দ. আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখে ধারণা করা হচ্ছিল, ভাইরাসের কোনো নতুন স্ট্রেইনই হয়তো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ। প্রতি মাসে হাজারো প্রবাসী দেশে ফিরছেন। আগেই দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭) শনাক্ত হয়েছিল। এসব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছিল, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমণের কারণেই হয়তো দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই ঊর্ধ্বগতি।

সাম্প্রতিক করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখে ধারণা করা হচ্ছিল, ভাইরাসের কোনো নতুন স্ট্রেইনই হয়তো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ। প্রতি মাসে হাজারো প্রবাসী দেশে ফিরছেন। আগেই দেশে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭) শনাক্ত হয়েছিল। এসব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছিল, ইউকে ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমণের কারণেই হয়তো দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই ঊর্ধ্বগতি।

কিন্তু, গতকাল আইসিডিডিআর,বির প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন সবকিছু নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে! প্রতিষ্ঠানটির গবেষকদল মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে সংগৃহীত ৫৭টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ৪৬টি অর্থাৎ ৮১ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১) এবং সাতটি অর্থাৎ ১২ শতাংশ ইউকে ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করেছে। এর আগে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) ২১ মার্চে ২২টি নমুনা সিকোয়েন্স করে, যার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশ ছিল ইউকে ভ্যারিয়েন্ট। 

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম। ছবি: সংগৃহীত

সুতরাং এই দুই প্রতিষ্ঠানের ফলাফল থেকে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশে এখন দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট খুব সম্ভবত বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এ কারণেই হয়তো করোনা সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি।

এর আগে, আইসিডিডিআর,বি ১২ থেকে ১৭ মার্চ ৯৯টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে। যার ভেতর ৬৪টি অর্থাৎ ৬৫ শতাংশ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এবং ১২টি ছিল ইউকে ভ্যারিয়েন্ট। ১ জানুয়ারি থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত ২৪৮টি নমুনার ওপর চালানো ভ্যারিয়েন্ট সার্ভেইল্যান্সে প্রতিষ্ঠানটি কোনো দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করতে পারেনি।

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আইসিডিডিআর,বি ৫২টি নমুনা পরীক্ষা করে মাত্র একটি অর্থাৎ প্রায় দুই শতাংশ ইউকে ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পায়। এর পরে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ক্রমান্বয়ে নমুনাতে ইউকে ভ্যারিয়েন্টের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তা মার্চের প্রথম সপ্তাহে ৫২ শতাংশে পৌঁছে। এরপর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ইউকে ভ্যারিয়েন্ট আকস্মিকভাবে কমতে থাকে এবং সে জায়গাটি নিয়ে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে করোনা সংক্রমণ বাড়ার সংযোগ কতটা?

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউকে ভ্যারিয়েন্ট উভয়েরই স্পাইক প্রোটিনে এন৫০১ওয়াই মিউটেশনটি রয়েছে। ফলে দুটি ভ্যারিয়েন্টই অতিদ্রুত সংক্রমণ ছড়ায়। তবে, দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের স্পাইক প্রোটিনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন ই৪৮৪কে ঘটেছে, যার ফলে এই ভ্যারিয়েন্টটি হয়ে উঠেছে ভ্যাকসিন রেজিস্ট্যান্ট এবং সহজেই করতে পারে পুনঃসংক্রমণ।

বাংলাদেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরু চলতি বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে হলেও, সংক্রমণের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয় মার্চের মাঝামাঝি থেকে। এবং শেষ সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন রোগী শনাক্ত হতে থাকে তিন থেকে পাঁচ হাজার করে, যা এপ্রিলে গিয়ে পৌঁছায় সাত হাজারে। আর ঠিক এই সময়টিতেই, অর্থাৎ ১২ থেকে ২৪ মার্চের ভেতরে ১৩ জেলা থেকে প্রাপ্ত নমুনায় দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি মিলে ৬৪ থেকে ৮০ শতাংশ।

আইসিডিডিআর,বি ১৩টি জেলা থেকে প্রাপ্ত দুই হাজার ৭৫১টি কোভিড-পজিটিভ নমুনা থেকে বেশি ভাইরাল লোড সমৃদ্ধ ৪৪৩টি নমুনার ওপর জিনোম সিকোয়েন্স করে মার্চের শেষার্ধে ১৫৬টি নমুনায় মোট ১১০টি দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টে শনাক্ত করে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা বিবেচনায় ৪৪৩টি নমুনা খুব বেশি নয়। এই স্বল্পসংখ্যক নমুনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এটা বলা খুব কঠিন যে সারা বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তৃতি কোন পর্যায়ে রয়েছে। তবে, উপরের এই তথ্য-উপাত্ত থেকে এতটুকু অনুমান করা যায় যে, খুব সম্ভবত বাংলাদেশের কমিউনিটিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউকে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে এবং বর্তমান করোনা পরিস্থিতির জন্য বিদেশ থেকে আসা নতুন স্ট্রেইনগুলোই মূলত দায়ী।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন (কোভিশিল্ড) দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী?

২০২১ সালের ১৬ মার্চ নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন সাময়িকীতে প্রকাশিত ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলে দেখা যায়, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে মাত্র ১০ শতাংশ কার্যকর। এ ছাড়াও, ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা যায়, অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনে তৈরি হওয়া নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে ব্যর্থ। সুতরাং কোভিশিল্ড বা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পুরোপুরি সক্ষম নয়। তবে, এই ভ্যাকসিনটি সিভিয়ার কোভিড থেকে মৃত্যু ঠেকাতে পারে কি না, তা এখনো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট থেকে সৃষ্ট সিভিয়ার কোভিড থেকে মৃত্যু ঠেকাতে সক্ষম।

বাংলাদেশে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দিয়ে টিকাদান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এমতাবস্থায় সারাদেশে যদি দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে ভ্যাকসিন ফেইলিওরের সম্ভাবনা রয়েছে। এই কারণেই এখন বিস্তৃত পর্যায়ে ভ্যারিয়েন্ট সার্ভেইল্যান্স চালাতে হবে। কোন কোন অঞ্চলে কোন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে, তার একটা মানচিত্র করতে হবে। যে জেলা বা অঞ্চল দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে সংক্রমিত, তাকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা করে ফেলতে হবে। অঞ্চল-ভিত্তিক ভ্যারিয়েন্ট কনটেইনমেন্ট করতে পারলে দেশব্যাপী দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার রোধ করা যেতে পারে। যদিও এখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে।

কোভিশিল্ড ছাড়াও এখন অন্য ভ্যাকসিন কেনার কথাও ভাবতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রোটিন-বেইজড ভ্যাকসিন নোভাভ্যাক্স দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ কার্যকরী। এই ভ্যাকসিনটি ব্যাপকভাবে উৎপাদন করবে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। ডাচ-আমেরিকান কোম্পানির অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর-বেইজড জনসন অ্যান্ড জনসন ভ্যাকসিনও এই ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৬৪ শতাংশ কার্যকর। এই ভ্যাকসিন দুটির সংরক্ষণ তাপমাত্রা দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা বাংলাদেশের কোল্ড চেইনের সঙ্গে মানানসই। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত যে, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার-বায়োএনটেক ভ্যাকসিনও দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে কার্যকর। ছোট পরিসরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে (৮০০ জন স্বেচ্ছাসেবক) দেখা গেছে, এই ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে শতভাগ কার্যকর। যদিও ফাইজার ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য দরকার মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ফ্রিজার।

কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে মাইল্ড ও মডারেট কোভিড প্রতিরোধ করতে না পারলেও ধারণা করা হচ্ছে, সিভিয়ার কোভিড থেকে জীবন রক্ষা করতে পারবে। তাই কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে কার্যকরী নয়, এই প্রচারণা সঠিক নয়।

করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট যেটাই হোক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে ও নিয়ম মেনে মাস্ক পরলে যেকোনো ধরনের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে ও পরিবারকে রক্ষা করা যায়। তাই সাবধান হওয়া জরুরি। সাবধানতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যার কোনো বিকল্প এখন মানবজাতির সামনে নেই।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

আরও পড়ুন:

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধা এবং আমাদের যত ভ্রান্তি!

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন কতটা সুরক্ষা নিশ্চিত করে?

ভ্যাকসিন নিলেও করোনায় আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে?

ভারতে করোনার নতুন স্ট্রেইন, বাংলাদেশে সতর্কতা জরুরি

৪ সপ্তাহের পার্থক্যে দ্বিতীয় ডোজে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৫৩ শতাংশ, ১২ সপ্তাহে ৮৩ শতাংশ

করোনার নতুন স্ট্রেইন শনাক্ত হয় না বাংলাদেশের পিসিআর পরীক্ষায়

যুক্তরাজ্যের স্ট্রেইন দেশে শনাক্ত: ‘দেরিতে জানিয়ে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি’\

করোনার নতুন স্ট্রেইন: করছি কী, করণীয় কী

করোনাভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ‘কিছুটা কমতে পারে

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

6h ago