প্রবৃদ্ধির বান আর শেয়ারবাজারের টান

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন সর্বকালের সেরা উচ্চতায়, তখন দেশের পুঁজিবাজার সবচেয়ে খারাপ অবস্থার দিকে ধাবমান। ফলে সরকার জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ঢেঁকুর তুললেও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা হতাশায়, দুঃখে, ক্ষোভে পুড়ছেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং শেয়ারবাজারের এই বৈপরীত্য নানা প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে। সত্যিই কি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, আর কাঠামোগত সমস্যার কারণে পুঁজিবাজার ধুঁকছে। নাকি অর্থনীতির সূচকগুলো দুর্বল হতে শুরু করেছে, যার পূর্বাভাস দিচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার।
DSE-Photo.jpg
রাজধানীর মতিঝিলে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ। ছবি: স্টার

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন সর্বকালের সেরা উচ্চতায়, তখন দেশের পুঁজিবাজার সবচেয়ে খারাপ অবস্থার দিকে ধাবমান। ফলে সরকার জিডিপিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ঢেঁকুর তুললেও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা হতাশায়, দুঃখে, ক্ষোভে পুড়ছেন। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং শেয়ারবাজারের এই বৈপরীত্য নানা প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে। সত্যিই কি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, আর কাঠামোগত সমস্যার কারণে পুঁজিবাজার ধুঁকছে। নাকি অর্থনীতির সূচকগুলো দুর্বল হতে শুরু করেছে, যার পূর্বাভাস দিচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.১৩ শতাংশ। এ খবর যখন প্রতিদিন ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছে তখনই শেয়ারবাজারের ধস, বিনিয়োগকারীদের প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে গেছে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে। ২০১০ সালের বাজার ধসের পর এবারই প্রথম টানা দরপতনে মাত্র দুইদিনে প্রায় সাড়ে চার শতাংশ সূচক কমার নজির দেখা গেলো ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে। ফলে ডিএসইর প্রধান সূচক নেমে এসেছে চার হাজার পয়েন্টে। 

বিশ্বের সব দেশেই অর্থনীতির হালচাল বুঝার জন্য শেয়ারবাজার একটি বড় সূচক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কখনোই দেশের অর্থনীতিকে ততোটা প্রতিনিধিত্ব করেনি। কিন্তু তাই বলে একদমই করেনি সেটিও ঠিক নয়। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি আসলে কী? গত কয়েক মাস ধরেই দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট স্পষ্ট। রপ্তানি আয়ে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। আমদানির তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে। চাপ দেখা যাচ্ছে কারেন্ট একাউন্ট ব্যালেন্সে। এ বিষয়গুলো আমাদের চেয়ে বিদেশি শেয়ার বিনিয়োগকারীরা বেশি লক্ষ্য করেন।

কারণ অর্থনীতি খারাপ হলে তখন দেশিয় মুদ্রা অবমূল্যায়ন হয়। আর এর ফলে তাদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষতির ভয়ই পাচ্ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। গত কয়েক মাসের যে দরপতন সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। তারা মনে করছেন, দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো যে রকম দেখা যাচ্ছে তাতে সরকার খুব বেশি দিন মুদ্রা অবমূল্যায়ন ঠেকাতে পারবে না। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে মুদ্রা অবমূল্যায়ন করা হবে না। কিন্তু অর্থনীতির সূচকগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলে গত দশ মাস ধরে তাদের শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ক্রয়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। 

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করার পেছনে আরও কারণ রয়েছে। একাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারীর সঙ্গে ইমেইল চালাচালির সুবাদে জেনেছি তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নানা বিষয়ের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে খুব বিরক্ত। গেলো বছরের শেষ দিকে, হঠাৎ করেই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মেয়াদ দশ বছর থেকে বাড়িয়ে ২০ বছর করার সুযোগ করে দিলো। যখন বিনিয়োগকারীরা বসে আছেন আর কয়েক মাসের মধ্যে ফান্ডের মেয়াদ শেষ হবে তখন বড় অংকের মুনাফা পাওয়া যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে এভাবে মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ দেওয়া হলো, সেটিও বিনিয়োগকারীদের অনুমতি না নিয়েই। একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী বিএসইসির নামে মামলাও ঠুকে দিলেন, এই বলে যে আমার টাকা দিয়ে যে ফান্ড গঠিত তার মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বিএসইসি কীভাবে নিতে পারে? পারে, এটি বাংলাদেশে সম্ভব, যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই সত্যটি বুঝলেন তখন তারা দেদার শেয়ার বিক্রি শুরু করে দিলেন। অথচ খুব ঠুনকো যুক্তিতে এ মেয়াদ বাড়ানো হলো। যুক্তিটি হচ্ছে ফান্ড ভাঙতে গিয়ে শেয়ার বিক্রি করলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আগামী দশ বছর পর যখন বিক্রি করবে তখন কি বাজারে প্রভাব পড়বে না? তাছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে মুনাফা করলে কেউ কখনও তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলে না। বরং আবার বাজারেই বিনিয়োগ করে। অথচ রাজনৈতিক তদবিরের কারণে সরকার এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিলো, যা লাখ লাখ বিনিয়োগকারীকে হতাশ করেছে।

শুধু কি এটিই? গ্রামীণফোনের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার মধ্যকার সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ বিষয়ে খোদ অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, তিন সপ্তাহের মধ্যে সমাধান করা হবে। তবে চার মাস পার হয়ে গেলেও তিন সপ্তাহের সীমা আর শেষ হলো না। বরং এটি যে এখন আর অর্থমন্ত্রীর পক্ষেও সমাধান করা সম্ভব নয়, সেটি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বুঝে গেছেন। তাছাড়া গ্রামীণফোন একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানি হওয়া সত্ত্বেও এ কোম্পানির বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিএসইসির সঙ্গে এ বিষয়ে কখনোই বিটিআরসি পরামর্শ করেনি। যা নিয়ে বিএসইসি চেয়ারম্যান হতাশা প্রকাশ করেছেন।

এটিই একমাত্র উদাহরণ নয়। এর আগে ২০১৫ সালে তিতাস গ্যাসের বিষয়েও একই ঘটনা ঘটেছিলো। সে বার তিতাস গ্যাসের সার্ভিস চার্জ কমানোর সিদ্ধান্ত নিলো জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি, সেটিও বিএসইসির সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ না করেই। পরে তিতাসের দামে ব্যাপক ধস নামে। বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তখনও বিএসইসির চেয়ারম্যান সেটি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। কারও কোনো টনক নড়েনি।

শেয়ারবাজার গত কয়েকদিনে যেভাবে পড়ছে, সেখানে শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রির কারণেই তা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। বরং প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি বিনিয়োগকারীসহ সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে, ফলে তারাও বিনিয়োগ করছেন না, পারলে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

অনেকেই বলেন ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ কমে গেছে। এটি সত্য। তবে শুধু এ জন্যই তারা বিনিয়োগ করছেন না তা ঠিক নয়। বরং একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা আসলে এ বাজারে বিনিয়োগের আস্থা পাচ্ছেন না। কারণ এখানে অব্যাহতভাবে কারসাজি চলে। যার কোনো দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কর্পোরেট সুশাসন মানার বালাই নেই। বেশিরভাগ কোম্পানিই বিনিয়োগকারীদের নানাভাবে ঠকাচ্ছেন। বড় অংকের মুনাফা করেও বছরের পর বছর ধরে শুধু রিজার্ভ বাড়াচ্ছেন, লভ্যাংশ দিচ্ছেন না। অনেক কোম্পানির উদ্যোক্তাই শেয়ার ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। ফলে এ ধরনের বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ লাভজনক হচ্ছে না। এ অবস্থা পরিবর্তনে বিএসইসিতে যে ধরনের শক্ত মনোভাব দরকার তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক পতনের পেছনে ব্যাংকিং খাতের করুণ অবস্থাও দায়ী। এখনও পুঁজিবাজারে মূলধনের দিক থেকে এটিই সবচেয়ে বড় খাত। অথচ কুঋণ বেড়ে যাওয়া এবং সম্পদের মান কমে যাওয়া নিয়ে ব্যাংকিং খাত ব্যাপকভাবে ধুঁকছে। ফলে ব্যাংকিং সেক্টরের পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ায় মোট ত্রিশটি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের মধ্যে নয়টি ব্যাংকের শেয়ারের দাম ইতোমধ্যে দশ টাকারও নিচে নেমে এসেছে। সরকার আরোপিত ছয় ও নয় শতাংশের সুদ নির্ধারণ এ খাতের জন্য সামনে আরও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসবে। সুদহার নির্ধারণে সরকারের যুক্তি ভিন্ন। তার ভালো-মন্দ নিয়ে আমি বলছি না, যদিও কেনিয়া সুদহার নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও, পরে সেখান থেকে সরে আসতে হয়েছিলো। তবে ব্যাংকিং সেক্টরের পরিস্থিতি ভালো না হলে পুঁজিবাজার ভালো হওয়ার আশা কম।

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিএসইসি প্রণোদনামূলক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোও ভেস্তে গেছে, কাজে আসেনি। কারণ, বেশিরভাগ পদক্ষেপই কোনো গবেষণার ভিত্তিতে নেওয়া হয় না। বাজার সংশ্লিষ্টরা তাদের যেরকম মনে হয়, কিংবা সুবিধা হয় তারা সেভাবে বাজার পতনের কারণ ব্যাখ্যা করেন। আর তা শুনে সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়ে নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু বাজার সংশ্লিষ্টদের মতামত সত্য কী না এবং কোনো পদক্ষেপ নিলে তার ফলাফল কী হবে, সেটি যাচাই করা জন্য গবেষণার কোনো বালাই নেই। ফলে বিএসইসি কয়েকমাস আগে ২২টি নীতিগত পরিবর্তন আনলো। বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দিলো। কিন্তু এ সুযোগও সিটি ব্যাংক ছাড়া আর কেউ নিলো না। আর বাজারেও তেমন কোনো প্রভাব পড়লো না।

তাই বিএসইসিকে কর্পোরেট সুশাসন রক্ষায় শক্ত হতে হবে। স্বনামধন্য কোম্পানি বাজারে নিয়ে আসতে হবে। অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করা যাবে না, সেটির পেছনে রাজনৈতিক যতো বড় তদবিরই থাকুক। সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসিকে কাজ করতে হবে। আর তালিকাভুক্ত কোনো কোম্পানি বা বাজার নিয়ে কোনো নীতি পরিবর্তন বা নতুন করে নেওয়ার ক্ষেত্রে গবেষণা করে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবেই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে বাজারের প্রতি। বিনিয়োগও বাড়বে এবং এ পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানানসই গতিতে এগিয়ে যাবে।

স্টাফ রিপোর্টার, দ্যা ডেইলি স্টার

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Depositors money in merged banks

Depositors’ money in merged banks will remain completely safe: BB

Accountholders of merged banks will be able to maintain their respective accounts as before

4h ago