হাসান আজিজুল হক

রাঢ়বঙ্গের এক ভূমিপুত্রের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হয়ে ওঠা

বর্ধমান থেকে কাটোয়া মেইল ধরে গেলে রেল লাইনের দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর। চৈত্র বৈশাখে যা রুদ্ররূপ ধারণ করে। বর্ষায় আবার তা দিগন্ত প্রসারী জলের মাতন। বর্ধমান শহর থেকে কুড়ি মাইল দূরত্বের যে যবগ্রাম তা একবারেই পাড়াতলীর গাঁ। কাটোয়া মেইল ধরলে নিগণ স্টেশনে নামতে হয়, ওখান থেকে হাঁটা দূরত্বে যবগ্রাম। রাঢ়বঙ্গের রুক্ষ লাল মাটি। গণগণে আকাশের নিচে ফসলের খেত। চৈত্রের তাপ রুক্ষ জনপদকে তাতিয়ে তুলে। একসময় খরা ছিল সেখানকার নিত্য অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ বলে সমতল নয় মাটি, ঢেউখেলানো অসমতল ভূমিতে জ্যৈষ্ঠের উত্তাপে মাথাল বাদে খেতে দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব হয়ে যেত প্রায়। এখানকার লোকের সকাল শুরু হতো ভোরেরও আগে। মধ্য গগণে সূর্য উঠলে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ানোর সাধ্য নেই। অসীম জীবনযুদ্ধের সঙ্গে দোর্দণ্ড লড়াই। নিরক্ষরতা আর নিয়তির উপর বিশ্বাস জড়িয়ে ছিল জীবনের পুরোটা জুড়ে। রুক্ষ হলেও এই অঞ্চলে ধানের ফলন ছিল বেশ। তবুও এই অঞ্চলের ভাগ্যে যেন নিত্য দুর্ভিক্ষ। পাকানো পেশি আর পোড় খাওয়া মানুষের ভারে যখন কালবৈশাখীর রুদ্র তাণ্ডব শুরু হতো আকাশ জুড়ে মানুষেরা সেঁধিয়ে ঢুকতো মাচার তলে। এখানে বর্ষাও দিগন্ত উপচে পড়ার মতো।
বর্ধমানের যবগ্রামে শৈশবের পাকুড়গাছের তলে হাসান আজিজুল হক। ছবি কৃতজ্ঞতা- সাজ্জাদ বকুল

বর্ধমান থেকে কাটোয়া মেইল ধরে গেলে রেল লাইনের দুধারে দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর। চৈত্র বৈশাখে যা রুদ্ররূপ ধারণ করে। বর্ষায় আবার তা দিগন্ত প্রসারী জলের মাতন। বর্ধমান শহর থেকে কুড়ি মাইল দূরত্বের যে যবগ্রাম তা একবারেই পাড়াতলীর গাঁ। কাটোয়া মেইল ধরলে নিগণ স্টেশনে নামতে হয়, ওখান থেকে হাঁটা দূরত্বে যবগ্রাম। রাঢ়বঙ্গের রুক্ষ লাল মাটি। গণগণে আকাশের নিচে ফসলের খেত। চৈত্রের তাপ রুক্ষ জনপদকে তাতিয়ে তুলে। একসময় খরা ছিল সেখানকার নিত্য অনুষঙ্গ। রাঢ়বঙ্গ বলে সমতল নয় মাটি, ঢেউখেলানো অসমতল ভূমিতে জ্যৈষ্ঠের উত্তাপে মাথাল বাদে খেতে দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব হয়ে যেত প্রায়। এখানকার লোকের সকাল শুরু হতো ভোরেরও আগে। মধ্য গগণে সূর্য উঠলে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ানোর সাধ্য নেই। অসীম জীবনযুদ্ধের সঙ্গে দোর্দণ্ড লড়াই। নিরক্ষরতা আর নিয়তির উপর বিশ্বাস জড়িয়ে ছিল জীবনের পুরোটা জুড়ে। রুক্ষ হলেও এই অঞ্চলে ধানের ফলন ছিল বেশ। তবুও এই অঞ্চলের ভাগ্যে যেন নিত্য দুর্ভিক্ষ। পাকানো পেশি আর পোড় খাওয়া মানুষের ভারে যখন কালবৈশাখীর রুদ্র তাণ্ডব শুরু হতো আকাশ জুড়ে মানুষেরা সেঁধিয়ে ঢুকতো মাচার তলে। এখানে বর্ষাও দিগন্ত উপচে পড়ার মতো।

রাঢ়বঙ্গের সেই প্রকৃতির বিবরণ পাওয়া যায় ভূমিপুত্র হাসান আজিজুল হকের লেখায়, 'বোশেখ মাসের কোনো কোনো দিন বেলা থাকতেই ঈশেন কোণে একটুখানি কালো মেঘ সর সর করে এগোতে এগোতে আর দ্যাখ্ দ্যাখ্ করে বড় হতে হতে নিমিষে সারা আকাশে ভরে ফেলে। একেবারে দিনে দিনেই রাত নেমে আসে আর থমকে থেমে যায় সবকিছু। প্রকৃতি আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে না, আটকে রেখেছে নিজের ভেতরে। তার পরেই একেবারে প্রলয়-ঝড়। বড় বড় গাছগুলো উপড়ে, খড়ের চাল, টিনের চাল উড়িয়ে পুকুরে উথাল-পাথাল ঢেউ তুলে সব লণ্ডভণ্ড ছিঁড়ে খুঁড়ে একাকার! কতক্ষণই বা চলে কালবৈশাখী, দশ-পনেরো মিনিট? থামলেই মনে হয়, যাক, এবারের মতো প্রাণে প্রাণে বেঁচে গেল দুনিয়া। তারপরে ঝিরঝির করে ময়দা-চালা মোলায়েম বৃষ্টি, মেঘের তালায় সূয্যি, বেলা এখনো খানিকটা আছে। লাল আলো ছড়িয়ে হাসতে হাসতে ডুবছে সূয্যি।'

সেই যবগ্রাম। তখন যবগ্রাম তো বটেই তৎসংলগ্ন অঞ্চলে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা তখন ছিল হাতে গোনা। ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন মাত্র দুজন। স্কুল ডিঙিয়ে পঁচানব্বই ভাগেরই উঠার ভাগ্যের শিকেয় খুলেনি। এই গ্রামের মোহাম্মদ দোয়া বখশের একান্নবর্তী পরিবার ছিল বিশাল। ত্রিশের দশকের শেষ বছরের ভাদ্র মাসের কোন একদিনে গভীর রাতে জন্ম আজিজুলের। বাইরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হাওয়ায় সেদিন অঝোর বর্ষণ। ঘরের কোণে রেড়ির তেলের পিদিমটি টিমটিম করে জ্বলছে। বাইরে ভীষণ বাজ পড়ছে। ঢুলতে ঢুলতে রাত জেগে আছে দাই। কিন্তু কোনদিন জন্ম তা জানা নেই। তার জন্মের পর বাবা কিছুই লিখে রাখেননি।

জন্মের কয়েকদিন পরেই ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া বাঁধল তার। ঘরে তখন সবই আছে কেবল টাকার সংকট। তার জন্মের মাত্র বছর চারেকের মাথায় সেই দুর্ভিক্ষ পঞ্চাশের মন্বন্তর। এতদিন গোটা অঞ্চলে ছিল খরা, অভাব অনটন আর দুর্ভিক্ষ যেন পুরোপুরি নুইয়ে দিল চারাগাছের মতো মানুষকে। এই জনপদের প্রাণশক্তিকে শুষে নিলো দুর্ভিক্ষ।

হাসান আজিজুল হকের নানা ছিলেন পুরোনো কালের শিক্ষায় শিক্ষিত। বাংলায় ও ফারসিতে তার বেশ কয়েকটি পাণ্ডুলিপি লেখা ছিল। মাতৃগর্ভের সাত মাসে থাকাকালীন তার নানা মারা যান। তার খালাদের বিশ্বাস ছিল তাদের বাবা পুনরায় ফিরে এসেছেন।

হাসান আজিজুল হকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি গ্রামের স্কুলে। কিন্তু স্কুলে ভর্তি নিয়েও ভীষণ ঝামেলা হয়েছিল তার। স্কুলে ভর্তি হতে হলে তখন যে টাকা দরকার তাদের সেই টাকা নেই। খাবারের অভাব নেই বটে কিন্তু টাকার অভাব। নিগণ স্টেশনে তাদের এক লোকসানে পড়া মুদী দোকান ছিল। সেখান থেকেই শেষমেশ ব্যবস্থা টাকার হয়। তার বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ ছিলেন প্রায় সংসার বেখেয়ালি মানুষ।

ক্রমশ বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে শৈশব পেরোনো হাসান বুঝতে পারলেন বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন যেন খাপছাড়া। বাবা যেন দেখেও দেখছেন না। তবে মাঝেমাঝে আপাত ধীর মস্তকের অধিকারী দোয়া বকশ যখন শাসাতেন তখন গোটা বাড়ি গমগম করে উঠত।

হাসান আজিজুল হক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হয়ে গেল দেশভাগ। পরবর্তীতে যবগ্রামেরই মহারানী কাশীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই সাহিত্য চর্চায় হাতেখড়ি হয়েছিল হাসান আজিজুল হকের। স্কুলে একবার রাজা সৌমেন্দ্র চন্দ্র নন্দীর আগমন উপলক্ষে একটি সম্বর্ধনাপত্র রচনা করতে হয়েছিল তাকে। সেই তার প্রথম লেখার সূচনা।

ম্যাট্রিক পাশ করার পর তিনি চলে এলেন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায়। সালটা ১৯৫৪। মূলত বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে থেকে কলেজে পড়বেন এই ছিল লক্ষ্য। ভর্তি হলেন খুলনা শহরের অদূরে দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজে। সেই তার দেশত্যাগ। যে দেশত্যাগ পরবর্তীতে উঠে এসেছে তার গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে। কিন্তু তার একান্ত যে দেশত্যাগ তা তো একদম নিজস্ব। তাকে বাধ্য হতে হয়নি বটে চতুর্দিকে মানুষের দেশত্যাগের সেই নির্মম অনুভূতি অবলীলায় লিখেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন সে প্রসঙ্গে, 'এ দেশে চলে এলাম। তখন আমার বয়স ১৬ কি ১৭। এ দেশে আসার পর যেন জন্মান্তর ঘটে গেল আমার। সবুজ-শ্যামল মায়ায় ঘেরা দেশ। প্রথম যৌবনেই এক নদীবহুল, জমাট বাঁধা সবুজ রঙের হিরের মতো দেশে এলাম খুলনা শহরে। আমরা থাকতাম ভৈরব নদীর পারে।'

কিন্তু সেখানেও বেশিদিন স্থায়ী হলেন না তিনি। কারণ এই কলেজে দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয়েছিল হাসান আজিজুল হকের। যবগ্রামে থাকা অবস্থায় তার লেখালেখিতে সূচনা হলেও সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে হাতে খড়ি হয় খুলনার ব্রজলাল কলেজে পড়া অবস্থাতেই। নাসির উদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত 'মুকুল' পত্রিকায় হাসান আজিজুল হকের 'মাটি ও পাহাড়' গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। এর কিছুদিন পর ব্রজলাল কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হলো। ব্রজলাল কলেজ সাময়িকীতে তার লেখা ছোট গল্প 'লাঠি' প্রকাশিত হলো। একই সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন 'সাগর পারের পাখিরা' শিরোনামে একটি কবিতাও।

রাজশাহী চলে এসে তিনি ভর্তি হলেন রাজশাহী কলেজে। খুলনা থেকে তার রাজশাহী চলে আসার কারণ ছিল ব্রজলাল কলেজের অধ্যক্ষ রাজনীতি করার অপরাধে তিনি সহ বেশ কয়েকজন বামপন্থী দলের কর্মীর বৃত্তি আটকে রেখেছিলেন। যার ফলে বাধ্য হয়েই শেষমেশ তাকে গিয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল রাজশাহী কলেজে। বলে রাখা ভালো সাহিত্যচর্চার প্রথম দিকে হাসান আজিজুল হক মূলত কবিতাতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। 'বিনতা রায়: আমি', 'নিরর্থক', 'গ্রামে এলাম', 'দিনাবসান', 'কথা থাক', 'রবীন্দ্রনাথ' সহ নানা কবিতা তিনি লিখেছিলেন এই সময়। রাজশাহী কলেজে পড়ার সময়ে 'শামুক' নামে একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন তিনি। সেবার মানিক স্মৃতি উপন্যাস প্রতিযোগিতার আয়োজন করে হয়েছিল। এই উপন্যাসটি তিনি জমা দিয়েছিলেন সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য। যদিও এটি প্রতিযোগিতায় পুরস্কারের তালিকায় আসেনি। পরবর্তীতে 'শামুক' উপন্যাসের আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল রাজশাহী থেকে প্রকাশিত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত পূর্বমেঘ ত্রৈমাসিক পত্রিকায়।

তবে রাজশাহী আসার পর প্রথমে মিসবাহুল হাকিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র 'চারপাতা'য় তার একটি রম্য রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত সেই রচনাটির নাম ছিল 'রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য'। হাসান আজিজুল হক আলোচনায় আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়ার সময়। কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত 'সমকাল' পত্রিকায় 'শকুন' নামে তার একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। মূলত এই গল্পের মাধ্যমেই তার আবির্ভাব হয় মূলধারার সাহিত্যে। শকুন গল্পটা যে আমাদের সমাজের রুঢ় বাস্তবতা। শকুন গল্পে আমরা দেখি এক শোষকের শেষমেশ পরিণতি। যেখানে গল্পের মূল চরিত্রে এক শকুন। আটকে পড়া কিশোরেরা সেই শকুনকে তুলনা করে মহাজনের সঙ্গে। চিরকাল অত্যাচারী মহাজন আর অর্থলোভী জমিদারদের শিকড় উপড়ে ফেলার ধারণা পাওয়া যায় শকুনের পালক তুলে ফেলার মধ্য দিয়ে।

একই বছর পূর্বমেঘ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তার গল্প 'একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে'। এই গল্পটিতে তিনি এনেছেন এক বিস্বাদ ও বিবর্ণ জীবনের প্রতিকৃতি। যেখানে আমরা দেখি প্রৌঢ় সতিনাথ বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হলেও অতৃপ্ত যৌনজীবন। যার ফলে সে পরস্ত্রী ভামিনীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়। এই গল্পে হাসান আজিজুল হক সতীনাথ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, 'অজপাড়াগাঁয়ে খারাপ পাড়া বলে নির্দিষ্ট কিছু নেই। মাঝে মাঝে দুই একটি হাঁড়ি ডোম বাউরি কিংবা বান্দি মেয়ে মানুষ কুল ছিটকে রাণ্ডি হয়ে যায়। সেটা বেশি দৃষ্টিকটু হয়ে উঠলে ছোটলোক পাড়াতেও তার জায়গা নেই। বলে, শালী সতী লয়।' সমাজের বাস্তব চিত্র এখানে ফুটিয়ে তুলে এনেছেন হাসান আজিজুল হক। সতীনাথের মতো মানুষগুলো কেমন এড়িয়ে যায় সমাজ আর ভামিনীই শিকার হয় চরিত্রহীন পরিচয়ে। 'পূর্বমেঘ' পত্রিকায় 'একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে' গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে। এসময় প্রতিনিধিত্বশীল সবগুলো পত্রিকায় তার ছোটগল্প একে একে প্রকাশিত হতে থাকে। তিনি নিয়মিত লিখতে শুরু করেন 'পূবালী', 'কালবেলা', 'গণসাহিত্য', 'ছোটগল্প', 'নাগরিক', 'পরিক্রম', 'কণ্ঠস্বর' সহ নানান পত্রিকায়। বলছিলাম ১৯৬০ সালের কথা। সে বছরই হাসান আজিজুল হকের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল রাজশাহী সিটি কলেজে। একই বছর 'বৃত্তায়ন' নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু তখন তা প্রকাশিত হয়নি।

বছরখানেকের মধ্যেই রাজশাহী সিটি কলেজের চাকরি ছেড়ে হাসান আজিজুল হক চলে গেলেন সিরাজগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতা করতে। কিন্তু সেখানেও তার থিতু হওয়া হলোনা। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে গেলেন খুলনা সরকারি মহিলা কলেজে। এরপর কয়েক মাসের মাথায় চলে এলেন তারই ইন্টারমিডিয়েটের কলেজ খুলনার ব্রজলাল কলেজে। এখানে পড়ানো অবস্থাতেই ১৯৬৩ সালে নাজিম মাহমুদের সহযোগিতায় তিনি যুক্ত হলেন 'সন্দীপন গোষ্ঠী' নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে। সন্দীপন গোষ্ঠী গড়ে উঠার পিছনে ভূমিকা ছিল নাজিম মাহমুদ, মুস্তাফিজুর রহমান, জহরলাল রায়, সাধন সরকার, খালেদ রশীদ সহ বেশ কয়েকজন সংগ্রামী তরুণের শ্রম আর প্রচেষ্টা। এই গোষ্ঠী থেকে তারা একটি সাহিত্য সাময়িকীও নিয়মিত বের করতেন। এই পত্রিকাতে প্রকাশিত হতো ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও শিশু সাহিত্য। পরের বছরই প্রকাশিত হলো হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্পগ্রন্থ 'সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য'। এটি ছিল হাসান আজিজুল হকের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এই গল্পগ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছিল মোট ১০টি গল্প। প্রথম গল্পটিই শকুন। যে গল্পের মধ্য দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। 'পূর্বমেঘ' পত্রিকায় প্রকাশিত আরেক বিখ্যাত গল্প 'একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে' গল্পটিও ছিল এই গল্পগ্রন্থে।

হাসান আজিজুল হকের সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প বলা হয় 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'। একটি উদ্বাস্তু ও ছিন্নমূল পরিবারের চিত্র যেখানে তুলে এনেছিলেন হাসান আজিজুল হক। এই লেখাটি হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন ১৯৬৬ সালে, গ্রন্থাকারে এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে একই নামের গল্পগ্রন্থে। যেখানে আমরা দেখি একজন বাবা তার মেয়েকে দেহ ব্যবসার কাজে নিযুক্ত করেন। চারদিকে হাহাকার কাজ নেই। তবুও তো ক্ষুধা বাঁধ মানে না। ছিন্নমূল সেই পরিবার দেশে থাকতে তবুও কিছু করে খেতে পারতো কিন্তু এখানে এসে কি নির্মম অসহায়। যেখানে দেশভাগের যন্ত্রণা এসেছে সুতীব্রভাবে। হাসান আজিজুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এই গল্প প্রসঙ্গে, 'বর্ধমান থেকে ১৯৬১ সালে আমরা খুলনার ফুলতলায় চলে এসেছি। তবে আমরা তো বিতাড়িত হয়ে আসিনি, সামর্থ্য ছিল, নিজেরাই চলে এসেছি। কিন্তু সবার তো এই সামর্থ্য ছিল না। ওখান থেকে চলে আসার পরই আমরা খুলনার ফুলতলার এই বাড়িটি বদলাবদলি করে পেয়েছিলাম। সেখানে থেকে আশপাশের জীবন দেখতাম; আমাদের মতো উদ্বাস্তু আরও পরিবার এসেছিল। আমরা তো মোটামুটি স্বাবলম্বী হিসেবেই এসেছি। আমি দৌলতপুর কলেজে শিক্ষকতা করি, আমার ভাই চাকরি করে। আমাদের চলে যায়। কিন্তু সব মানুষের তো সে দশা হয়নি। তাদের এই রকম পরিস্থিতি হয়েছিল। সেটি বোঝানোর জন্য অর্থাৎ কী বিষবৃক্ষই না আমরা রোপণ করেছি ১৯৪৭ সালে—এই গল্পটি তাই লেখা।'

দেশ স্বাধীন হওয়ার দুবছর পর হাসান আজিজুল হক যোগ দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। এরপর তার জীবনের বাকিটা অধ্যায় জুড়ে সাহিত্যের পাশাপাশি রাজশাহী আর পদ্মাই ছিল চিরকালীন সঙ্গী। লিখেছিলেন তিনি আত্মসৃষ্টিতে, 'এখানে আসার পর পদ্মা নদী কাছ থেকে দেখলাম। তবে পদ্মার সঙ্গে আমার কখনো তেমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি। পদ্মার পাড় ধরে বন্ধুবান্ধবসহ হাঁটা, বাদাম খাওয়া—ওই পর্যন্তই। আসলে নির্জনে উপভোগ করার মতো বাস্তবতা পদ্মায় আমি সেভাবে পাইনি। মনে আছে, পদ্মার পাড়ে ঘোরাঘুরি শেষে ঠাকুরের দোকানের সন্দেশ খেতাম আমরা। সে কী অপূর্ব স্বাদ! আবার এমন হয়েছে যে সারা রাত প্রাণের বন্ধু আবু হেনা মোস্তফা কামালের সঙ্গে গল্পগুজব শেষে এক্কেবারে সকালে পদ্মাস্নান সেরে ফিরেছি। সে সময় এমনই বাতিক ছিল আমাদের। এ সবই '৬০ সালের ঘটনা। আমি তখন সবে সিটি কলেজে ঢুকেছি। নিয়মিত আড্ডা-আনন্দে পার হয়ে যাচ্ছে দিনগুলো।'

বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের বড় ধরনের প্রবণতা থাকে রাজধানী ঢাকা ছাড়া বুঝি সাহিত্যের মূল ধারায় স্থানলাভ সম্ভব নয়। ঢাকাই বোধহয় দেশের সাহিত্যের পীঠস্থান। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম হলেন হাসান আজিজুল হক। রাজধানী ঢাকার প্রলোভন তাকে কখনো টানেনি। বরং রাজশাহীই ছিল তার প্রাণের ঠিকানা। পদ্মাতীরের রাজশাহীতে বসেই তিনি দেশের মূল ধারার সাহিত্যের পুরোটা জুড়ে ছিলেন। রাজত্ব করেছেন বাংলা ছোটগল্পের, কথাসাহিত্যে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য ভাষা সৃষ্টি করেছেন। যে ভাষায় উঠে আসে রাঢ়বঙ্গের মানুষ, বাংলার জনপদ, মানুষের সরল নিয়মাচার, বিভক্ত দারিদ্র্যের কষাঘাত, দেশত্যাগের নির্মম প্রতিঘাত, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংলাপ। যে ভাষা বাংলা ভাষায় প্রতিনিধিত্ব করেছে তথাকথিত সাহিত্যরীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। তার সেই ভাষারীতি আমরা দেখতে পাইনা সচরাচর। তার সেই গল্প বলার কায়দা, শক্তিমান কথোপকথন যেমনটি আমরা দেখতে পাই আরেক প্রবাদপ্রতিম কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখায়। তারা দুজন বন্ধু ছিলেন। কিন্তু ইলিয়াস আর হাসানের মধ্যে সাহিত্যের সংলাপ ছিল ভিন্ন। দুজনের সাহিত্যেই নির্মম জীবনের সেই প্রগাঢ় নিঃসরিত রস আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে প্রচণ্ডভাবে। প্রবন্ধে হাসান আজিজুল হক যেমন ছিলেন দুর্দমনীয় তেমনি আত্মচেতনার বিকাশে ছিলেন কখনো কখনো নির্মম। তার সাহিত্যের ভাষা যেন আমাদের গ্রাম আর বাংলার মানুষের নিপুণ আলপনা।

কেবল সাহিত্যিক বা লেখক হিসেবে হাসান আজিজুল হককে পরিগণিত করলে ভীষণ ভুল হবে। যিনি একাধারে প্রতিনিধিত্ব করেছেন আমাদের সৃজনশীল সমাজকে, বুদ্ধিতাত্ত্বিক সমাজ গঠনে যিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সকাতরে। আমরা দেখতে পাই তিনি বারেবারে মুক্তবুদ্ধি প্রয়াসে চালিয়ে গেছেন নিজের ধ্যান, মন মনন। দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সচেতনভাবেই ছিলেন প্রথম সারিতে। কেবল কি তাই! তার মনোজগৎ জুড়ে ছিল মুক্ত বুদ্ধির প্রচেষ্টা। বারবার তিনি প্রতিটি দুঃসময়ে ক্রান্তিলগ্নে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেশের মুক্তবুদ্ধির চর্চায়, ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কিংবা দমন পীড়নের সমাজে তিনি ছিলেন মশালবাহকের মতো। ঝড় ঝঞ্ঝায় তিনি মাথা লুকিয়ে বাঁচতে চাননি। সে আমরা দেখি ব্লগার হত্যাকাণ্ডে, আমরা দেখি স্বাধীনতা বিরোধীদের ঘৃণ্য অপচেষ্টায় তিনি দমেননি একটি বারের জন্যও। এজন্য তাকে বারবার হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাকে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দিলেও তিনি ছিলেন স্বীয় আদর্শে অনড়, অবিচল। একটিবারও মাথা নোয়াননি ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে। শিল্প আর শিল্পীকে তিনি যেমন মিলিয়েছেন একপ্রান্তে অপর প্রান্তে আদর্শের এক নতুন দিগন্ত সচেতনভাবেই জাগরিত করেছেন পুরোটা জীবনে।

নিজের জীবন সম্পর্কে একবার এক সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, 'আমার এই জীবনটা ভাঙা–গড়ার ভেতর দিয়েই কেটে গেল। জীবনের এই সব ভাঙা–গড়াই নানাভাবে ফিরে ফিরে এসেছে আমার গল্পে, উপন্যাসে। তাই পেছনে তাকানোর কথা যদি বলো, আমি দেখতে পাই একটি কিশোর ছুটছে, ক্রমাগত ছুটছে।'

এটি ঠিক যে তার ছুটন্ত দৈহিক জীবন থেমে গেছে বটে, কিন্তু তার আদর্শিক পন্থা ও রাজনৈতিক সচেতন লেখকের ভাবনা আর একজন হাসান আজিজুল হকের সৃষ্টি তো বিরাজমান থাকবে অনন্তকাল। রাঢ়বঙ্গের সেই দুর্ভিক্ষপীড়িত নির্মম জনপদ থেকে উঠে আসা সেই ভূমিপুত্রের সৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করার সাধ্য কার?

[email protected]

সূত্র- ফিরে যাই ফিরে আসি/ হাসান আজিজুল হক

তাকিয়ে দেখি কি বিস্ময়/ হাসান আজিজুল হক

এই পুরাতন আঁখরগুলি/ হাসান আজিজুল হক

উঁকি দিয়ে দিগন্ত/ হাসান আজিজুল হক

হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকার/ জাকির তালুকদার

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi ship hijacked by Somalian pirates

MV Abdullah: Pirates bring in food as stock start to deplete

As food stock in the hijacked Bangladeshi ship MV Abdullah was depleting, pirates recently started bringing in food.

15h ago