বেতনের চেয়ে ওভার টাইম বেশি!

করোনাকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব বাক্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, তার মধ্যে একটি এরকম যে, ‘চাকরি করলে সরকারি, ব্যবসা করলে তরকারি’।
wasa

করোনাকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব বাক্য বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, তার মধ্যে একটি এরকম যে, ‘চাকরি করলে সরকারি, ব্যবসা করলে তরকারি’।

সরকারি চাকরিতে যে কী মধু—তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু তারপরও মাঝেমধ্যেই এমন সব ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনাম হয় যা নিয়ে নতুন করে লিখতে হয়।

সাম্প্রতিক একটি খবরের দিকে নজর দেয়া যাক: ‘ঢাকা ওয়াসায় বেতনের চেয়ে ওভার টাইম বেশি।’ এটিকে বিচ্ছিন্ন বা নতুন ঘটনা বলে ভাববার কারণ নেই। কেননা, ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবরও প্রথম আলোর একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল: ‘ঢাকা ওয়াসায় বেতনের চার গুণ ওভারটাইম’। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি যুগান্তরের শিরোনাম ছিল: ‘ওভারটাইমের নামে দেড়শ’ কোটি টাকা অপচয়।’

সবশেষ খবর হলো, ঢাকা ওয়াসার প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মচারীর গত অর্থবছরে মূল বেতন ছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকা, আর তারা এ সময়ে ওভারটাইমই (ওটি) নিয়েছেন প্রায় ৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মূল বেতনের দ্বিগুণেরও বেশি ওভারটাইম। নিয়মানুযায়ী ওভারটাইম কখনো মূল বেতনের বেশি হতে পারে না।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একজন কর্মচারীর সারা মাসে অফিস সময় ধরা হয় গড়ে ১৭৫ ঘণ্টা। এটা ধরেই তাদের ঘণ্টায় বেতন হিসাব করা হয়। শ্রম আইন অনুযায়ী সাধারণ কর্মচারীরা অতিরিক্ত কাজের জন্য মূল বেতনের দ্বিগুণ পান। ১৯৮০ সালে সরকারি আদেশ অনুযায়ী ছুটির দিনসহ গাড়িচালকদের মাসে সর্বোচ্চ আড়াইশো ঘণ্টা ওভারটাইম দেওয়া যায়। তবে তা কখনোই মূল বেতনের বেশি হতে পারবে না।

খবরে বলা হচ্ছে, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) গাড়িচালক মাধব গোপাল মজুমদারের মূল বেতন ২০ হাজার ৪২০ টাকা। অথচ গত জুলাই মাসে তার ওভারটাইম হয়েছে ৬১ হাজার ১৫ টাকা। পাম্প অপারেটর কাজী মজিবুর রহমান ও রফিকুল ইসলামের মূল বেতন ১৮ হাজার ৮৬০ টাকা। ওভারটাইম বিল ৭৮ হাজার ৩১ টাকা।

হিসাব বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সম্ভবত তারা একজনের বিল দেখে অন্যজন তৈরি করেছেন। যে কারণে ওভারটাইমের ঘণ্টা ও টাকার অঙ্ক কাছাকাছি। এসব ঘটনা থেকেই সম্ভবত ‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢাল’ প্রবাদটি এসেছে। অর্থাৎ চুরি বা তথ্য এদিক-সেদিক করে কিংবা নানাবিধ ফন্দিফিকির করে যদি পয়সা কামানোর সুযোগ থাকে, সেটি কে ছাড়ে! এমন বোকা মানুষ তো সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে খুব বেশি নেই।

সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কর্মচারীরা ওভারটাইম পাবেন—এটি অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু তার তো জবাবদিহি থাকতে হবে। আবার সপ্তাহে দুয়েক দিন বেশি কাজ হতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে সারা সপ্তাহজুড়েই ওভার টাইম করার মতো কাজ থাকে। সরকারি অফিসে কর্মচারীরা সারাদিন কী হাতিঘোড়া মারেন—তা কে না জানে।

কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন ওয়াসার গভীর নলকূপের পাম্প স্টেশনগুলোতে লোকবল কম। প্রতি মাসেই পাম্পের সংখ্যা বাড়ে, কিন্তু সে হারে লোক বাড়ে না। ফলে এখানে কর্মচারীদের ওভারটাইম প্রয়োজন হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, অন্যান্য বিভাগেও এরকম অস্বাভাবিক ওভারটাইম এবং তার জন্য বেতনের দ্বিগুণ পয়সা দিতে হবে।

প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ কত ঘণ্টা ওভারটাইম করতে পারেন? কয়জন সরকারি কর্মচারী ৮ ঘণ্টা কাজ করেন? ৮ ঘণ্টা অফিসে থাকলে তারা আসলে কাজ করেন কতক্ষণ? আবার যতক্ষণ কাজ করেন তার মধ্যে কত সময় আসলেই মানুষের সেবা দেন আর কত ঘণ্টা উপরি কামানোর ধান্দায় থাকেন—সেই হিসাব কারো কাছে আছে?

২০১৭ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, আজিজুল হক নামে একজন কর্মচারী এক মাসে ৩৩৫ ঘণ্টা ওভারটাইম করেছেন। অর্থাৎ প্রতিদিন তিনি ১১ ঘণ্টার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে তার মোট কর্ম-ঘণ্টা দাঁড়ায় দৈনিক ১৯ ঘণ্টা। দৈনিক ১৯ ঘণ্টা কি একজন মানুষের পক্ষে কাজ করা সম্ভব? এখানে যে এক বিশাল শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। অথচ ওভারটাইম আদায়ের জন্য কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) নেতাকর্মীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের খবরও বিভিন্ন সময়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।

২০১৮ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ওভারটাইমের নামে বছরে ঢাকা ওয়াসায় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। কাজ না করেই ওয়াসার প্রায় তিন হাজার কর্মচারী ওভারটাইমের বিল হিসেবে মাসে বেতনের তিন-চারগুণ টাকা তুলে নিচ্ছেন।

মনে রাখা দরকার, সরকারি কর্মচারীদের বেতন হয় জনগণের করের পয়সায়। কিন্তু সেই জনগণের প্রতি তাদের জবাবদিহিতা দূরে থাক—ন্যূনতম দায়বদ্ধতাটুকুও তাদের কতজন পালন করেন বা উপলব্ধি করেন, সেটাও এক বিরাট প্রশ্ন। বরং যে জনগণের করের পয়সায় তাদের বেতন হয়, দামি গাড়িতে চড়েন, অবসরের পরে মোটা অংকের পেনশন পান—সেই জনগণই তাদের কাছে সেবার জন্য গিয়ে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়। কর্মচারীদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে হয়। অথচ সরকারি কর্মচারীদেরই উচিত সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে স্যার বলে সম্বোধন করা। কিন্তু এ কথা বললে হাস্যকর শোনাবে।

অনেক প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও সেবা গ্রহীতাদের সঙ্গে যেসব আচরণ করেন, তা শুধু অশোভনই নয়, লজ্জাজনকও। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে। কোনো প্রতিকার নেই।

নির্ধারিত বেতন বোনাস পেনশনের বাইরেও তারা জনগণের কষ্টার্জিত পয়সার শ্রাদ্ধ করেন। উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা লুটপাট করেন। চাকরিরত অবস্থাতেই বিদেশে বাড়ি কেনেন। সিনিয়র পদে চাকরি করলে এবং সরকার ও সরকারি দলের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকলে অবসরের পরে মোটা বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক হন। কেউ কেউ টেলিভিশনে গিয়ে বুদ্ধিজীবী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে জাতিকে সবক দেন। অনেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন বা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন।

অর্থাৎ সরকারি চাকরিজীবীদের পুরো প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, তারা জনগণের কাছে কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। বরং বৈধ-অবৈধ সব উপায়ে তাদের টাকা কমানোর পথ উন্মুক্ত। কালেভদ্রে দুয়েকটা বড় ঘটনা প্রকাশিত হয়ে গেলে তা নিয়ে তোলপাড়; সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা। অনেকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বা অপরাধ খুব গুরুতর হলে চাকরিচ্যুত (বিরল)। যে কারণে অনেক সময় রসিকতা করে বলা হয়, সরকারি চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি যাওয়াও কঠিন।

উপরন্তু তাদের জন্য রয়েছে আইনি সুরক্ষা। যত বড় অপরাধই হোক না কেন, তার তদন্ত করেন সাধারণত তাদের সহকর্মীরাই। সুতরাং সব সময়ই সহকর্মীদের বাঁচানোর একটা প্রবণতা থাকে। আবার প্রত্যেকটা আইনে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বলে একটা বিষয় যুক্ত থাকে—যার দোহাই দিয়েও তারা পার পেয়ে যান। অর্থাৎ রাষ্ট্র সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষার জন্য যতটা উদার, সাধার মানুষের নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় ততটাই অনুদার।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

2h ago