‘দেশ নিয়ে যতটা প্রত্যাশা ছিল, ততটা অর্জন করতে পারিনি’

জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক, যিনি এক জীবন অতিবাহিত করেছেন জ্ঞানার্জন আর জ্ঞান বিলিয়ে। সক্রেটিসের মতো সাধনা করে গেছেন শিক্ষা সমাজ নিয়ে। কিন্তু সেই অর্থে কোনো বই প্রকাশ করে যাননি। তবু মানুষ তাকে মনে রেখেছেন। তাকে বলা হয় ‘শিক্ষকদের শিক্ষক’। আর তাই ১৯৭৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। 

জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক, যিনি এক জীবন অতিবাহিত করেছেন জ্ঞানার্জন আর জ্ঞান বিলিয়ে। সক্রেটিসের মতো সাধনা করে গেছেন শিক্ষা সমাজ নিয়ে। কিন্তু সেই অর্থে কোনো বই প্রকাশ করে যাননি। তবু মানুষ তাকে মনে রেখেছেন। তাকে বলা হয় 'শিক্ষকদের শিক্ষক'। আর তাই ১৯৭৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। 

আব্দুর রাজ্জাকের জ্ঞানের পরিধি ছিল প্রাচ্যতত্ত্ব, ইতিহাস ও রাজনীতিতে। পিএইচডি করেন  'Political Parties in India' এই শিরোনামে। আনুষ্ঠানিকভাবে থিসিস প্রকাশ করেননি। দীর্ঘ ৭০ বছর পরে প্রকাশিত হচ্ছে তার এই পিএইচডি গবেষণা।

এটি সম্পাদনা করছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আহরার আহমদ। তিনি দায়িত্ব পালন করছেন আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক হিসেবে। বইটি প্রকাশ করছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। প্রকাশিতব্য বই ও আবদুর রাজ্জাকের চিন্তা নিয়ে আহরার আহমদ আলাপ করছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে। 

দ্য ডেইলি স্টার: ৭০ বছর পরে হলেও অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে আব্দুর রাজ্জাক স্যারের পিএইচডি থিসিস 'Political Parties in India' বের যাচ্ছে। কোন প্রক্রিয়ায় পুরনো পাণ্ডুলিপি হাতে পেলেন?

আহরার আহমদ: রাজ্জাক স্যারের কাছে থিসিসের দুয়েকটি কপি ছিল। এগুলোর অস্তিত্ব সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম কিন্তু কোনোদিন দেখিনি। থিসিসটি ছাপানোর চিন্তা আগেও ছিল, তবে প্রচেষ্টা কিছুটা ইতস্তত এবং বিক্ষিপ্ত ছিল। ২০১৬ সালে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশনে যুক্ত হই। ফাউন্ডেশনে যখন যোগদান করি, তখন ফাউন্ডেশনে ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, স্যার ফজলে হাসান আবেদ, অধ্যাপক রওনক জাহান, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, মানবাধিকার কর্মী হামিদা হোসেন, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটুসহ আরও অনেকেই। তারা এটা প্রকাশের জন্য আমাকে উৎসাহিত করেন। যে কপিটা লিটুর কাছে ছিল সেই কপিটা নিয়ে আমি ধীরে ধীরে অগ্রসর হই এবং অনেকের সাহায্যে কাজটা শেষ করি।

ডেইলি স্টার: আপনি নিজেও আব্দুর রাজ্জাক স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে থিসিস শেষ না করার পিছনে কারণ কী ছিল?

আহরার আহমদ: 'থিসিস শেষ না করা'- বলা হয়তো ঠিক প্রযোজ্য নয়। তবে পিএইচডি পাওয়ার জন্য যেসব আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে সেগুলো তিনি সম্পন্ন করেননি। এ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে, অনেক স্পেকুলেশন, অনেক গল্প। কিন্তু আসলেই কী হয়েছিল এখনো আমরা ঠিক জানি না। উনার প্রথম সুপারভাইজর প্রফেসর হ্যারল্ড লাস্কি মারা যান ১৯৫০ সালের ২০ মার্চ এবং স্যার দেশের উদ্দেশে লন্ডন ছাড়েন সে বছরের ১৫ জুলাই। মনে হতেই পারে যে এই দুটোর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, তবে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। নতুন কমিটি গঠিত হয়, নতুন সুপারভাইজর নির্ধারিত হয় (প্রফেসর মরিস-জোন্স), স্যার থিসিসটি জমাও দেন। কিন্তু তারপরে 'শেষ হয়েও হইলো না শেষ' অবস্থায় চলে আসেন। এটা হতে পারে যে, হয়তো নতুন কমিটির সঙ্গে ফুটনোট, রেফারেন্স কিংবা অন্য কোনো মতদ্বৈধ ছিল, হতে পারে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিল (বাস্তবে ফুরিয়েও গিয়েছিল), হতে পারে টাকাপয়সাজনিত অসুবিধা ছিল। উনার ফিরে আসাটা একটা অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে রয়েছে। স্যার নিজেও কিছু ইঙ্গিত দেননি এবং আজ পর্যন্ত এর কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি।

ডেইলি স্টার: পুরনো এই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করতে গিয়ে আপনি কোন পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন?

আহরার আহমদ: কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করিনি, যা করণীয়, যা প্রয়োজনীয় মনে করেছি শুধু সেটুকু করেছি। যদিও স্যারের ভাষা এবং পরিবেশটা ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। তবুও উনার ব্যক্তিগত স্টাইল বা বাচনভঙ্গি যেন বিঘ্নিত না হয় সেটা খেয়াল রেখেছি এবং চেষ্টা করেছি 'to let Razzaq be Razzaq'। আমরা চাইনি যে উনার লেখা মডারনাইজড হোক। যদিও, স্পষ্টতার স্বার্থে এবং কিছু অসাবধানতাজনিত ভুল-ভ্রান্তি বা অহেতুক জটিলতা এড়াতে কিছু বিষয়ে একটু পরিবর্তন বা পরিশোধন আবশ্যিক হয়ে পড়েছিল।

দ্বিতীয়ত, ফুটনোটের ব্যাপারে এবং রেফারেন্সের সম্পূর্ণতা নিয়ে স্যার একটু অমনোযোগী ছিলেন এবং টেকস্টের মধ্যেও অনেক জায়গায় কোনো সূত্র দেননি, এমনকি উদ্ধৃতি বা তারিখ, নাম, ঘটনা, উৎস সম্বন্ধে একটু উদাসীন ছিলেন। সেগুলি উদ্ধার করা, সুনির্দষ্ট করা এবং বিস্তারিত করা একটা প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এটা আরও কঠিন হয় এই কারণে যে ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি বা ব্রিটিশ মিউজিয়াম রিসোর্সেস আমাদের নাগালের বাইরে ছিল এবং পরবর্তীকালের গবেষণা ও লেখালেখি, যা ডিজারটেশনটা লেখার সময়ে প্রকাশিত হয়নি, তা আমরা ব্যবহার করতে চাইনি। আমরা তার চিন্তার ধারবাহিকতা, নিজস্বতা এবং উনার চিন্তা জগতের প্রেক্ষিতে বহাল রাখতে চেয়েছি। নতুন করে কোনো জিনিস চাপিয়ে দিতে চাইনি। 

আশা করছি আমরা সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে যা করেছি, তা গ্রহণীয় হবে এবং স্যারের দূরদর্শী চিন্তা, তার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর এবং পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে নতুন করে অনেকেই চিন্তা করবেন। এটাই আমাদের স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা।

ডেইলি স্টার: 'Political Parties in India'-এর বিষয়বস্তু নিয়ে যদি কিছু বলেন...

আহরার আহমদ: পিএইচডির বাংলা শিরোনাম 'ভারতের রাজনৈতিক দল'। এটি মূলত উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের ভারতের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের উন্মেষ ও বিবর্তনের বিশ্লেষণ। আলাপ করেছেন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে নতুন শ্রেণিবিন্যাস ও কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে। কথা বলেছেন ঔপনিবেশিক অবস্থায় মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার অস্তিত্ব, বিকাশ ও ক্রমশ তাদের ক্ষমতার বিরোধ নিয়ে। এতে ওঠে এসেছে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব যা মধ্যবিত্ত শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ভিন্নতা ও সুযোগ সুবিধার সংঘাত হিসেবে প্রকাশিত হয়।

ডেইলি স্টার: আব্দুর রাজ্জাক কেবল শিক্ষাদানই করেননি। ছাত্রদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতেন। এমন শিক্ষক কি দেখেন?

আহরার আহমদ: স্যারের মতো শিক্ষক তখনো খুব কম ছিল। একই রকম নির্মল ব্যক্তিত্ব, চাহিদা-বিবর্জিত জীবন-সাধনা, শিক্ষার ওপর আস্থা, যুক্তিনির্ভর জ্ঞানের প্রতি বিশ্বাস, ছাত্রদের জন্য স্নেহ; সেটা সবার মধ্যে একই রকমভাবে ছিল না। তবে, অনেকের মধ্যে ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দুর্দান্ত ক্লাসরুম শিক্ষক, কেউ কেউ সাংঘাতিক ভালো গবেষক, কেউ কেউ গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী। কারোর মধ্যে ত্রিগুণের সমাহারও ঘটেছিল। এদের অধিকাংশই ছিলেন আমাদের আদর্শ, আমাদের 'হিরো', আমাদের নৈতিক দৃষ্টান্ত এবং অনুপ্রেরণা।

আমরা খুবই ভাগ্যবান যে, এই ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলাম, অনেকের স্নেহধন্য হয়েছিলাম। আজকের যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, রাজনীতি, সমাজ; যেকোনো কারণেই হোক, ওই একই মাপের, একই ধরনের, একই আদর্শের, একই মানসিকতার শিক্ষক এখন ঠিক কতজন আছেন আমার পক্ষে বলা খুব কঠিন। তখনকার সময় নিয়ে যদি রোমান্টিসাইজ না করি তবে মনে হয় যে, তুলনামূলকভাবে আগের চেয়ে কিছুটা কমই হবে। এটা আমার একটা অনুমানমাত্র। ভুল হতে পারে এবং তাহলে অবশ্য আমি ক্ষমা চেয়ে নেব। 

ডেইলি স্টার: রাজ্জাক স্যার 'গণতন্ত্র' নিয়ে ভাবতেন। কেমন সেটা, তা নিয়ে ধারণা দেওয়া যায়?

আহরার আহমদ: গণতন্ত্র সম্বন্ধে স্যার বলতেন, এটি কোন পূর্ণায়ীত প্রকল্প নয় বরং এমন একটি চলমান প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি ক্ষমতাভিত্তিক সরকার থেকে নীতিভিত্তিক সরকারের দিকে উত্তরণ ঘটে। প্রথমটি (ক্ষমতাভিত্তিক সরকার) জবরদস্তিমূলক, আর দ্বিতীয়টি (নীতিভিত্তিক কর্তৃত্ব) মানবিক বৈধতার ওপর নির্ভরশীল; প্রথমটি ধূর্ততা ও ভয়ের ভিত্তিতে জনগণের আনুগত্য দাবি করে, দ্বিতীয়টি মতামত ও জনগণের আস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়; প্রথমটি কোনো বিশেষ নেতার বা গোষ্ঠীর স্বার্থে আইন প্রতিষ্ঠা করে, আর দ্বিতীয়টি আইনের শাসনকে সুদৃঢ় করে; প্রথমটি নির্বাচন ব্যবহার করে ক্ষমতার জন্য, দ্বিতীয়টি জনগণকে স্বাধীনভাবে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দেয়।

স্যার মনে করিয়ে দিতেন যে, গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন জরুরি বটে কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। নির্বাচন ছাড়া আমরা গণতন্ত্র আশা করতে পারি না। কিন্তু কেবল একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা মানে এই নয় যে, আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। এর জন্য আমাদের প্রয়োজন সরকারের জবাবদিহিতা, নাগরিকদের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের সংরক্ষণ, সব মানুষের মর্যাদা রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সংবিধানের প্রাধান্য দেওয়া, সব ধরণের বিরোধ বা সংঘাতের শান্তিমূলক সমাধান করা, পরমত সহিষ্ণুতার স্বার্থে বিভিন্ন মতামত কিংবা দলের উপস্থিতি আইনগতভাবে নিশ্চিত করা ।

ডেইলি স্টার: 'রাজনীতি' সম্বন্ধে তিনি কী ভাবতেন? বাংলাদেশের সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

আহরার আহমদ: রাজনীতি সম্পর্কেও স্যারের কিছু ব্যতিক্রমী চিন্তা ছিল। সংগত কারণে আজকের প্রেক্ষিতে রাজনীতি নিয়ে অনেক দ্বিধা, সন্দেহ এবং প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু স্যারের কাছে রাজনীতি নৈতিকতা বিবর্জিত কোন চর্চা নয়, এটা কোনো জিরো-সাম গেম নয়, কোনো বাক-চার্তুয্যে, ছলনায়, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া নয়, কোনো ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত স্বার্থ আদায়ের জন্য দর কষাকষি নয়, কোনো ক্ষমতার ঠিকাদারি কিংবা সিনিক্যাল ট্রানজেকশন নয়। রাজনীতির ধরন জনসেবা, স্বচ্ছ প্রক্রিয়া এবং মহান আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং মানবসত্তার উদযাপন হতে পারে, দেশপ্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের পথ সুগম করতে পারে। স্যার মনে করিয়ে দিতেন যে গণতন্ত্র ছাড়া রাজনীতি হতে পারে, তবে রাজনীতি ছাড়া গণতন্ত্র সম্ভব নয়। আজকের রাজনীতির প্রকাশ ও চর্চা দেখে স্যার কতটা আশাহত হতেন তা বলতে পারব না, তবে নিশ্চয় কিছুটা উদ্বিগ্ন হতেন।

ডেইলি স্টার: স্যারের সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনা অসামান্য। তা ছড়িয়ে দিতে মহাপরিচালক হিসেবে কি কি কাজ করছেন?

আহরার আহমদ: আমরা যেসব অনুষ্ঠানগুলো করে আসছি তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বক্তৃতামালা, প্রকাশনা, রচনা প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। করোনার কারণে এগুলো কিছুটা বাধাগ্রস্ত এবং সশরীরে অনুষ্ঠানগুলো আয়োজন করতে পারছি না। আমরা যে ধরনের অনুষ্ঠান করি, এতে গবেষণামূলক বক্তৃতার ওপর জোর দেই, সেগুলি জুমের মাধ্যমে কতটা কার্যকরী হবে বা জনপ্রিয় হবে, সেটা আমরা এখনো নিশ্চিত নই। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেদিকে যেতে বাধ্য হয়েছি। আমরা আশা করব যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায় ফিরে যাব। তখন নতুন উদ্যোগে, নতুন উদ্যমে কাজ করতে পারব। 

ডেইলি স্টার: স্যার বলতেন মাতৃভাষা ছাড়া কোনো জাতি বা কারও উন্নতি করা সম্ভব নয়। আপনি কি তাই মনে করেন?

আহরার আহমদ: নির্দ্বিধায় এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেটার সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। কিন্তু এটাও বোঝা উচিত যে এটা যেন কোনো সংকীর্ণ একটা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে সীমাবদ্ধ না থাকে। অর্থাৎ আমারটাই শ্রেষ্ঠ, অন্য ভাষার প্রয়োজন নেই, আমাদের জীবনে, দর্শনে, আদর্শে, সাহিত্যে বা আমাদের বিজ্ঞানে তাদের কোনো স্থান নেই; এই ধারণাটা অনুচিত হবে এবং ক্ষতিকর। যে ভাষাতেই হোক, যেখানে কিছু শেখার বা নিজেদের উন্নতির সম্ভাবনা আছে, সেটা সাহিত্যে হোক, নন্দনতত্ত্বে হোক, বিজ্ঞানে হোক, শিক্ষায় হোক, সেগুলো গ্রহণ করতে গেলে আমাদের সেই ভাষাগুলোর সঙ্গে কিছুটা পরিচিতি থাকতে হবে। বলাই বাহুল্য যে, আমাদের শিক্ষার বিস্তারের জন্য এবং মৌলিক ভাষা হিসেবে বাংলা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে অন্য কোনো ভাষাকে হেয় না করে একটা উদার মানসিকতা বজায় রাখতে হবে।  

ডেইলি স্টার: আব্দুর রাজ্জাক নিয়ে আলোচনা হয় ঘরোয়া পরিবেশে। কিন্তু একাডেমিক আলোচনা সেই অর্থে নজরে আসে না কেন?

আহরার আহমদ: প্রধানত, স্যারের লেখালেখি বা রচনাকর্ম একটু সীমিত। কয়েকটি বক্তৃতা, কয়েকটি লেখা এবং সেগুলো আন্তর্জাতিক কোনো প্ল্যাটফর্মে নয়। তার ওপর ভিত্তিকরে একটা একাডেমিক আলোচনা দাঁড় করানো একটু কঠিন হয়ে যায়। সেজন্য আমরা রাজ্জাক স্যারকে স্মৃতি রোমন্থনে এবং ব্যক্তিগত গল্পে পরিণত করে এসেছি। এটা আরও সহজ হয়েছে এই কারণে যে তিনি এত বহুমুখী ধারার একজন মজার মানুষ ছিলেন। উনি যা বলেছেন, উনি যা করেছেন, উনি যে অনাড়ম্বর জীবন বেছে নিয়েছিলেন, যে আদর্শ আকঁড়ে রেখেছিলেন, চিন্তাজগতে তার ব্যাপ্তি এবং তার একনিষ্ঠ সাধনা এবং সব কিছু প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রবণতা, আমাদের বিস্মিত করেছিল, অভিভূত করেছিল। সেই জন্য স্যারকে ভুলতে পারি না, অনেক গল্প স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে।  

আশা করছি, স্যারের থিসিসটি প্রকাশিত হলে স্যারকে নিয়ে এই ধরণের কিছুটা সীমিত ও হালকা আলাপের বদলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমাপের এবং গভীরতর আলোচনার একটা সুযোগ আমরা পাব।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করলো। আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি কতদূর এগুলো বলে মনে হয়?

আহরার আহমদ: কিছু ব্যাপারে অভাবনীয় উন্নতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এইটা সবচেয়ে প্রযোজ্য, শুধু জিডিপি হিসেবে নয়, বহুমাত্রিক অগ্রগতি লক্ষ্যণীয় এবং বহুল প্রশংসিত। তবে এটাও ঠিক যে অর্থনৈতিক বৈষ্যম্য, বায়ুদূষণ, ব্যাপক দুর্নীতি, আইনের শাসনের দুর্বলতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন, সংখ্যালঘু এবং নারীদের নিরাপত্তার অভাব, এসবও মানুষের জীবনকে কিছু ব্যাহত করেছে।   

তবে প্রশ্নটা ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে। সাহিত্য সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারব না কারণ এটা মূল্যায়ন করার লেখাপড়া, অভিজ্ঞতা বা সাহস আমার নেই। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উন্নতি খুবই স্পষ্ট। আজ পঞ্চকবির গান এমনকি শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চা নিঃসন্দেহে অনেক বেড়েছে, সমাদৃত হয়েছে। আমাদের সময়ে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার জন্য কোনো মতে বলে-কয়ে হয়তো কয়েকজন শিল্পীকে হাজির করতাম। আজকে সেখানে আমরা দেখি যে একটা অনুষ্ঠানে একশ, দুশো, এমনকি এক হাজার ছেলেমেয়েকেও জড়ো করে সঙ্গীত পরিবেশন হচ্ছে। এই ব্যাপকতা আমাদের জন্য খুবই গর্বের বিষয়। আমাদের নৃত্য, নাটক, আবৃত্তি, ফটোগ্রাফি, চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, স্থাপত্য এবং সামগ্রিক অর্থে চারু ও কারুকলায় আমাদের উন্নতি নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল এবং অনুস্বীকার্য। তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে, জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, গবেষণার ক্ষেত্রে, পাণ্ডিত্য অর্জনের ক্ষেত্রে, সত্যিকার অর্থে আলোকিত মানুষ তৈরির ক্ষেত্রে, এই উন্নতি একইভাবে ঘটেনি। এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

ডেইলি স্টার: একবার আপনি বলেছিলেন আমরা চিন্তাচর্চায় এখনো কিছুটা পরাধীন ও বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। এটা ব্যাখ্যা করবেন?

আহরার আহমদ: এটা বিশেষ করে আমি বলেছিলাম আমাদের সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একাডেমিক গবেষণা সম্বন্ধে। অর্থনীতি ও ইতিহাসে আমরা অনেকখানি এগিয়ে আছি, অনেক গবেষক চিন্তাবিদ আছেন, যারা খুবই স্বনামধন্য। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন—দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা বেশ প্রকট। পুরনো কয়েকজন মহারথি ছাড়া এখানে নতুন উপস্থিতি খুব ক্ষীণ। তাই আমরা বিদেশিদের ওপর নির্ভর করি, তাদের উদ্ধৃত করি। আমাদের কাছে যদি বাংলাদেশ সম্বন্ধে ৫-৬টি বইয়ের নাম জানতে চাওয়া হয়,  তখন ভ্যন স্যান্ডেল, গ্যারি ব্যাস, ডেভিড লুইস, জো ডিভাইন, জিওফ উড, এরিল্ড এঙ্গেলসেন, জেনেট এরেন্স এবং অন্যান্যদের বইয়ের নাম আসবে, বাংলাদেশিদের উল্লেখ কম হবে। গত বছর লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এ Bangladesh at 50 শীর্ষক যে আলোচনা সভা হয়েছিল, সেখানে ৮ জন একাডেমিকের মধ্যে মাত্র একজন বাংলাদেশি স্থান পেয়েছিলেন। ঢাকাতেও যদি কোনো আলোচনায় বিদেশিদের আনতে পারি তবে আমরা নিজেদের খুব সার্থক এবং গর্বিত মনে করি। এটা শুধু কলোনিয়াল হ্যাঙ্গওভার নয়, এটা একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্পণ। এই মানসিকতা এবং এই পরিবেশটা, আমাদের পরিবর্তন করতেই হবে। আমাদের অনেক বুদ্ধি, প্রতিভা, সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু তার লালন, বিকাশ এবং উত্তরণের  ক্ষেত্রটি এবং নিজেদের ওপর আত্মবিশ্বাস আনার ব্যাপারে, যতটা করা সম্ভব ছিল, শক্তি ছিল, প্রত্যাশা ছিল, ততোটা আমরা অর্জন করতে পারিনি।
 

Comments

The Daily Star  | English
IMF lowers Bangladesh’s economic growth

IMF calls for smaller budget amid low revenue receipts

The IMF mission suggested that the upcoming budget, which will be unveiled in the first week of June, should be smaller than the projection, citing a low revenue collection, according to a number of finance ministry officials who attended the meeting.

2h ago