সরকারি ইতিহাসের আয়ু ক্ষণস্থায়ী: মহিউদ্দিন আহমদ

মহিউদ্দিন আহমদের জন্ম ঢাকায় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা অর্থনীতি নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পরে করেছেন সাংবাদিকতা। তারপর অধ্যাপক। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার সুংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টার্স ইন এনজিও স্টাডিজ’ বিভাগের।

মহিউদ্দিন আহমদের জন্ম ঢাকায় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা অর্থনীতি নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পরে করেছেন সাংবাদিকতা। তারপর অধ্যাপক। প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার সুংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মাস্টার্স ইন এনজিও স্টাডিজ' বিভাগের।

ইতিহাস নিয়ে সম্প্রতি মহিউদ্দিন আহমদের লেখা বইগুলোর পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, দিয়েছে জানা-অজানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বিস্তর তথ্য ঘেঁটে বইগুলোতে সবচেয়ে প্রামাণ্য তথ্যটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

গবেষণা,  লেখালেখি, বর্তমান সময় ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

আপনার বই পড়ে কেউ কেউ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন সামাজিক মাধ্যমে। নাম দিয়েছেন মহিউদ্দিন আহমদের 'ইতিহাস প্রকল্প'। বিষয়টা কিভাবে দেখেন।

মন্তব্য কিংবা সমালোচনা এক জিনিস আর গালাগাল হচ্ছে অন্য জিনিস। কেউ যখন তথ্য দিয়ে তথ্য খণ্ডন করতে না পারে, তখন সে গালাগাল করে, রুচিহীন মন্তব্য করে। ছাত্রজীবনে আমরা অনেকেই একটা কথা বলতাম- লেট দ্য ডগ বার্ক, বাট দ্য ক্যারাভান উইল মুভ ফরোয়ার্ড। গালাগাল হলো অক্ষমের আহাজারি। ওটাকে গুরুত্ব দিতে নেই।

আরেকটি কথা। রাজনীতি ও ইতিহাসে অনেক মিথ তৈরি হয়েছে। অনেকেই এসব মিথ ভাঙিয়ে খান। আমি এ রকম অনেক মিথ ভেঙে দিয়েছি। এটা অনেকের সহ্য হচ্ছে না। তারা মনে করেন, আমি লেখার মাধ্যমে তাদের অতীতকে প্রশ্নবিদ্ধ, বর্তমানকে নড়বড়ে এবং ভবিষ্যতকে ঝরঝরে করে দিচ্ছি। তারা  আমার ওপর প্রচণ্ড খেপে আছে।  

আবার অনেকে স্বীকার করছে যে, আপনার লেখায় অনেক ঐতিহাসিক সত্য উঠে আসে। এতে কোনোদিক থেকে বাধা আসে?

লিখতে গিয়ে অনেকসময় মনে হয়, এটি ছাপা হলে আমি বিপদে পড়ব কিংবা প্রকাশক বিপদে পড়বে। তখন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়। তবে যেটুকু লিখতে পারি, তা-ও কম না। লেখার বিষয়ে আমি তেমন কোনো বাধা পাই না। জাসদ নিয়ে বইটি, কিংবা আমার সর্বশেষ বইগুলোর একটি 'প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান' বইয়ের কিছু কিছু কথা নিয়ে কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করেছেন, মামলা-হামলার ভয় দেখিয়েছেন। এ পর্যন্তই। তারা আর এগোননি। তারাও হয়তো বোঝেন যে এতে কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে।

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইতিহাস চর্চার বিষয়টি সরকারের হাতে চলে গেলে আর ইতিহাস চর্চা হয় না৷ বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করুন।

সরকারের তো একটা রাজনীতি আছে। তা রাজনৈতিক দলের সরকার হোক কিংবা মিলিটারি সরকার হোক। তারা বা তাদের নিয়োগপ্রাপ্ত লোকেরা যখন লেখেন, তখন সেটি ইতিহাস হয় না, বন্দনাগীত বা ক্রোড়পত্র হয়। তারা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী মিথ তৈরি করেন। সেজন্য সরকার বদল হলে ইতিহাসও বদলে যায়। সরকারি ইতিহাসের আয়ু ক্ষণস্থায়ী। ইতিহাস চর্চা প্যাশনের ব্যাপার। লেখককে নির্মোহ হতে হয়। সরকারের পক্ষে সেটা অসম্ভব। 

অন্য এক জায়গায় বলেছিলেন বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সীমাবদ্ধতা কোথায়? কেন নতুনরা গবেষণায় কম আসে?

ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো তথ্যের সীমাবদ্ধতা। সরকারি দলিল-দস্তাবেজ ব্যক্তিপর্যায়ে পাওয়া যায় না। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এটা হাড়ে হাড়ে টের পান। দ্বিতীয়ত, সত্যিকার ইতিহাস লিখলে অনেক মিথ ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং সুবিধাভোগী উভয়ের চোখরাঙানি উপেক্ষা করার সাহস ও মনোবল থাকতে হবে। তৃতীয়ত, লেখককে হতে হবে নির্মোহ, পক্ষপাতমুক্ত। এটা হওয়া কঠিন, তবে সম্ভব। চতুর্থত, পাঠাককেও হতে হবে নির্মোহ। পূর্বধারণা সরিয়ে, রাজনৈতিক দলের চশমা খুলে রেখে খোলামনে ইতিহাস পাঠ করতে হবে। যাদের নিজেদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে, তাদের পক্ষে এটা খুব কঠিন। আমরা যেমন অনেকেই শরীরের ঘা বা ক্ষত ঢেকে রাখি, তারাও দলের অনেক কিছু গোপন রাখেন। সেগুলো প্রকাশ পেলে তাদের খুব অসুবিধা হয়। 

নতুনরা তো অনেকেই গবেষণায় আসছেন। তবে তাদের বেশিরভাগই হলো পিএইচডি থিসিস। একটা হাইপোথিসিস ধরে তারা এগোন। তার সুপারভাইজার খুশি থাকলেই হলো। এজন্য বেশিরভাগ থিসিস আলোর মুখ দেখে না, পাঠকের কাছে পোঁছায় না। তারা থিসিসগুলো রিমেক করে পাঠকের সামনে হাজির করলে আমাদের প্রবন্ধসাহিত্যের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ হতো।

আপনি মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতি বিশ্লেষক ও একজন গবেষক হিসেবে দেশ কতটা এগিয়েছে বলে মনে করেন? সামাজিক মুক্তি কতদূর? 

এগোনোর কোনো শেষ নেই। সামাজিক মুক্তির কোনো চূড়ান্ত ডেডলাইন নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাহিদা বদলে যায়। একসময় গড়ে দৈনিক ২২০০ ক্যালরির সমপরিমাণ খাবার জোগাড় করার সক্ষমতা না থাকাকে দারিদ্র্যরেখার নিচে রাখা হতো। এখন এই ব্যাখ্যা তামাদি হয়ে গেছে। এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানসম্মত আবাস, পানীয় জল ও বিদ্যুতের প্রাপ্যতা, স্যানিটেশন, বিনোদন, সিদ্ধান্তগ্রহণে অংশগ্রহণ সবকিছুই হিসাবে ধরা হয়। এখন তো ইন্টারনেট সংযোগ থাকা আবশ্যিক হয়ে গেছে। ফোন, টেলিভিশন, মোটরবাইক আর বিলাসদ্রব্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। এই বিবেচনায় আমাদের দেশ এখনো অনেক দরিদ্র। মানুষ যেদিন মনে করবে তার এসব চাহিদার বেশিরভাগই পূরণ হয়েছে, সে তখন নিজেকে স্বাধীন মনে করতে পারবে। সামাজিক মুক্তি গড় আয় দিয়ে নয়, সমাজে সবার মৌলিক চাহিদা মিটলে সামাজিক মুক্তির ভিত্তি তৈরি হবে। এটি একটি আপেক্ষিক ধারণা।

সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখা না রাখা নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে উত্তরণের উপায় কী মনে করেন?

মুখে যতই বাগাড়ম্বর করি না কেন, আমরা এখনো একটি জাতিরাষ্ট্র হয়ে উঠিনি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমরা এককাট্টা ছিলাম। পাকিস্তান দৃশ্যপট থেকে সরে যাওয়ার পর আমরা আবার পুরনো খাসলতে ফিরে গেছি। গদি একটা, দাবিদার অনেক। সেজন্যই এত মারামারি-কাটাকাটি। আধুনিক মন গড়ে ওঠেনি। নগরায়ণ হয়েছে। নাগরিক মনের বিকাশ হতে এখনো অনেক বাকি। যারা সমাজের নেতৃত্বে, রাজনীতি বলুন আর সংস্কৃতি বলুন, স্বভাবে অধিকাংশই গ্রাম্য মাতবরের মতো। আর অবচেতনে আছে স্থূল সাম্প্রদায়িকতা, স্বজনপ্রীতি, লুটেরা মনোভাব।

ভবিষ্যতে নতুন কোনো প্রজন্মের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসবে বলে আশা রাখি। তবে অনেক সময় লাগবে। মহাকালের ক্যানভাসে একশ দুইশ বছর কোনো ব্যাপারই না।

একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কি মনে হয় কাবুলবাসীর পতন হয়েছে, নাকি তারা মুক্ত হয়েছে, কী মনে হয়?

এ বিষয়ে দুই রকম দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে। এক, আফগানরা কী মনে করেন এবং দুই, যাদের সমর্থনে ও আশীর্বাদে এতদিন এক ধরনের সরকার ছিল, তাদের পক্ষের লোকেরা কী মনে করেন। এটি ব্যাখ্যা করতে হলে বিষয়টির গভীরে যেতে হবে। এখানে দুটি এলিমেন্ট আছে, সরকারের পেছনে দেশবাসীর সমর্থন আছে কি না এবং শাসনব্যবস্থা কেমন।

মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া মাত্র তাদের সমর্থিত সরকার হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। প্রেসিডেন্টসহ তাদের পক্ষের অনেক লোক দেশত্যাগ করল বা পালিয়ে গেল। অন্যদিকে, একের পর এক অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তালেবানের কব্জায় এসে গেল দেশ। এটা তো কোনো মিরাকল না। জনসমর্থন না থাকলে এত দ্রুত তালেবান জয় পেল কীভাবে?

মার্কিন মদদপুষ্ট সরকারের পেছনে সাধারণ মানুষ যে নেই, এটা প্রমাণ হয়ে গেল। যারা দেশ ছেড়ে বা পালিয়ে গেল, তাদের সঙ্গে আমাদের দেশে একাত্তরের রাজাকারদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। রাজাকাররাও অনেকে পালিয়ে গেছে, লুকিয়ে থেকেছে, গ্রেপ্তার হয়েছে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কচুকাটা হয়েছে। আফগানরা মনে করেন, হানাদার বাহিনী ও তার তাবেদার সরকারের হাত থেকে কাবুল মুক্ত হয়েছে। মার্কিনী ও তার সহযোগীরা মনে করেন কাবুলের পতন হয়েছে। একাত্তরেও পাকিস্তানি প্রচারে বলা হতো ঢাকার পতন হয়েছে। আমরা বলি অবরুদ্ধ ঢাকা মুক্ত হয়েছে। মূল বিষয়টি হলো আপনি টেবিলের কোন পাশে বসে দেখছে, রায় দিচ্ছেন। 

এবার দ্বিতীয় প্রশ্নে আসা যাক। তালেবানি শাসন সম্পর্কে বড় অভিযোগ হলো দুটি। প্রথমত, তারা কট্টর ইসলামি শরিয়াপন্থী। দ্বিতীয়ত, নারীর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই বৈষম্যমূলক। দুটোই আধুনিক উদারবাদী ও গণতান্ত্রিক সমাজে অচল। প্রশ্ন হলো, সমতাভিত্তিক উদারবাদী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনগণ গড়ে তুলবেন, নাকি বাইরে থেকে কেউ এটা চাপিয়ে দেবে। দেখা গেল, বিশ বছরে তৈরি হওয়া একটা 'গণতান্ত্রিক' ব্যবস্থা জনসমর্থনের অভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। বুঝতে হবে,  জনগণের রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক মান কোন পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশ সাম্য ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে স্বাধীন হয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে। কিছুদিন আগে হাইকোর্ট রায় দিলো, কোনো নারী নিকাহ রেজিস্ট্রার হতে পারবেন না। এখনো মুসলিম পারিবারিক আইনে দেশ চলে। সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারের ব্যাপারে নারী-পুরুষে বৈষম্য আছে। এগুলো কট্টর শরিয়া আইনের উদাহরণ।

অর্থাৎ আমরা আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের আরও সময় লাগবে। আফগানদেরও আরও সময় দিতে হবে, যাতে করে তাদের মনোজগতে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। এর চটজলদি সমাধান নেই।

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে রাজনীতিকরণ অনেক বেড়ে গেছে এবং এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, এমন দাবি করেন অনেকে। আপনি কীভাবে দেখছেন পরিস্থিতিটা?

সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ক্ষমতায় থাকতে কিংবা ক্ষমতায় যেতে তাদের সমর্থন পেতে রাজনৈতিক দলগুলো মরিয়া। অন্যদিকে, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও লোভ থেকে অনেক সরকারি কর্মকর্তা রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদ চান। এ কারণেই কর্মকর্তাদের মধ্যে রাজনীতিকরণ হচ্ছে।

গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন অপরিহার্য। আপনার অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা কী বলে?

নাগরিকেরা পছন্দের লোককে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চান। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এটা সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে ১৯৫৪ সালের পর দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। দলগুলো গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও বাস্তবে তারা একচেটিয়া ক্ষমতা ভোগ করতে চায়। নির্বাচনকে তারা ছেলেখেলায় পরিণত করেছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।

'৩২ নম্বর পাশের বাড়ি: ২৫ মার্চ ১৫ আগস্ট' বইটি ইতিহাসে কতটা ভিন্নমাত্রা যোগ করছে বলে আপনি মনে করেন?

২৫ মার্চ রাতে বেগম মুজিব তার দুই ছেলেসহ পশ্চিম পাশের বাড়িতে যেভাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেটি আমি প্রথমবারের মতো তুলে ধরেছি। এ তথ্যগুলো নতুন। পাশের বাড়ির কথা এর আগেও দু-একজন লিখেছেন। কিন্তু বাড়িটি কার সেটি উল্লেখ করেননি। ওই বাড়ির লোকেদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সম্পর্ক সম্বন্ধে এসব কথা এতদিন অজানা ছিল। পাশের বাড়ি বলতে অনেকেই ধরে নেন এটা পূর্ব দিকে বদরুন্নেসা আহমদের বাড়ি।

২৫ মার্চ রাতে বেগম মুজিব তার দুই ছেলেসহ পশ্চিম পাশে ডা. আহমদ সামাদ খান চৌধুরীর বাড়িতে যেভাবে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই তথ্যগুলো নতুন। পাশের বাড়ির কথা এর আগেও দু-একজন লিখেছেন। কিন্তু বাড়িটি কার সেটি উল্লেখ করেননি।

১৫ আগস্ট কী ঘটেছিল, তার চাক্ষুষ সাক্ষী তেমন বেশি নেই। বেশিরভাগ লোকই এন্থনি মাসকারেনহাসের বই থেকে কোট করেন। ওই বাড়িতে থাকা যে লোকগুলো বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা সবটা বলতে পারেন না। যিনি একতলায় ছিলেন তিনি দোতলার কথা জানেন না। যেটুকু দেখেছেন শুধু সেটুকুই বলতে পেরেছেন। এর বাইরে অনেক কিছু আছে যা আমার এ বইতে উল্লেখ করেছি। এটিও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাদের করও সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি বলে বিষয়গুলো এতদিন অজানা থেকে গিয়েছিল।

'জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি' তুমুল পাঠকপ্রিয় বই। সময়ের পালাবদলে রাজনীতির নিয়ে লেখার পাঠক কি বেড়ে গেল?

পাঠক বেড়েছে কি না তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কারণ, এ নিয়ে কোনো জরিপ নেই। অনুমানের ওপর নির্ভর করে বলতে হবে। ষাট, সত্তর ও আশির দশক ছিল ঘটনাবহুল। এর অভিঘাত এসেছে লেখাজোখায়। ফলে অনেক নতুন লেখককে আমরা পেয়েছি। তারা অনেকেই রাজনীতি নিয়ে লিখছেন।

এদেশে গল্প-উপন্যাস সবসময়ই জনপ্রিয় ছিল। সাহিত্য বলতে বোঝাত গল্প-উপন্যাস। এগুলোকে এক বর্গে বলা হয় কথাসাহিত্য। কেন বলা হয়, তা জানি না। অতীতে প্রবন্ধসাহিত্য সাহিত্যের মর্যাদা তেমন পায়নি। প্রবন্ধসাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি গদ্যে লেখা হয়। প্রবন্ধ মূলত একাডেমিক এবং রেফারেন্স-কণ্টকিত হয়। ফলে একাডেমিক সার্কেলের বাইরে তার ব্যাপ্তি সীমিত। প্রবন্ধ বা গবেষণামূলক লেখার গদ্যরীতি অতটা ঝরঝরে না, যেমনটি কথাসাহিত্যে দেখি। এখানে ভাষার কারিকুরি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা যদি ঝরঝরে না হয়, তা পাঠককে টানে না।

প্রবন্ধসাহিত্যের আরেকটি দুর্বলতা হলো, এতে প্রবন্ধকার যে কত জানেন, তা ফুটে ওঠে। প্রবন্ধকারের নিজের মতামত ও তত্ত্বকথা থাকে বেশি। পাঠক চান নতুন নতুন তথ্য, তত্ত্বের কচকচানিতে বিরক্ত হন।

আমার মতে প্রবন্ধসাহিত্যের ভাষা হতে হবে সহজ ও সাবলীল। তাতে জানা তথ্য ভিন্নভাবে তুলে ধরতে এবং অজানা বা নতুন তথ্য তুলে ধরতে হবে। এতে  গল্প থাকতে হবে। তাহলে পাঠকের কাছে তা বেশি আদর পাবে। একটা মোটাসোটা গবেষণার বই দেখে তো পাঠক এমনিতেই ভয় পান। বই হতে হবে এমন যে, তথ্যের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক তাতে গল্পের আমেজ পাবেন। এ রকম হলে প্রবন্ধসাহিত্য কথাসাহিত্যের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে না।

পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মধ্যে এই প্রতীতি জন্মেছে যে, আমার লেখায় পাঠক গল্পের স্বাদ পান, একটানা পড়ে যেতে পারেন। এটি আমি শুরু করি 'জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি'  বইটি দিয়ে। এর প্রথম মুদ্রণের দুহাজার কপি শেষ হয়ে গিয়েছিল এক সপ্তাহের মধ্যে। প্রথম মাসেই তিনটি মুদ্রণ হয়েছিল, প্রতিবার দুহাজার কপি। এখন তো বাজারে আছে ১৬তম মুদ্রণ। এ বইটি রাজনীতিসাহিত্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে বলে অনেক পাঠক মন্তব্য করেছেন এবং তারা আমাকে রাজনীতি বিষয়ের একজন লেখক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটি আমার জন্য পরম শ্লাঘার ব্যাপার।

এরপর এ ধারায় আমি রাজনীতি, রাজনৈতিক দল এবং নিকট অতীতের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই লিখেছি। সবগুলোই পাঠকপ্রিয় হয়েছে। আমি সবসময় চেষ্টা করি নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যবহার করে ও প্রয়োজনে প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা সাজাতে। আমি কোনো কেচ্ছা বানাই না।

আমার মনে হয়, রাজনীতি নিয়ে পাঠকের আগ্রহ আছে। তবে তাকে তত্ত্ব গেলানোর চেষ্টা না করে রাজনীতির গল্পগুলো, অজানা ঘটনাগুলো বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে আনতে পারলে পাঠকের কমতি হবে না।

দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে সরকার অনেক কিছু করছে। কিন্তু নৈতিক বিহেভিয়ারিয়াল চেঞ্জটা কেমন মনে হয়েছে?

উপনিবেশ-উত্তর পশ্চাৎপদ সমাজে এটা প্রকট। এখানে কাজের চেয়ে বাগাড়ম্বর বেশি। উন্নয়নের মূল শর্ত হচ্ছে প্রথমে মানবসম্পদের উন্নয়নে জোর দিতে হবে। সেজন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্ম সংস্থান তৈরির ওপর বেশি বিনিয়োগ দরকার। আমাদের এখানে বড় বড় স্থাপনা তৈরিকেই উন্নয়ন বলে প্রচার করা হয়। স্থাপনারও দরকার আছে। তবে তা মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। 

প্রায়ই দেখা যায়, সব বিষয়ে সরকারপ্রধানকেই মাথা ঘামাতে। সংসদীয় রাজনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ হাসিনার ভূমিকাকে কীভাবে দেখবেন বা কিভাবে দেখা উচিত?

সংবিধানটাই এমন। এখানে এক ব্যাক্তির শাসনকে নিশ্চিত করা হয়েছে। দল যেমন একক নেতৃত্বে চলে, সরকারও চলে একক নেতৃত্বে। মন্ত্রীরা বেশিরভাগই হ্যান্ডপিকড। শুরু থেকেই এমন অবস্থা। এর ফলে সুস্থ সংসদীয় ধারা গড়ে উঠছে না। তাছাড়া, ক্ষমতা তো সবাই পছন্দ করেন।

শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির চিন্তার সংকটে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ও কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

ঢাকা-কলকাতার দ্বন্দ্ব আসলে রাষ্ট্রবাদী দ্বন্দ্ব ও বিভাজনের প্রতিফলন। কিন্তু দুই বাংলার বুদ্ধিজীবিতার মূল সুরটি একই মনে হয়। একসময় ঢাকা পিছিয়ে ছিল। কারণ, এখানে মধ্যবিত্তের বিকাশ শুরু হয়েছে দেরিতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবধান কমে আসছে। তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভারত এগিয়ে আছে বলে কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা বেশি মাত্রায় স্বাধীন ও খোলামেলা। গণতান্ত্রিক সহনশীলতাও সেখানে বেশি। কথায় কথায় বই নিষিদ্ধ করার দাবি সেখানে ওঠে না। 

আপনি অর্থনীতির ছাত্র হয়ে শিক্ষাজীবনে জড়িয়ে ছিলেন ছাত্র রাজনীতিতে। ১৯৭০ এর ডাকসু নির্বাচনে মুহসীন হল থেকে সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আগের ছাত্র রাজনীতি আর বর্তমান ছাত্র রাজনীতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ কী?

ছাত্ররাজনীতি বরাবরই ছিল জাতীয় রাজনীতির অংশ। জাতীয় রাজনীতি যেভাবে বদলেছে, ছাত্ররাজনীতিও সেভাবেই পাল্টে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই মাস্তানতন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি।

'লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতি' বইটি নিয়ে আপনার ইতিহাসবোধের জায়গা থেকে কতটা চিন্তা পরিষ্কার করতে পারছেন বলে মনে হয়?

এ বইয়ে আমি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। সত্তর দশকের প্রথম বছরগুলোয় দুজন ব্যক্তি এদেশের রাজনীতিতে ঝড় তুলেছিলেন। তরুণদের তারা প্রভাবিত করেছিলেন সবচেয়ে বেশি। তারা হলেন সিরাজুল আলম খান এবং সিরাজ সিকদার। তারা রাজনীতিতে ঝড়ো হাওয়ার সূচনা করেছিলেন। দুটোর পরিণতিই বিয়োগান্তক। সিরাজুল আলম খান নানাভাবে উঠে এসেছে আমার একাধিক বইয়ে। সিরাজ সিকদার ও তার সর্বহারা পার্টি নিয়ে তেমন কোনো বই নেই। যা আছে, তা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা। তাতে কেবল একটা খণ্ডচিত্র পাওয়া যায়। আমি চেষ্টা করেছি দলটির জন্ম-ইতিহাস থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত পরিক্রমাটি লেখার। সেজন্য এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি।

এটা লিখতে গিয়ে সিরাজ সিকদার ও তার দলের রাজনীতি সম্পর্কে আমার মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে। এমন কিছু গোপন দলিল সংযোজন করেছি, যা এই দলের লোকেরাও জানতেন না। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়টিকে বুঝতে এ বইটি বেশ খানিকটা সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি। নতুন প্রজন্মের যারা সিরাজ সিকদারের ভক্ত বা অনুসারী, তারা বেশিরভাগই এসব জানেন না। দলের লিফলেট পড়ে তো আর সবকিছু জানা যায় না। এ বই তাদের বিশ্বাসের জায়গায় কিছুটা হলেও ঘা দিয়েছে। কেউ কেউ অতিপ্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তারা অনেকেই আমার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মুশকিল হলো, তারা কেউ নিরপেক্ষ নন। দল বা বিশেষ একটি রাজনীতির চশমা পড়ে বইটিকে দেখলে আমার প্রতি সুবিচার করা হবে না।

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

1h ago