শুধু বাঘ দেখতে নয়, আনন্দ আর আলসেমি করতে গেলাম সুন্দরবন

আমরা ভেবেছিলাম যাই সুন্দরবন, দলেবলে বাঘ দেখে আসি। বাঘের দেখা যদি নাও পাই, নিদেনপক্ষে কুমির ও হরিণ দেখে আসি। তাই বেশ বড় একটা দল নিয়ে, চাঁদনি রাতকে সামনে রেখে, আমরা চললাম বাঘ দেখতে। তবে যাত্রা শুরুর ঠিক পরে পরেই বুঝতে পেরেছিলাম এ যাত্রায় বাঘ-কুমির না দেখলেও চলবে, সুন্দরবনে যেতে পারলেই হবে। কারণ এই ২৭টি মানুষ হৈচৈ করতে করতে যেভাবে খুলনাগামী ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ ট্রেনে চেপে বসলাম, সে আনন্দ লিখে বোঝানো যাবে না। অবিরত গল্প, হাসাহাসি, খাইদাই, পথে যেতে যেতে কতকিছু দেখা আর ছবি তোলা।
Sundarbans

আমরা ভেবেছিলাম যাই সুন্দরবন, দলেবলে বাঘ দেখে আসি। বাঘের দেখা যদি নাও পাই, নিদেনপক্ষে কুমির ও হরিণ দেখে আসি। তাই বেশ বড় একটা দল নিয়ে, চাঁদনি রাতকে সামনে রেখে, আমরা চললাম বাঘ দেখতে। তবে যাত্রা শুরুর ঠিক পরে পরেই বুঝতে পেরেছিলাম এ যাত্রায় বাঘ-কুমির না দেখলেও চলবে, সুন্দরবনে যেতে পারলেই হবে। কারণ এই ২৭টি মানুষ হৈচৈ করতে করতে যেভাবে খুলনাগামী  ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’  ট্রেনে চেপে বসলাম, সে আনন্দ লিখে বোঝানো যাবে না। অবিরত গল্প, হাসাহাসি, খাইদাই, পথে যেতে যেতে কতকিছু দেখা আর ছবি তোলা।

বিকেলে খুলনা পৌঁছানোর পর, পাশের ঘাট থেকেই ছেড়ে গেল আমাদের সুন্দরবন যাওয়ার ছোট জাহাজটি। জাহাজে যাত্রী শুধু আমরাই। বাকি চার দিনের জন্য এখানেই আমরা থাকবো, খাবো, ঘুমাবো, আনন্দ করবো। ভাবাই যাচ্ছে না আমরা রূপসা নদী দিয়ে ভেসে চলেছি। চাঁদনি রাত ছিল বলে সবাই মিলে জড়ো হলাম জাহাজের উপরের খোলা ডেকে। আলোকের ঝর্ণাধারায় ভেসে ভেসে আমরা মেতে উঠলাম গল্পে-গানে। উহ মানুষের পেটে কি এত গল্প থাকতে পারে? এই গল্প করতে করতেই হয়ে গেল রাতের খাবারের সময়। খুব সুস্বাদু সব খাবার তবে খানিকটা ঝাল। বলে রাখা ভালো নদীর রান্না একটু ঝালই হয়।

এখানে শোয়ার কামরাগুলোতে একতলা-দোতলা বিছানা, যা দেখে বাচ্চারা বেজায় খুশি। সুন্দরবনে যাওয়ার বেশ অনেকগুলো বিভিন্ন ধরনের জাহাজ আছে। ১০০/১৫০ জন থেকে শুরু করে ২৫/৩০ জনের গ্রুপের জন্য নৌযান আছে। এগুলোর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা মূলত একই রকম হলেও, সুবিধা ও আরামের উপর নির্ভর করে জনপ্রতি খরচ কত হবে। সুন্দরবন ভ্রমণের খরচ ১০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা হতে পারে জনপ্রতি।

সে যাক, খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আর মানুষের কলতানে। একি, এই সকালেই আবার গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে সবাই। জাহাজটি চলতে শুরু করেছে ভোরের কুয়াশা ভেঙে। সূর্য উঠেছে ঠিকই কিন্তু কুয়াশার জন্য চারিদিকে একটা হালকা আলো ছড়িয়ে আছে। ঘুম ঘুম চোখে সবাই হাতে চায়ের মগ নিয়ে গল্পের আসর জমিয়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে সবাইকে তাড়া দিয়ে গেল আমাদের গাইড। জাহাজের পেছনে যে দুটো নৌকা বাধা আছে, সেই নৌকাই আমাদের নিয়ে যাবে খাল দিয়ে আরও গভীরে। সে এক অপরূপ দৃশ্য। তরতর করে বয়ে চলেছে নৌকা। শুনশান নীরবতা। শুধু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পাশে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে কেওড়া, সুন্দরী গাছের সারি। সাথে আরও আছে অসংখ্য নাম না জানা গাছ।  এতগুলো মানুষ দু’নৌকায় ভেসে চলেছে ছোট্ট খালের ভেতর দিয়ে। কারো মুখে কোন কথা নেই, কারণ কথা বলা বারণ। শব্দ হলে শোনা যাবেনা সকালের পাখিদের কলতান। এভাবে ঘণ্টাখানেক ঘুরে, সূর্যোদয় দেখে দল ফিরে এলো জাহাজে।

নাস্তার পাট চুকিয়ে আবার গল্প, আলসেমি, ঘুম। গোসল, দুপুরের খাওয়া সেরে জাহাজের ডেকে লম্বা হয়ে শুয়ে ভাত ঘুম। চাকরি জীবনে ঢোকার পর আমরা সত্যি বলতে কী, এই ভাতঘুম ব্যাপারটা ভুলেই গেছি। অনেকদিন পর পাল্লা দিয়ে উপভোগ করলাম এই ঘুমটা। বিভিন্ন ধরনের আলসেমি ধাঁচের খেলা হলো -- লুডু, তাস। অদ্ভুত কাণ্ড যে এই পুরো চার/পাঁচটি দিনে আমাদের কাজকর্ম দেখে কেউ বলতে পারবে না যে, সুন্দরবনে আমরা কী আদতে বাঘ দেখতে এসেছি? নাকি ঘুমাতে আর চুটিয়ে আড্ডা মারতে? নাকি পেট ভরে মনমত সব খাওয়া খেতে? নাকি নদীর জলের উপর ভাসতে ভাসতে, গান শুনতে শুনতে চন্দ্রবিহার করতে?

সুন্দরবনে ঘুরবো কিন্তু বাঘের দেখা পাবো না, তা কি হয়? তাই এত আয়েশ ছেড়ে আমাদের দলের প্রায় সবাই বের হল ব্যাঘ্রদর্শনে বা বাঘের খোঁজে। সমুদ্রের তীর ধরে, বনবনানির মাঝ দিয়ে যেতে যেতে অভিযাত্রী দল বাঘের দেখা না পেলেও, তাদের পায়ের ছাপ দেখতে পেল। কেউ কেউ বাঘের বেশ তাজা একটা গন্ধও পেল। দেখলো সাপ-খোপ, বানর আর হরিণের দল। দু’ঘণ্টা টানা হাঁটা দিয়ে দুপুর নাগাদ অভিযাত্রী দল ফিরে এলো জাহাজে। জাহাজে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমরা দেখলাম কোথা থেকে এক ঝাঁক চিল উড়ে এলো এবং জাহাজটিকে ঘিরে চক্কর দিতে থাকলো। মাঝে মাঝে ছোঁ মেরে নদী থেকে মাছ তুলে নিচ্ছে। ওহ, কি যে অবাক করা দৃশ্য! চলতে চলতে আমরা পশুর নদীতে কিছু শুশুকের দেখা পেলাম। কটকা দিয়ে যাওয়ার সময় হরিণের দল দেখতে পেলাম, ওরা পানি খেতে এসেছে। মানুষ বা জাহাজ দেখতে দেখতে ওরা যে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, তা বোঝাই গেল ওদের “কুচ পরওয়া নেই” চাহনি দেখে।

প্রতিদিন বিকেলে আবার ঐ নৌকা দুটোতে চেপে চলে যেতাম আরও ভেতরের দিকে। উদ্দেশ্য প্রকৃতির নির্জনতাকে কাছ থেকে উপলব্ধি করা। এরপর মাঝ নদীতে ভাসতে ভাসতে চা-নাস্তা খেতে খেতে দেখলাম একদিকে সূর্য ডুবে গেল সারা আকাশকে লাল রঙে রাঙিয়ে, অন্যদিকে সোনার থালার মত চাঁদ উঠে গেল নদীর জলে তার জ্বলজ্বলে আলো ফেলে। আমরা মনে করতে পারলাম না এরকম কোন অপার্থিব সুন্দর দৃশ্য কি আগে কখনও দেখেছি? সবার কথা বন্ধ হয়ে গেল, শুধু একটার পর গান গেয়ে চললো নওরোজ আর সোমা ---

“আমরা মলয় বাতাসে ভেসে যাবো শুধু কুসুমের মধু করিব পান/

ঘুমাবো কেতকি সুবাস শয়নে, চাঁদের কিরণে করিব স্নান”

এভাবেই হেসে খেলে, আকাশ-বাতাস দেখে আমাদের চারটি আরামের দিন পার হয়ে গেল। এই চার দিনে আমরা এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে আলোচনা করিনি --- রাজনীতি, সমাজনীতি, গণমাধ্যম জগৎ, বিনোদন দুনিয়া, খাবার দাবার, দেশ-বিদেশ, পরিবেশ, ব্যক্তিগত গল্প এবং সর্বোপরি অসংখ্য হাসির গল্প। শেষ দিন রাত ৮টায় আমাদের ট্রেন খুলনা থেকে। জাহাজ চলছে। আমরাও গুছিয়ে নিচ্ছি আমাদের ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র। বিকেল৬ টার দিকে আমরা লক্ষ্য করলাম ঘাটে পৌছুঁতে আমাদের এখনও প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে যাবে।

ব্যস তারপর যা হওয়ার তাই হল। আমরা বেশ হেহে করতে করতে ট্রেন মিস করলাম। ২/৪ জন নয়, ২৭ জনের টিকেট গচ্চা গেল। শুধু তাই নয়, ঐদিন রাতে, পরদিন সকালে বা রাতে বাসে, ট্রেনে বা প্লেনে কোথাও কোন টিকেট নেই। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমাদের গাইডের সময় সংক্রান্ত হিসেবের সামান্য গড়বড়ের জন্য এই মহা বিপর্যয়। ঘাটে পৌঁছানোর পর সে লাপাত্তা। ঠিকমত যে বকাবকি করবো, এরও সুযোগ পেলাম না।

তারপর শুরু হল আমাদের চেষ্টা তদবির। কী উপায় হতে পারে, তার ভাবনা। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের পর একটি প্রায় লক্কর-ঝক্কর মার্কা বাসে করে রাত ১২টায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম ঢাকার উদ্দেশে। তারপরও কিন্তু আমরা হাসাহাসি থামাতে পারলাম না। অত:পর যাত্রার সর্বশেষ ঝামেলাকে আনন্দের আরেকটি উৎস মনে করে আমরা সদলবলে সকালে ঢাকায় এসে পৌঁছুলাম। বাঘ দেখা হলো না ঠিকই কিন্তু আরও যা দেখেছি, পেয়েছি তা বাঘ দেখার চেয়েও ঢের আনন্দের। বেড়ানোতে আনন্দের পাশাপাশি ছোট খাট ঝামেলা থাকতেই পারে কিন্তু থেমে গেলে চলবে না। বেড়ানো বন্ধ করলে হবে না।

ছবি: নাসের আহমেদ

Click here to read the English version of this news

Comments