্যামবাজারের কাপড়ের দোকানে বিক্রয়কর্মীর কাজ করেছেন। শাড়ি কেনাবেচা করতে গিয়ে রং নিয়ে দারুণ এক ধারনা তৈরি হয়েছিলো তার। উপার্জনের জন্য কতো বিচিত্র কাজই না করতে  হয়েছিলো তাকে। ততোদিনে শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় শিষ্য হয়ে গেলেন। আর্ট স্কুলের দেওয়ালে তার আঁকা বহু ছবি টাঙানো। ছাত্র থাকাকালীন সময়েই অবনীন্দ্রনাথ তাকে পাঠিয়েছিলেন জোড়াসাঁকো়য় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোর্ট্রেট আঁকতে!

ভাইস-প্রিন্সিপাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছাত্র যামিনী রায় ইউরোপীয় শিল্পরীতির অনুসরণে পোর্ট্রেট, ক্ল্যাসিকাল ন্যুড, তেলরং-ছবি আঁকেন মন দিয়ে। সাহেব প্রিন্সিপাল একদিন ক্লাসে এসে দেখেন, যামিনী ক্লাস না করে জানালার খড়খড়ি তুলে চৌরঙ্গির বহমান জীবন দেখছেন। "এভাবে সময় নষ্ট করছ কেন?" প্রশ্ন প্রিন্সিপালের।

"ক্লাসে প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে হবে, কিন্তু বাইরের দৃশ্য তো বিরাট বিশাল, তাই তাকে এই খড়খড়ির ফ্রেমে আটকে দেখছি!" 

ইতালীয় এক শিক্ষকের ক্লাসে ছাত্রদের প্লাস্টার মডেল নকল করতে হতো। ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ হতো নিচু বেঞ্চি, আর লম্বা সাহেব শিক্ষক টহল দিতে দিতে "এটা হয়নি, ওটা হলো না" এমন  মন্তব্য করতেন। যামিনী রায় এক দিন সটান বললেন, "আপনি দাঁড়িয়ে ওই উচ্চতা থেকে সব দেখছেন আর আমরা ড্রয়িং করছি নিচু বেঞ্চিতে বসে। দু’তরফের দেখা দু’রকম, আমরা কী করে আপনার দেখাটা দেখব?"

যামিনী রায়ের আঁকা কালীঘাটের পটচিত্র ‘গনেশ ও জননী দূর্গা’। ছবি: সংগৃহীত

১৯০৮ সালে চিত্রকলায় ডিপ্লোমা পাশ করার পরে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘পোর্ট্রেট ড্রয়িং’-এর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। সেখানে স্বল্প পারিশ্রমিকে দিন একরকম কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু যামিনী অনুভব করলেন, কোথাও যেন একটা শূন্যস্থান রয়ে যাচ্ছে। ঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে থমকে রয়েছে তার নিজস্ব সৃষ্টি।

বেলিয়াতোড় গ্রামের আশেপাশেই ছিল সাঁওতাল আদিবাসীদের বসবাস। যামিনী রায় ১৯২১ থেকে ১৯২৪ এর মধ্যকার সময়ে নতুন এক গবেষণা চালালেন সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে। তাদের জীবনাচারকে তিনি তুলির রঙে নতুন করে দেখবেন বলে ঠিক করলেন। সেখানে স্থান পেল সাঁওতাল নারীদের নাচ, পরিবার, জীবনযাপনের দৃশ্যসহ দৈনন্দিন জীবনের রূপ।

প্রথম দিকে  বিদেশি ভাবধারায় ছবি আঁকতেন যামিনী রায়। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ দেশীয় তথা গ্রামবাংলার প্রতিরূপ তার ছবিতে ফুটে উঠেছে। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তার লক্ষ্যে তিনি লোক ও নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতি বেছে নেন। তিনি খেয়াল করেছিলেন এদেশে পাশ্চাত্য চিত্রকলা পড়ানো হয়, পাশ্চাত্য চিত্রকলা ও ধারার চর্চা হয় কিন্তু আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব রীতি, স্বকীয়তা। পাশ্চাত্যে তো এই ধারার চর্চার কথা অকল্পনীয়। সেই থেকেই নিজের মধ্যে স্বদেশপ্রীতি ও নিজস্ব রীতির প্রতি গভীর অনুরাগ জন্ম নিয়েছিল যামিনী রায়ের মধ্যে। তিনি ভাবলেন তিনি কাজ করবেন নিজস্বতা নিয়ে, কাজ করবেন এই দেশের মাটি ও মানুষ নিয়ে, যা সর্বক্ষেত্রে চিত্রকর্মে অবহেলিত।

নিজস্ব বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাবধারার জন্য তিনি গর্বিত ছিলেন। তিনি বহুবার বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ পেলেও কখনও বিদেশে যাননি। বলতেন, "আমরা গরিব দেশের মানুষ, এত পয়সা খরচ করে ওদের দেশে যাব কেন? ওদের অনেক পয়সা, ওরা এসে আমাদেরটা দেখে যাক।"

১৯২৫ সালের কাছাকাছি সময় একদিন  কলকাতার কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে ঘুরছিলেন যামিনী রায়। কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ পটচিত্রগুলোর উপরে চোখ পড়ল তরুণ শিল্পী যামিনী রায়ের। কালী চরিত্র এবং কাহিনি তুলির টানে, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। যেন ধাক্কা খেলেন  তিনি। ‘ইম্প্রেশনিজম’ এবং ‘কিউবিজম’-উত্তর সময়ে শিল্পের এই সারল্য তাকে মুগ্ধ করল। খুঁজে পেয়েছিলেন, যা খুঁজছিলেন এত দিন ধরে। কালীঘাটের মন্দিরে যেসব তীর্থযাত্রী ও ভক্তরা আসতেন তারা ফেরার পথে কালীঘাটের স্মৃতিজাতীয় কোন বস্তু বনিয়ে যেতেন। এই ক্ষেত্রে তাই একসময় ধীরে ধীরে নতুন এক ধারার চিত্রকলার জন্ম হলো। মূলত এই ধরনের চিত্রকলায় দেখা যেত পৌরাণিক কোন চরিত্র, পশুপাখি, মাছ, ধর্মীয় নানান বস্তুসহ ভক্তিমূলক নানা বাণী। মূলত স্থানীয়রা এই ধরনের চিত্রকর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলেই এই ধারাকে কালীঘাটের চিত্রকলা নামে ডাকা হতো। হঠাৎ চিরচেনা এক  পথের সন্ধান পেয়ে গেলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলার লোকশিল্পকেই পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করবেন। তার এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বঙ্গশিল্প জগতের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক খুলে গেল।

যামিনী রায়ের আঁকা ‘ঘোড়া ও সরোয়ারী’। ছবি: সংগৃহীত

প্রথম দৈনন্দিন জীবন দেখা দিলো শিল্পীর তুলিতে, দ্বিতীয়ত শিল্পকর্ম পৌঁছে গেল মধ্যবিত্তের অন্দরে, আর তৃতীয়ত পুনরুজ্জীবিত হলো বাংলার লোকশিল্প।

যামিনী রায় যে কেবল এই কালীঘাটের পটচিত্র নিয়ে কাজ করেছেন তা কিন্তু নয়, বরং উড়িষ্যা, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, গুজরাট বীরভূম, বর্ধমান থেকে প্রচুর পট সংগ্রহ করেছিলেন যামিনী রায়।

চিত্রশিল্পকে জাদুঘরের দেওয়াল থেকে মধ্যবিত্তের গৃহস্থালিতে পৌঁছে দেওয়ার কারিগর যামিনী রায়।

যামিনী রায় বলতেন, ‘আমি পটুয়া’। তার ছবিও পটুয়া শৈলির। তার কোনও নির্দিষ্ট পটুয়া ঘরানা নেই। ছবির চরিত্র শান্ত, কোমল। বিষয় কোথাও পুরান, কোথাও লোকসামাজিক জীবন। যামিনী রায় যেন এক নীরব বিদ্রোহ।

ইউরোপীয় পদ্ধতিতে ও চিন্তনে আর কত কাল ভারতীয় চিত্রশিল্প আটকে থাকবে? যেখানে ভারত নিজস্ব চিন্তন ও দর্শনে সমৃদ্ধ। অবলীলায় ইউরোপীয় সাহচর্য ছেড়ে ফিরলেন শিকড়ের টানে। নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূলে। তবে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে দেখা সেজান, গগ্যাঁ, ভ্যান গগদের ছবির প্রভাব রয়ে গেল অন্তরে।

তার নব অনুরাগ বাংলার লোকশিল্পে, সংস্কৃতিতে, লোকপুরাণে। লোকজ ছন্দ ও স্পন্দনে। ছবির ধারণা ও উদ্ভাবনায় বাংলার সাধারণ সমাজের ধর্ম, আচরণ, শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস উপজীব্য হল। তার ছবির ফ্রেমে বাংলার উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ, প্রাকৃতিক জগৎ ধরা পড়ল। তবে এ সব তিনি মূলত খুঁজে পেলেন বাংলার পটচিত্রে। বাংলার নিজস্ব ধরন, জীবন যাপন, বেলিয়াতোড়ের সাঁওতাল, বিষ্ণুপুরী টেরিকোটায় পটুয়াপাড়ার চিত্র উঠে এলো তার শিল্পে। রামায়ণ, মহাভারত, বৈষ্ণব অনুরাগ, মনসা মঙ্গল, মঙ্গলকাব্য যেন ফিরে এলো তার চিত্রকলায়।    

বাঁকুড়ার পটচিত্রে ধর্ম, ধর্মচিহ্ন, বৈষ্ণব অনুরাগ, রামায়ণ, মহাভারত, মনসামঙ্গল, মঙ্গলকাব্য আলেখ্য রচনা করে। থাকে প্রাণি ও উদ্ভিদের ‘মোটিফ" এর জ্যামিতিক গড়ন। বর্ণে লাল-হলুদ-কালো-নীল। পটে ধরা দেয় নিজ ভাবনা, গোষ্ঠীর ভাবনা, শ্রুতি, মৌখিক পরম্পরা, হেঁয়ালি-প্রবাদ নির্ভর কল্পনার জাগরণ। এক কথায় ধরা দেয় মৌখিক সাহিত্যের চিত্ররূপ। অর্থাৎ, শৈলি নিজস্ব, পদ্ধতি ‘কমিউনিটি’র। এইখানটাই গ্রহণ করেছিলেন যামিনী রায়।

আটপৌরে, জাঁকজমকহীন, প্রসাধনহীন সারল্য ভরা রেখা-রং থাকে তার ছবিতে। তৈরি করেন সারি সারি রামায়ণ কথা, সাঁওতাল জীবন যাপন, কৃষ্ণলীলা। চরিত্রের আশ্চর্য চোখ দর্শককে স্থির করে দেয়।

১৯৩০ সালের শুরুর দিক থেকে যামিনী রায় পটুয়া শিল্প আহরণ করে শহুরে শিল্পজগতে নিজস্ব জায়গা প্রায় পাকা করে ফেললেন। ব্রিটিশ কলকাতার রাস্তায় এই প্রথম প্রদর্শিত হলো কোনও ভারতীয় শিল্পীর আঁকা ছবি। তার আঁকা ছবির দাম এতটাই কম ছিল যে, মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের নাগাল পেতে অসুবিধা হল না।

তবে এ-ও শোনা যায়, যদি শিল্পী কোনও ভাবে খবর পেতেন, তার আঁকা ছবি কোনও ব্যক্তির বাড়ির দেওয়ালে অযত্নে আছে, তিনি তার থেকে সেই ছবি কিনে নিয়ে চলে আসতেন। শিল্পের অমর্যাদা তার সইত না।

ক্রমে পাশ্চাত্য দুনিয়াও তার শিল্পের সন্ধান পেল। আগামী বছরগুলোয় যামিনী রায়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হল নিউ ইয়র্কে এবং লন্ডনে। বর্তমানে পৃথিবীর একাধিক আর্ট মিউজিয়ামে যামিনী রায়ের ছবি রাখা রয়েছে। পরের দিকে শিল্পী উপকরণেও পাশ্চাত্য বস্তু বাদ দিতে শুরু করেছিলেন। ক্যানভাসের বদলে ব্যবহার করতেন কাপড় দিয়ে তৈরি উপকরণ। রঙ তৈরি করতেন প্রাকৃতিক পদার্থ দিয়ে।

যামিনী রায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-শিল্পকর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাই দেখা যায়, যামিনী রায়ই একজন আধুনিক শিল্পী, যিনি রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে লিখিতভাবে প্রথম প্রতিবেদন রেখেছেন। এই লেখা বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকার রবীন্দ্র সংখ্যায় (আষাঢ়, ১৩৪৮) প্রকাশিত হয়। কবিতা পত্রিকায় যামিনী রায় প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথের ছবি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পড়ে বড় আনন্দ পেয়েছিলেন বলে জানা যায়। স্বয়ং কবি চিঠি লিখে যামিনীকে জানিয়েছিলেন সে কথা। সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, "তোমাদের মতো গুণীর সাক্ষ্য আমার পক্ষে পরম আশ্বাসের বিষয়।… আমার স্বদেশের লোকেরা আমার চিত্রশিল্পকে যে ক্ষীণভাবে প্রশংসার আভাস দিয়ে থাকেন আমি সেজন্য তাদের দোষ দিই নে। আমি জানি চিত্র দর্শনের যে-অভিজ্ঞতা থাকলে নিজের বিচারশক্তিকে কর্তৃত্বের সঙ্গে প্রচার করা যায়, আমাদের দেশে তার কোনো ভূমিকাই হয়নি। সুতরাং চিত্রসৃষ্টির গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে পারে না বলেই মুরুব্বিয়ানা করে সমালোচকের আসন বিনা বিতর্কে অধিকার করে বসে। সেজন্য এদেশে আমাদের রচনা অনেক দিন পর্যন্ত অপরিচিত থাকবে। আমাদের পরিচয় জনতার বাইরে, তোমাদের নিভৃত অন্তরের মধ্যে। আমার সৌভাগ্য, বিদায় নেবার পূর্বেই নানা সংশয় এবং অবজ্ঞার ভিতরে আমি সেই স্বীকৃতি লাভ করে যেতে পারলুম, এর চেয়ে পুরস্কার এই আবৃতদৃষ্টির দেশে আর কিছু হতে পারে না।"

যামিনী রায়কে রবীন্দ্রনাথ আরও একটি অসাধারণ চিঠি লিখেছিলেন, যা বহুপঠিত এবং বহুচর্চিত। যেখানে আধুনিক দৃশ্যকলার একেবারে গোড়ার কথাটি নিঃসংকোচে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। সে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,

"ছবি কী– এ প্রশ্নের উত্তর এই যে– সে একটি নিশ্চিত প্রত্যক্ষ অস্তিত্বের সাক্ষী। তার ঘোষণা যতই স্পষ্ট হয়, যতই সে হয় একান্ত, ততই সে হয় ভালো। তার ভালো-মন্দের আর কোনো যাচাই হতে পারে না। আর যা কিছু – সে অবান্তর – অর্থাৎ যদি সে কোনো নৈতিক বাণী আনে, তা উপরি দান।"  

কলকাতার তার এক প্রদর্শনীতে কিংবদন্তী শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন। তখন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জিহ্বায় প্যারালাইসিস, তাই কথা বলতে পারেন না। যামিনী রায় দেখলেন, তার আঁকা ছবি দেখে গগনেন্দ্রনাথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

সরোজিনী নাইডু যামিনী রায়কে বলেছিলেন বিখ্যাত রাজনীতিবিদ হোসেন  শহীদ সোহরাওয়ার্দির কথা। সোহরাওয়ার্দির বাড়িতে শোয়ার ঘরে যামিনী রায়ের আঁকা গোপিনীর ছবি ছিল, দাঙ্গার সময় উন্মত্ত জনতা সব ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গিয়েছিল কিন্তু , যামিনী রায়ের ছবিতে হাতটা পর্যন্ত দেয়নি!  

বুদ্ধদেব বসু যেমন লিখেছিলেন, "অমৃতবাজারের কালাঙ্কিত কার্যালয়গুলি পেরিয়ে উল্টোদিকে থাকেন যামিনী রায়... একতলায় চারখানা কি পাঁচখানা ঘর নিয়ে তার রাজত্ব। এখানেই তিনি দিনমান কাটান ঋতুর পর ঋতু প্রতিটি দিন; ছবি আঁকেন, ছবি ভাবেন, কেউ এলে কথা বলেন ছবি নিয়ে— যে-কোনো সময় আগন্তুকের তিনি অধিগম্য।’

প্রবাদপ্রতিম কবি বিষ্ণু দে যেমন ১৯৫৯-এর ২১ জুন ‘তাই তো তোমাকে চাই’ কবিতায় শিল্পী যামিনী রায়কে নিয়ে লিখেছিলেন এমন করে। 

"একটিই ছবি দেখি, রঙের রেখার দুর্নিবার একটি বিস্তার

মুগ্ধ হয়ে দেখি এই কয়দিন, অথচ যামিনীদার

প্রত্যহের আসনের এ শুধু একটি নির্মাণ একটি প্রকাশ

হাজার হাজার রূপধ্যানের মালার একটি পলক

যেখানে অন্তত গোটা দেশ আর কাল, একখানি আবির্ভাব"

আজ প্রবাদপ্রতিম কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী যামিনী রায়ের জন্মদিন। শিল্পের এই মহান স্রষ্টার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।  

তথ্যসূত্র-

যামিনী রায়: এক আধুনিক চিত্রকর/ নরেশ গুহ

বাংলার চিত্রকলা মধ্যযুগ থেকে কালীঘাট/ অঞ্জন সেন

যামিনী রায়: পত্রাবলি ও প্রবন্ধ/ সম্পাদনা ও ভূমিকা- দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় 

ভারতের চিত্রকলা/ অশোক মিত্র

যামিনী রায় বিষ্ণু দে: বিনিময়/ অরুণ সেন

রূপতাপস যামিনী রায়/ প্রশান্ত দাঁ

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

আরও পড়ুন-

সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমেদ আজও প্রাসঙ্গিক

যুগের পর যুগ ধরে অবহেলার এক চূড়ান্ত নিদর্শন ভাষা শহীদ আবদুস সালাম

মেঘ ছাপিয়ে যাওয়া এক স্বপ্নবান স্থপতি ফজলুর রহমান খান

এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিবেটি কাঁকন হেনইঞ্চিতা

‘যদি চলেও যাই, কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না’

স্বাধীনতাই একমাত্র গন্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের: মওলানা ভাসানী

যার ওভারকোটের পকেট থেকে বেরিয়েছিল আধুনিক রুশ সাহিত্য আর সাহিত্যিকেরা

Comments

The Daily Star  | English

Explosions in Myanmar as ship spotted in Naf river

People in the border area said they heard sounds of multiple explosions intermittently from last night to Friday afternoon. However, between 3:00pm and 4:00pm today, there were more than 10 loud explosions

58m ago