নদীর নাম ময়ূরাক্ষী

ভ্যাঙ্কুভার শহর থেকে ৮০০ কিমি দূরত্বে লেক লুইস। কানাডার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় একটি ভ্যাকেশন স্পট এটি।

কানাডার গ্রীষ্ম বলতে যা বোঝায়, তার সঙ্গে কোনোভাবেই আমাদের দেশের গ্রীষ্মকে মেলানো যাবে না। এখানে গ্রীষ্মের সময় তাপমাত্রা কখনো আমাদের শীতকালের চেয়েও কম। তবে কানাডার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে গ্রীষ্মকালের কোনো তুলনা নেই। এমনই এক গ্রীষ্মে পুরো পরিবারের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম অ্যালবার্টার লেক লুইস দেখতে। ভ্যাঙ্কুভার শহর থেকে ৮০০ কিমি দূরত্ব তো আর একদিনে পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়, তাই মাঝপথে একদিন ক্যামলুপ্স নামক ছোট্ট একটি শহরে কাটিয়ে পরদিন আবার রওনা হলাম লেক লুইসের দিকে। কানাডার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় একটি ভ্যাকেশন স্পট এই লেক লুইস। কারণ এর মনোরম সৌন্দর্য। খুব ভোরে উঠেই রওনা হলাম। একবার পাহাড়ের গা বেয়ে; আরেকবার কয়েকটি পাহাড়ের মাঝে উপত্যকার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথের দু’ধারে ছবির মতো সুন্দর সব দৃশ্য! উঁচু পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তো একবার এমন ঘন কুয়াশা এসে ঘিরে ধরল যে আধ হাত সামনের রাস্তাও দেখা যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে পার হয়ে এলাম মাউন্ট রবসন। এই পরবতের কোলে রয়েছে ছোট্ট একটি বিশ্রামাগার। সেখানে থেমে মাউন্ট রবসনের সামনে চলল কিছুক্ষণ ফটোসেশন পর্ব।

এরপর আবার যাত্রা শুরু। প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা যাত্রা শেষে দেখা দিল কানাডিয়ান রকি মাউন্টেইনস। এই রকির কোলেই লেক লুইস। রকি মাউন্টেইনসের গ্লেসিয়ারের পানি থেকেই এই হ্রদের উৎপত্তি। প্রথম দেখায় আমার মাথায় যে চিন্তাটি এলো তা হলো, হুমায়ূন আহমেদ তার গল্পের বইতে যে ময়ূরাক্ষী নদীর কথা বলেছেন সেটি; যার পানি কিনা ময়ূরের চোখের চেয়েও স্বচ্ছ, তা কি এই লেক লুইস? দুটি পাহাড়ের মাঝখানে যতদূর চোখ যায় ঘন নীল রঙের স্বচ্ছ হ্রদ। কানাডায় এ যাবত দেখা সব জলাশয়ের পানিই স্বচ্ছ, কিন্তু এ যেন অন্য কিছু। পরে জানতে পারলাম এখানকার হ্রদগুলোতে গ্লেসিয়ারের পানির সঙ্গে ভেসে আসে পাথরকণা, যেগুলো পানির নিচের বালুর সঙ্গে মিশে নীল রঙ ছাড়া বাকি সব রঙের আলোর সঙ্গে প্রতিফলন ঘটায়। যার পানি ঘন নীল দেখায়। এই হ্রদটি শীতের মৌসুমে সম্পূর্ণ জমে যায়। ফ্রোজেন লেকে স্কেটিং করা কানাডিয়ানদের বেশ পছন্দের একটি বিনোদন।

যা হোক, হ্রদের ধারে অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম, বেশ কিছু ছবি তুললাম। একটা পাথরের ওপর বসে একটা পা একটু পানিতে ভেজালাম। জানা ছিল পানি অনেক ঠাণ্ডা, তবুও সারা শরীরে যেন কাঁপুনি ধরে গেল। এর মধ্যেই দেখি আমার একটু দূরে একদল ছেলে-মেয়ে হৈ হৈ করে উঠল। তাদের দলের একটি ছেলে এই ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করতে নেমেছে! একপাশে একটি বোটহাউস ও জেটি রয়েছে। সেখান থেকে একটি ক্যান্যু ভাড়া করে ঘণ্টাখানেক হ্রদে ঘুরে বেড়ালাম। পাহাড়ের কাছ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলাম।

লেক লুইসের পাড়েই কানাডার বিখ্যাত প্রায় দুশো বছর পুরনো ফেয়ারমন্ট শাতো অন দ্যা লেক হোটেল। অনেকের কাছে বেমানান মনে হলেও, দু’শতাব্দী পুরনো ইংরেজদের তৈরি এই বিশাল আর রাজকীয় দালানটিকে একটি স্থাপত্য নিদর্শন বলা চলে। আমার মতে, এটি লেক লুইসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি বৈ হ্রাস করেনি। দুপুরের খাবারটা এই হোটেলেরই একটি রেস্টুরেন্টে সেরে নিলাম। রেস্টুরেন্টটিও হোটেলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাঁটি ওয়েস্টার্ন ধাঁচে তৈরি। ঢুকলে মনে হবে যেন সত্তর দশকের কোনো আমেরিকান মুভির সেট!

প্রায় দু’আড়াই ঘণ্টা কাটানোর পর লেক লুইসকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম নিকটবর্তী লেক মোরেইনের দিকে। যখন লেক মোরেইনে পৌঁছালাম, প্রথমে মনে হলো এ তো লেক লুইসের কাছে কিছুই না। বেশ ছোট, পেছনে কিছু উঁচু পাহাড় অবশ্য রয়েছে কিন্তু লেক লুইসের মতো সবকিছু যেন খাপে খাপ মেলে না। পাশেই রয়েছে একটি পাথরের টিলা। সেখানে একটি ভিউপয়েন্ট

 রয়েছে। ১৫ মিনিট বেয়ে ওঠার পর যা উপলব্ধি করলাম তা হলো, নিচের দৃশ্য এ দৃশ্যের সিকিভাগও নয়। দশটি পাহাড়ের চূড়ার মধ্যখানে মুক্তার মতো এ হ্রদটি এখান থেকে না দেখলে অসম্ভব সুন্দর একটি দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত থাকতাম। পাইন গাছে ঘেরা এ হ্রদের পানিতে যেখানটায় পাহাড়ের ছায়া পড়ে, সেখানটা গাঢ় নীল আর যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে, সে অংশটা হালকা নীল।

দেখতে দেখতে সূর্য গড়িয়ে পড়ল। এবার হোটেলে ফেরার পালা। দু’ধারে বনের মধ্যের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি কয়েকজন রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে কিসের যেন ছবি তুলছে। কাছে গিয়ে দেখি পাহাড়ের গায়ে কয়েকটি ভালুকছানা! তাদের মা যে আশপাশেই কোথাও রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আরো কিছুদূর যেতেই দেখি একদল হরিণ রাস্তা পার হচ্ছে। সূর্যাস্তের সময় সব পশু নিজেদের আস্তানায় ফেরত যাচ্ছে। সারাদিন কোনো পশুর দেখা না পেলেও ফেরার পথের এই এক ঘণ্টায় ভালুক, হরিণ, ক্যারিবু, মাউন্টেইন গোট, মুজসহ প্রায় ৫-৬ রকমের পশুর দেখা পেলাম। অনেককেই দেখলাম আশপাশের পাহাড়গুলোয় ট্র্যাকিং, ক্যাম্পিং করছে। প্রকৃতির বুকে খোলা আকাশের নিচে এভাবে দু’এক রাত কাটাতে পারলে ইট-কাঠের জঞ্জালে ঠাসা শহুরে জীবনটা আর অত মন্দ লাগত না!

ছবি : লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Small businesses, daily earners scorched by heatwave

After parking his motorcycle and removing his helmet, a young biker opened a red umbrella and stood on the footpath.

2h ago