রামেকে ভেন্টিলেটর, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ও দক্ষ জনবল সংকট
গত ৪ জুন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের গেটের সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে কান্নার চিৎকার ভেসে এলো। তবে, কান্নার চিৎকারে কাউকে বিচলিত মনে হয়নি।
একজন রোগীর পরিচারক বললেন, ‘হয়তো কেউ মারা গেছেন। এখানে মৃত্যু প্রতিদিনের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
একটু এগিয়ে ওই ওয়ার্ডের বারান্দার এক কোনায় দেখা গেল, হাসপাতালের বিছানায় মায়ের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছে শম্পা আক্তার। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শম্পা তার মায়ের শরীর বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল এবং হাত দিয়ে মায়ের মুখ স্পর্শ করছিল। সে তার মাকে জাগানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু, তার মা রওশন আরার (৩৮) নিথর দেহটা বিছানায় পড়েছিল। হাসপাতালের অক্সিজেন মাস্কটি তখনও রওশন আরার মুখে লাগানো ছিল।
শম্পার বাবা শহিদুল ইসলাম এদিক-ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। তার দু’চোখ দিয়েও কান্নার অশ্রু ঝরছিল।
নওগাঁর রানীনগর উপজেলার সফিকপুর গ্রামের বাসিন্দা এই শহিদুল। অসুস্থ স্ত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্যে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ইউনিটে ভর্তি করান। কিন্তু, বাঁচাতে পারেননি।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী কিছু সময় আগে মারা গেছেন। আমি তাকে বাঁচাতে পারলাম না।’
শহিদুল জানান, করোনা আক্রান্ত রওশন আরার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে শনিবার নওগাঁর আত্রাই উপজেলার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সিলিন্ডারের অক্সিজেন দেওয়া হয়। কিন্তু, তিন ঘণ্টার মধ্যে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্যে রামেকে নেওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, সেখানকার সিলিন্ডারের অক্সিজেন তার জন্যে যথেষ্ট নয়। পরে রোববার ভোরে তাকে রামেকে আনা হয় এবং করোনা ওয়ার্ডে নেওয়া হয়। তখন রওশন আরার অক্সিজেনের স্যাচুরেশন ৭০ শতাংশে নেমে আসে।
ওই ওয়ার্ডের কর্মীরা জানান, রওশন আরাকে রামেকের যে ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছিল, সেখানে উচ্চপ্রবাহের অক্সিজেন যন্ত্র হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কার্যকর ছিল না। সেখানে শুধুমাত্র হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের লাইন এবং কিছু অক্সিজেন কনসেনট্রেটর দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা চলছিল।
শহিদুল বলেন, ‘আমরা উন্নত চিকিৎসার জন্যে এখানে এসেছিলাম। কিন্তু, এখানেও আমার স্ত্রী এলাকার হাসপাতালের মতোই চিকিৎসা পেয়েছে।’
রামেকের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা বলছেন, রওশন আরার মতো অন্তত ৪০ শতাংশ করোনা রোগী গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এসব রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল প্রায় ৬৫ শতাংশে নামার কারণে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র আশা হলো আইসিইউতে ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে উচ্চপ্রবাহের অক্সিজেনের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া। যা প্রতি মিনিটে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম। অথবা তাদের প্রয়োজন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, যা প্রতি মিনিটে ৭৫ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে।
তবে, এসব রোগীর অধিকাংশের ভাগ্যে জুটছে হাসপাতালের কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। যেগুলো প্রতি মিনিটে ১৫ শতাংশের বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম নয়।
ফলে, রামেকের করোনা ইউনিটে কম অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিয়ে আসা বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা।
হাসপাতালের তথ্য থেকে দেখা গেছে, বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করোনা ইউনিটে ২০ জন রোগী মারা গেছেন। একইসঙ্গে জুলাইয়ের প্রথম সাত দিনের মৃত্যু সংখ্যা ১২১। জুনে এই সংখ্যা ছিল ৩৫৪ এবং মে’তে ছিল ১২৪ জন।
গতকালও হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আরও একটি ওয়ার্ড বাড়ানো হয়েছে। মোট ১৪টি ওয়ার্ডে ৪৫৪ শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি ছিলেন ৪৭০ জন। প্রতিদিন গড়ে ৭০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
চিকিৎসকরা জানান, প্রায় পাঁচ শ রোগীর ৪০ শতাংশ অর্থাৎ অন্তত দুই শ জনের আইসিইউ বা হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সহায়তা প্রয়োজন।
তবে, রামেকে মাত্র ২০টি আইসিইউ বেড আছে। যা গত ১ জুন থেকে পুরোপুরি পূর্ণ থাকছে এবং কমপক্ষে ৯০ জন রোগীকে আইসিইউ শয্যার জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া, হাসপাতালটিতে ৬৯টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করা হয়েছে। যেগুলো ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত নয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক চিকিৎসক ডেইলি স্টারকে জানান, তার ৩২ শয্যার ওয়ার্ডটিতে এক সপ্তাহ আগে মাত্র একটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ছিল। রোগীদের মধ্যে সেটি সমন্বয় করে ব্যবহার করতে হয়েছে। গত ২৯ জুন তার ওয়ার্ডের হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সহায়তা দরকার এমন চার জন রোগী ছিলেন। যাদের বয়স ছিল ৩২ থেকে ৪২ বছরের মধ্যে।
তিনি বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিলাম চার রোগীর প্রত্যেককে তিন ঘণ্টা পরপর ন্যাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করব। এই সিদ্ধান্তটি কতটা নির্মম ছিল, তা কল্পনাও করতে পারবেন না।’
‘একজন রোগী থেকে মেশিনটা যখন অন্য রোগীর জন্যে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন তার ছেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠে। তারপর তার বাবার কাছ থেকে মেশিনটি সরিয়ে না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকে। কিন্তু, আমার কাছে বিকল্প কোনো উপায় ছিল না’, বলেন তিনি।
তবে, পরের দিন এই চিকিৎসকের ওয়ার্ডে আরও দুটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করা হয়।
রোববার ওই ওয়ার্ডের এক রোগীর পরিচারক ডেইলি স্টারকে জানান, বর্তমানে এখানে সাত জন রোগীকে তিনটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ভাগ করে দিতে হচ্ছে।
এদিন করোনা ইউনিটের ১৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে সাতটি ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন এই প্রতিবেদক। তিনি ১৪ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড দুটিতে কোনো কার্যকর হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দেখতে পাননি।
এই প্রতিবেদক জানতে পেরেছেন, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডেও কোনো ন্যাজাল ক্যানুলা নেই। সেখানে সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় অন্তত সাত জন রোগী মারা গেছেন। ১৫ নম্বর ওয়ার্ড, যেখানে শম্পার মা মারা গেছেন, সেখানে সোমবার পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় আট জন রোগী মারা গেছেন।
কিন্তু, রামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা বা ভেন্টিলেটর সংকটের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেছেন, ‘বড় হাসপাতালেও ২০টির বেশি ভেন্টিলেটর থাকে না। হাসপাতালের ৬৯টি ন্যাজাল ক্যানুলা যথেষ্ট এবং এখানকার জন্যে আরও ১০টি ন্যাজাল ক্যানুলা অনুমোদিত হয়েছে। তবে, সেগুলো এখনো পাওয়া যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘৬৯টি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার মধ্যে ৫৭টি ব্যবহার হচ্ছে… আমাদের যেটির অভাব আছে, তা হলো— মেশিনগুলো চালানোর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি। ভেন্টিলেটর চালানোর কর্মী আমরা তৈরি করেছি। তবে, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা পরিচালনার জন্যে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। হাসপাতালে সেগুলো চালানোর জন্যে দক্ষ জনবল নেই।’
রামেকের পরিচালক বলেন, ‘করোনা ইউনিটের ৪৮ শয্যার এইচডিইউ ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ২০টি ন্যাজাল ক্যানুলা দেওয়া আছে এবং রোগীরা সেখানে ভর্তি হওয়ার জন্যে পীড়াপীড়ি করেন। অন্যান্য সব ওয়ার্ডেও দুইটির বেশি ন্যাজাল ক্যানুলা সরবরাহ করা হয়েছে। তবে, সব ওয়ার্ডে প্রশিক্ষিত কর্মী নেই। এমনকি নওগাঁর রওশন আরার ওয়ার্ডে (১৫ নম্বর) দুটি ন্যাজাল ক্যানুলা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন হলে প্রশিক্ষিত কর্মীদের ভিন্ন ওয়ার্ড থেকে ডেকে নেওয়া হয়। আমরা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এজন্য কমপক্ষে ১০ দিন প্রয়োজন হয়।’
‘প্রতি মিনিটে অক্সিজেনের প্রবাহ যাতে ২০ লিটারের বেশি হয়, তা নিশ্চিত করতে ওয়ার্ডগুলোতে এক হাজার ৬০০ নন-রিব্রিদার মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে। নন-রিব্রিদার মাস্ক হলো একটি মেডিকেল ডিভাইস, যা একটি বেলুনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করতে সহায়তা করে। ১৮৩টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ও এক হাজার ১২২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১২টি বাইলেভেল পজিটিভ এয়ার প্রেশার মেশিন রোগীদের সহায়তার জন্যে পেয়েছে। ভেন্টিলেটরের মতো বাইলেভেল মেশিনগুলো অক্সিজেন ট্যাংক ছাড়াই বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন নিয়ে চাপ প্রয়োগে রোগীর ফুসফুসে ঢুকিয়ে দেয়। যখন কোনো রোগী শ্বাস নেয়, এটি বায়ুচাপ সরবরাহ করে এবং যখন কোনো রোগী শ্বাস ছাড়েন, তখন চাপটি হ্রাস করে’, বলেন পরিচালক।
রামেক পরিচালক আরও বলেন, ‘আমাদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন স্টক আছে। করোনা ওয়ার্ডে দৈনিক ছয় হাজার লিটার অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এর বিপরীতে হাসপাতালে একটি ১০ হাজার লিটার অক্সিজেন ট্যাংক ছাড়াও একটি ১৪ হাজার লিটারের অক্সিজেন ট্যাংক লরি স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে।’
‘আমাদের প্রয়োজন হলো— যে মেশিনগুলো আছে, তা পরিচালনার জন্যে প্রশিক্ষিত কর্মী,’ যোগ করেন তিনি।
তবে, রামেকের পরিচালক স্বীকার করেছেন যে, এক সপ্তাহ আগে কম অক্সিজেন স্যাচুরেশন রোগীর সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ ছিল এবং এখন তা কমেছে।
ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ রোগী গ্রাম থেকে আসছেন। তারা অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমার বিষয়টি প্রথমে বুঝতে পারেন না। যখন বোঝেন, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। অক্সিজেন স্যাচুরেশনের স্তুর ৬০ শতাংশে নেমে গেলে কোনো রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো খুব কঠিন।’
Comments