সুখী ও সন্তুষ্ট শ্রমিক-শক্তিই শিল্পোন্নয়নের একমাত্র গ্যারান্টি
শ্রমিকের অধিকারের বিষয়ে ৪৮ বছর আগে নিজের ভাবনার কথা লিখেছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখতে এ প্রবন্ধ লিখেছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকে (১৯৭৩ সালের ১৯ জানুয়ারি)। ৩ সেপ্টেম্বর আবুল মনসুর আহমদের জন্মদিন উপলক্ষে লেখাটি দ্য ডেইলি স্টারে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
আমাদের অর্থনৈতিক জাতীয় জীবনে সামগ্রিকভাবে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠাই আমাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও সরকারী নীতি। আবার শিল্পায়নই আমাদের জাতীয় উন্নয়ন কর্মপন্থার প্রধান পদক্ষেপ। শিল্প ক্ষেত্রে সমাজবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আমরা চলতি শিল্পসমূহের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ব করিয়াছি। ভবিষ্যতের বৃহৎ ও ভারী শিল্পসমূহও রাষ্ট্রের মালিকানায় স্থাপন করা হইবে বলিয়া সরকারী শিল্প-লগ্নি-নীতি ঘোষণায় বলা হইয়াছে।
তাই প্রশ্ন উঠিয়াছে, শিল্প-শ্রমিকদের দায়িত্ব কি? অধিকারইবা কতটুকু? প্রশ্নটা সরকার তুলেন নাই। তোলা হইয়াছে শ্রমিকদের তরফ হইতেই। সরকারের মতে শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হইয়া যাওয়ার পর শ্রমিকদের আর দর কষাকষির মওকা নাই। সে অধিকারও কাজেই তাঁদের থাকিতে পারে না। শ্রমিকদের সমবেত দর-কষাকষি কলেকটিভ বার্গেনিং, তার মানে ষ্ট্রাইক করিবার যে মৌলিক অধিকার সর্বত্র স্বীকৃত, আমাদের সরকার গত অক্টোবরে ঘোষিত তাঁদের শ্রমনীতিতে সেই ষ্ট্রাইক নিষিদ্ধ করিয়াছেন। আমি যথাসময়ে এই সরকারী ঘোষণার সমালোচনা করিয়াছিলাম। শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারের সমর্থক প্রতিষ্ঠান শ্রমিকলীগও সরকারের ঐ ঘোষণার প্রতিবাদ ও উহা প্রত্যাহারের দাবী করিয়াছিলেন। সরকার এত দিন শ্রমিকদের ঐ প্রতিবাদে কান দেন নাই। কিন্তু মাত্র কয়েক দিন আগে শিল্পমন্ত্রী তার এক বক্তৃতায় বলিয়াছেন যে, সরকার তাঁহাদের পূর্ব ঘোষিত শ্রমনীতি পুনর্বিবেচনা করিতেছেন। ঐ পুনর্বিবেচনায় সরকার শ্রমিকদের ধর্মঘট করিবার অধিকার ফিরাইয়া দিবেন কি না, তা বুঝা যায় নাই। শিল্পমন্ত্রী তেমন কোন আশ্বাসও দেন নাই বা ইঙ্গিত করেন নাই। তথাপি শিল্পমন্ত্রী এক শ্রমিক সমাবেশ ঐ ভাষণ দিয়াছিলেন বলিয়া স্বভাবতঃই শ্রমিকরা আশা করিতে পারেন যে, সরকার তাঁদের শ্রমনীতিকে শ্রমিকদের অনুকূলে সংশোধন করিবেন। সমাজবাদের মোকাবিলায় শ্রমনীতি নির্ধারণ একটা দুরূহ ব্যাপার। বিশেষতঃ সে সমাজবাদ যদি প্রতিষ্ঠিত হয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে। আমাদের সরকারের লক্ষ্যও গণতন্ত্রী সমাজবাদ। গণতন্ত্র ও সমাজবাদ উভয়টাই আমাদের সংবিধানে সুনিশ্চিত। এ অবস্থায় গণতন্ত্রের পথ ছাড়া অন্য কোনও পথে সমাজবাদে পৌঁছার উপায় আমাদের সামনে খোলা নাই। যারা গণতন্ত্র বাদ দিয়া বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজবাদ স্থাপন করিতে চান, তারা অবশ্য সংবিধানের বাধা মানিবেন না। গণতন্ত্র তাঁদের কাছে বড় নয়, সমাজবাদই বড়। কিন্তু যাঁরা সংবিধান মানেন তাঁরা গণতন্ত্রের লম্বা প্রসেসের মধ্য দিয়াই সমাজবাদ প্রবর্তন করিতে বাধ্য। তাঁদের সামনে কোন সোজা ও খাট রাস্তা নাই।
কাজেই আমাদের বিবেচনা করিতে হইবে, এ অবস্থায় শ্রমিকদের অধিকার সংকুচিত করা ন্যায়সংগত বা আবশ্যক কি-না। সমাজবাদী রাষ্ট্রে দর কষাকষি বা কলেকটিভ বার্গেনিং এর, সুতরাং ধর্মঘট করিবার, অধিকারের কোনও প্রশ্নই উঠিতে পারে না।
কারণ, শ্রমিক মালিক না হইলে মজুরির দর-কষাকষি কোনও প্রশ্নই উঠিতে পারে না। শ্রমিক-আন্দোলনের জন্মই হইয়াছে পুঁজিবাদীদের মোকাবিলায় তাঁদের নিকট হইতে শ্রমের ন্যায্যমুল্য আদায় করিবার জন্য। সমাজবাদী রাষ্ট্রে মেহনতী জনতাই, তার মানে শ্রমিকরা নিজেরাই, সমস্ত শিল্পের মালিক। সব উৎপাদনযন্ত্রেরই এমনকি গোটা রাষ্ট্রেরই একচ্ছত্র মালিক তাঁরা। 'একচ্ছত্র' এই জন্য যে, যে রাষ্ট্রে 'তথাকথিত' বুর্জুয়া গণতন্ত্র বা ভোটাভোটির কারবার নাই। সেখানে চলে ডিক্টেটরশিপ অব দি প্রলেটারিয়েট। সর্বহারা শ্রমিকদের একনায়ত্ব। শিল্প কারখানা সেখানে শ্রমিকদের সকলের ও প্রত্যেকের। কাজেই শ্রমিকরা শ্রম করিতেছে নিজেদের সম্পত্তিতে। নিজের ক্ষেত-খামারে বা মিল-কারখানায় কাজ করিয়া কেউ বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করিয়াছে কোন দিন? অতএব, যুক্তিসঙ্গত কারণেই সমাজবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার থাকিতে পারে না। তার মানে, সে অধিকার নাই।
জনগণের, সুতরাং শ্রমিকদেরও স্বাধীনতা ও অধিকার সংকোচনের একাধিক যুক্তি থাকিতে পারে। কিন্তু গণ-মালিকানার যুক্তিতে এটা করা যুক্তি ও ন্যায়সংগত কি না, তার বিচার করা যাউক। আমাদের রাষ্ট্র আজও সমাজবাদী হয় নাই। সমাজবাদী হইবার ইচ্ছা করিয়াছিলেন। বলা যায়, আধাপথে আগ বাড়িয়াছে। কতক শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করিয়াছে আর কিছুতে ব্যক্তিগত মালিকানা রহিয়াছে। সংবিধানে 'উৎপাদনযন্ত্র ও উৎপাদন ব্যবস্থাসমূহের' তিন কিসিম স্বীকার করা হইয়াছে; রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তিগত। স্পষ্টতঃই আমাদের দেশের শ্রমিকরাই শিল্পের ক্ষেত্রে হরণ করা যায় না। যে সব রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে সমাজবাদী হইয়াছে, মানে যে সব দেশে সব উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদন ব্যবস্থা ও বিতরণ সংস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত হইয়াছে, সেখানকার কথাই আগে আলোচনা করি। তাতেই আমাদের দেশের অবস্থাও বলা হইয়া যাইবে।
সমাজবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিকদের কলেকটিভ বার্গেনিং এর অনাবশ্যকতা বলা হয় দুইটি যুক্তির বলে। এক. শিল্পের মালিক স্বয়ং শ্রমিকরা। দুই. পুঁজিপতিদের শিল্পের মতো সমাজবাদী শিল্পে মুনাফা করা হয় না। এই দুইটা দাবির মধ্যে মালিকানার দাবিটারই আলোচনা করা যাউক আগে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের মালিক শ্রমিকরা। এ কথাটার বাস্তব তাৎপর্য কি? কি হিসাবে কোন দিকে তাঁরা শিল্পের মালিক? দান-বিক্রি, ভোগ দখল, পরিচালনা-হস্তান্তর ইত্যাদি মালিকানার যে সব বাস্তব রূপ আছে, তার কোনটা শ্রমিকরা করিতে পারে? ব্যক্তিগত মালিকানার কথা বাদ দিলেও এজমালি মালিকানারই কোন্ দিকটা তারা ভোগ বা দাবি করিতে পারে? যে কোনও শ্রমিক যে কোনও শিল্পে যখন ইচ্ছা কাজ করিতে বা বেতন দাবি করিতে পারে? না, পারে না। সব জায়গাতেই চাকরি দেওয়া-নেওয়া আছে। রাষ্ট্র জনগণের হইলেও তার যেমন পরিচালনার জন্য সরকার থাকে, শিল্প শ্রমিকদের হইলেও তা পরিচালনার জন্য ম্যানেজার ডিরেক্টর থাকেন। ওয়াক্ফ সম্পত্তির মালিক স্বয়ং আল্লাহ্। তাও 'ম্যানেজ' করেন তাওয়াল্লিরা। এই সবই সুপরিচালনার জন্য পরিচালক-ম্যানেজার দরকার। শৃংখলা ও ডিসিপ্লিন আবশ্যক। এই কারণেই ম্যানেজাররাই আসল কর্তা। এজমালি মালিকানাটা সেও থিওরিটিক্যাল স্বত্ব, মানে কাগজে-কলমের ব্যাপার মাত্র। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পও অবিকল তাই। শিল্পের শ্রমিকরা চাকর মাত্র। ম্যানেজাররা তাদের নিয়োগ করেন। বেতন দেন। কাজের অযোগ্য প্রমাণিত হইলে ডিসমিসও করেন। ফলে, এখানকার সম্পর্কও 'এমপ্লয়ার' ও 'এমপ্লয়ির' সম্বন্ধ। কার কত বেতন হইবে তাও নির্ধারণ করেন নিয়োগকর্তারাই। কাজেই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের শ্রমিকদের পযিশনের চেয়ে কোন অংশেই শ্রেষ্ঠ বা পৃথক নয়। এ অবস্থায় প্রাইভেট শিল্পের শ্রমিকদের কলেকটিভ বার্গেনিং-এর অধিকার যারা মানেন, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের শ্রমিকদেরও সে অধিকার তাঁদের মানিতে হইবে।
তারপর ধরুন মুনাফার কথা। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে মুনাফা নাই। এ কথা ঠিক নয়। লগ্নির চেয়ে উৎপাদন বেশি, খরচার চেয়ে আয় বেশি করাই সব শিল্পকারখানা ও কায়কারবারের সাফল্যের মাপকাঠি। এই অতিরিক্ত আয় বা উৎপাদনের নামই 'সারপ্লাস ভ্যালু'। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভাষায় একেই বলা হয় 'সঞ্চয়' ও পুঁজিগঠন। এরই সহজ নাম মুনাফা। লগ্নির মতই মুনাফাটারও ব্যবহারের মালিকও লগ্নিকর্তা নিজেই। সে লগ্নিকর্তা রাষ্ট্রই হউক আর ব্যক্তিই হউক। উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহারও প্রায় একই ধরনের হয়। উভয় ক্ষেত্রেই মুনাফা বা সারপ্লাস ভ্যালুটা রিইনভেষ্ট বা পুনলগ্নিও করা যায়, আবার ভোগে বা কর্মীদের বেতন বৃদ্ধিতেও খরচ করা যায়। অতএব, সারপ্লাস ভ্যালু বা মুনাফার দিক দিয়া প্রাইভেট শিল্প ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে কোনও পার্থক্য নাই। কাজেই উভয়ের শ্রমিকদের দায়িত্ব ও অধিকার কোন পার্থক্য থাকিতে পারে না। সুতরাং দেখা গেল শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত জাতীয়করণ বা সমাজবাদ প্রবর্তনের নামে শ্রমিকদের অধিকার হরণ বা সংকুচন কোনও মতেই সমর্থন করা যায় না। এ অবস্থায় আমাদের দেশে আধাআধি সমাজবাদ প্রতিষ্ঠা করিতে গিয়াই সরকার যে শ্রমিকদের কলেকটিভ বার্গেনিং-এর অধিকার হরণ করিয়াছে, এটা ন্যায় বা যুক্তি সংগত হয় নাই।
শিল্প-ক্ষেত্রে শাস্তি ও স্থিতিশীলতা স্থাপনের ও উৎপাদনবৃদ্ধির যুক্তিতে শ্রমিকদের অধিকার সংকোচন বা হরণ করা যায়। কিন্তু এটা করিবার আগে সরকারকে প্রমাণ করিতে হইবে যে, এভাবে শ্রমকিদের অধিকার সংকুচিত না করিলে উৎপাদন বৃদ্ধি হইবে না এবং করিলে নিশ্চিতরূপে উৎপাদন বৃদ্ধি হইবে।
প্রথমতঃ ধরুন, শ্রমিকদের স্বাধীনতা ও অধিকার কেন হরণ বা সংকোচন করিতে হইবে? শ্রমিকদের এভাবে আইন করিয়া বাধ্য না করিলে তাঁরা কি উৎপাদন বাড়াইবেন না? শিল্পের উৎপাদন বাড়াইলে দেশের ভাল হইবে। এটা সরকার বা মন্ত্রি-মেম্বররা বুঝেন, শ্রমিকরা কেন বুঝিবেন না? বুঝিয়া-শুনিয়াও উৎপাদন বৃদ্ধি করিবেন না। বরঞ্চ বৃদ্ধির ব্যাঘাত সৃষ্টি করিবেন। মন্ত্রি-মেম্বর-অফিসাররা কেন না করিবেন? শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি না করা বা হ্রাস করা যে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, এটা শ্রমিকরা বুঝেন না? বুঝিয়াও দেশের ক্ষতি তাঁরা করিবেন, মন্ত্রি-মেম্বর-অফিসাররা কেন না করিবেন? শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধি না করা বা হ্রাস করা যে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর, এটা শ্রমিকরা বুঝেন না? বুঝিয়াও দেশের ক্ষতি তাঁরা করিবেন, মন্ত্রি-মেম্বর-অফিসারদের এমন মনে করিবার হেতু কি? তাঁরা কি শ্রমিকদের দেশের অনিষ্টকামী শক্র মনে করেন? শ্রমিকদের মধ্যে দেশপ্রেম নাই, শুধু মন্ত্রি-মেম্বরা অফিসাররাই দেশপ্রেমিক, এটাই কি তাঁরা মনে করেন?
তাছাড়া, দেশের ভালর সংগে শ্রমিকদের নিজেদের ভাল-মন্দ শিল্পের ভাল-মন্দের সাথে জড়িত। উৎপাদন বাড়িলে শিল্প বাড়িবে শিল্প বাড়িলে শ্রমিকদের চাকুরি বাড়িবে, বেতন বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়িবে, উৎপাদন না বাড়িলে শিল্প থাকিবে না। শিল্প না থাকিলে শ্রমিকদের চাকুরি থাকিবে না। চাকুরী না থাকিলে তারা স্ত্রী-পুত্র-কন্যা লইয়া পথে বসিবেন, এতসব জানিয়া-শুনিয়াও শ্রমিকেরা শিল্পের অনিষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হইবেন, তার মানে নিজেদের অনিষ্ট করিবেন-শ্রমিকদের এত নির্বোধ মনে করিবার কি যুক্তি সরকারের কাছে আছে? বাধ্য করিয়া বিরত না রাখিলে শিশুরা যেমন নিজ হাতে বিষ খাইয়া ফেলিতে পারে, আইন করিয়া শ্রমিকদের বাধ্য না করিলে তাঁরাও তেমনি শিল্প ধ্বংস করিয়া আত্মহত্যার প্রবৃত্ত হইবেন, শ্রমিকদের এমন নির্বোধ শিল্পমন্ত্রীরা কেন মনে করেন? জ্ঞান-বুদ্ধি ও দেশপ্রেমে শ্রমিকরা মন্ত্রি-মেম্বরদের চেয়ে কম, এমন অহংকার মন্ত্রি-মেম্বরদের অন্তরে স্থান পাইল কেমন করিয়া? তাঁরা কি ভুলিয়া গিয়াছেন, মন্ত্রি-মেম্বর-অফিসারের সংখ্যা যেখানে তিন-চার শ শ্রমিকদের সংখ্যা সেখানে তিন-চার লাখ? কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অত বেশি সংখ্যক লোকের দেশপ্রেমের বিচার-ভার অত অল্প-সংখ্যক লোকের উপর ন্যস্ত থাকিতে পারে না, সে অল্প-সংখ্যক লোক নির্বাচিত প্রতিনিধি হইলেও না।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের বিচার করিতে হইবে সরকার শ্রমিকদের অধিকার সংকুচিত করায়, বিশেষকঃ তাঁদের কলেকটিভ বার্গেনিং নিষিদ্ধ করায়, শিল্প উৎপাদান বৃদ্ধি হইয়াছে কি না? অন্য কোনও দিকে রাষ্ট্রের এবং গোটা দেশের কোনও লাভ হইয়াছে কি না? ঘটনাসমূহে স্পষ্টই প্রমাণিত হইয়াছে যে, সরকার শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার হরণ করিলেও শিল্পে প্রচুর ধর্মঘট হইয়াছে। ধর্মঘট নিষিদ্ধ না করিলেও যত ধর্মঘট হইতে পারিত, তার চেয়ে বেশিই হইয়াছে। আসল কথা এই যে, ধর্মঘটের অধিকার স্বীকৃত হইলেই ধর্মঘট হয় না, অধিকার অস্বীকৃত হইলেই তা বন্ধও থাকে না। আরও কঠোর সত্য এই যে, ধর্মঘটের অধিকার অস্বীকৃত হইলেই তা বন্ধও থাকে না। আরও কঠোর সত্য এই যে, ধর্মঘটের অধিকার অস্বীকৃত হইলেই ধর্মঘট আরও বেশি হয়। এটা সনাতন মানবচরিত্র। স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষের কোনও অধিকার নিষিদ্ধ করিলেই সে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মানব-মনে স্বাভাবিক জিদ চাপে। আমাদের বিয়ার কাবিনে তালাকের অধিকার দেওয়া থাকে। তাই বলিয়া সকলেই তালাক দেয় না। যাদের বিয়ার তালাকের অধিকার স্বীকৃত নাই, তাদের মধ্যে তালাক দেয় না। যাদের বিয়ার তালাকের অধিকার স্বীকৃত নাই, তাদের মধ্যে তালাক হয় না, এটাও ঠিক নয়।
সোভিয়েট ইউনিয়নের সংবিধানে প্রত্যেক অংগরাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার লেখা আছে। তাই বলিয়া সে অধিকার খাটাইবার জন্য কোনও অংগ রাজ্য ইউনিয়ন ত্যাগ করিয়া স্বাধীন হইয়া যায় নাই। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, মানুষ তার অধিকারের স্বীকৃতিটাই চায়, বিনা প্রয়োজনে সে অধিকার খাটাইতে চায় না।
শ্রমিকদের ব্যাপারটাও তাই। তাঁরাও কলেকটিভ বার্গেনিং-এর অধিকারটারই স্বীকৃতি চান, বিনা-প্রয়োজনে সে অধিকার খাটাইতে চান না। বিনা প্রয়োজনে কেন তাঁরা ধর্মঘট করিবেন? ধর্মঘট করাটা যে তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থেরই প্রতিকুল, দেশের স্বার্থের কথা ত পরের কথা। কাজেই নিতান্ত প্রয়োজন না হইলে, প্রতিকারের উপায়ান্তর থাকিলে, শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন না। ওটা ত্যাগের পথ, বিপদের রাস্তা, অনেক ঝুঁকি থাকে তাতে। বাধ্য না হলে সে ত্যাগ, বিপদ ও ঝুঁকির পথ কেউ অবলম্বন করে না। আমাদের 'ছয়দফা' দাবি পশ্চিমা ভাই-এরা মানিয়া নিলে আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যাইতাম না। এই ঘটনা দিয়াই সরকার ও সকলে শ্রমিকদের ব্যাপারটার বিচার করুন। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া মানিয়া লইলে ধর্মঘটের প্রশ্নই উঠিবে না। কাবিনের হাজার বার তালাকের অধিকার লেখা থাকিলেও সুখী দম্পতিদের মনে তালাকের কথা উকিও মারিবে না।
ঠিক তেমনি সুখী ও সন্তুষ্ট শ্রমিকদের অধিকার সংকুচিত করিবার কথা সরকারকে চিন্তাও করিতে হইবে না। এমন শ্রমিকদের হাতে শিল্প উৎপাদন সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকিবে। কাজেই শ্রমিকদের সুখ-সন্তোষ সাধনের ভাবনাই সরকারের করা উচিত আগে। তা করিতে পারিলে শ্রমিকদের আইনের শিকলে বাঁধিয়া তাঁদের নিকট হইতে কাজ আদায়ের চিন্তা সরকারকে করিতে হইবে না। শ্রমিকদের সুখী ও সন্তুষ্ট করিতে হইলে তাঁদের 'দাবি' মানিতে হইবে। তাঁদের দাবিগুলি কি এতই অপূরণীয় যে, সে দাবি দমাইবার জন্য সরকারকে কঠোর হইতে হইবে?
পুঁজিবাদী শিল্পপতিদের হাতে শ্রমিকরা কোনদিন সুবিচার পায় নাই, একথা পুঁজিবাদী দুনিয়ারও সর্বত্র সর্বজন স্বীকৃত। বেতনভাতা ও বাসগৃহ শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি স্বাভাবিক মানবিক অধিকার ত দূরের কথা, ঐসব অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ও সমবেত দাবি উত্থাপনের অধিকারটুকু পর্যন্ত বহুকালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দ্বারা আদায় করিতে হইয়াছে। শ্রমিক-কৃষক-রাজ কায়েম করিবার দাবিদার হইয়াও আমরা কি শ্রমিকদের ঐ স্বীকৃত ও ভুঞ্জিত অধিকারটুকুও কাড়িয়া নিব? শ্রমিকদের ঐক্য ব্যাহত করিবার উদ্দেশ্যে শিল্প মালিকরা 'পকেট ইউনিয়ন' গঠন করিয়া শ্রমিকদের মধ্যে দলাদলি ও রাজনীতি ঢুকাইয়াছেন, এসব কথা আই. এল. ও'র রিপোর্টেও স্বীকৃত হইয়াছে। শিল্প মালিকরা এইভাবে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত করিয়া নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য দেশের স্বার্থহানি করিয়াছেন। আমাদের জনপ্রিয় সরকারও কি তাই করিবেন? সুখী ও সন্তুষ্ট শ্রমিকরাই যে শিল্পোন্নয়নের একমাত্র গ্যারান্টি, এটা কি তাঁরা আজও বুঝিবেন না?
ইত্তেফাক। ১৯শে জানুয়ারি, ১৯৭৩
Comments