নজরুলের পূর্ববঙ্গ সফর

বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, বিরহের কবি, তারুণ্যের কবি— কত অভিধায় ভূষিত করা হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। সবকিছুর বাইরে ভ্রমণপ্রেমী নজরুল যেন আমাদের কাছে অনাবিষ্কৃতই থেকে যান।
চট্টগ্রাম সফরে সীতাকুণ্ডের ঝর্ণায় ঘুরতে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, বিরহের কবি, তারুণ্যের কবি— কত অভিধায় ভূষিত করা হয় কাজী নজরুল ইসলামকে। সবকিছুর বাইরে ভ্রমণপ্রেমী নজরুল যেন আমাদের কাছে অনাবিষ্কৃতই থেকে যান।

আজকের এই লেখা নজরুলের বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) সফর নিয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম বারবার এসেছেন সে সময়ের পূর্ব বাংলায়। কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো আত্মগোপনে, কখনো কাজের সুবাদে, কখনো শুধুই ভ্রমণে, কখনো আমন্ত্রণে বা আড্ডা-গান-কবিতা পাঠে আসর জমাতে এসেছেন তিনি। পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশে হয়েছে তার অন্তিম শয্যা।

পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম এদেশে এসেছিলেন ১৯১৪ সালে। সে সময় আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করা নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন আসানসোল মহকুমার দারোগা রফিজউল্লাহ। পরের বছরই নজরুল ফিরে যান রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে। সে সময় নজরুল ছিলেন কাজীর শিমলা ও দরিরামপুর অঞ্চলে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নজরুল পূর্ববঙ্গ প্রথম সফর করেন ১৯২০ সালে।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ভাগ্নে ইউসুফ আলীর আমন্ত্রণে ১৯২০ সালের অক্টোবরে বরিশাল সফরই ছিল সত্যিকার অর্থে নজরুলের প্রথম পূর্ববঙ্গ সফর। আশ্বিন মাসের পূজার ছুটিতে সেবার নজরুল এসেছিলেন বরিশালে। নজরুলের ২ দিনের সেই সফর ছিল রাজনৈতিক। তার সঙ্গী ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।

নজরুলের সেই সফরের স্মৃতি পাওয়া না গেলেও নজরুলের দ্বিতীয় উপন্যাস 'মৃত্যুক্ষুধা'তে বরিশালের একটি অংশ আছে। নজরুল লিখেছিলেন, 'বরিশাল। বাংলার ভেনিস। আঁকাবাঁকা লাল রাস্তা।'

দৌলতপুরের আলী আকবর খান কলকাতায় নজরুলের কাছাকাছি থাকতেন। ১৯২১ সালে আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুল গিয়েছিলেন কুমিল্লার দৌলতপুরে। এটিই তার প্রথম কুমিল্লা সফর। পথে কুমিল্লা শহরের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের কান্দিরপাড়ের বাসায় যাত্রা বিরতি নিয়েছিলেন।

সেই বাড়িতেই ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ভাইয়ের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নজরুলের। আশালতা সেনগুপ্তের ডাকনাম ছিল দোলনা। শৈশবে বাবাকে হারানো দোলনা বেড়ে উঠেছিলেন কাকা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পরিবারেই। সময়টা ছিল চৈত্রমাস।

দৌলতপুরে নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয়। বাসর রাতেই নজরুল নার্গিসকে না বলে একা দৌলতপুর থেকে কুমিল্লা চলে যান। এর সপ্তাহ তিনেক পর কলকাতা থেকে আসা এক বন্ধুর সঙ্গে নজরুল ফের কলকাতায় ফিরে যান। তবে মাত্র ৩ মাস পরেই ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নজরুল আবার কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। সেই সফরে ৫-৬ সপ্তাহ ছিলেন।

১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'আনন্দময়ীর আগমনে' ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশিত হলে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। নিষিদ্ধ হয় ধুমকেতুর সেই সংখ্যা। তখন নজরুল আত্মগোপনের জন্য কুমিল্লায় চলে আসেন। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর নজরুলকে গ্রেপ্তার করে কারাবন্দি করে ইংরেজ প্রশাসন। তাকে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলে ৩ মাস পরই মুক্তি পান নজরুল। এরপর তিনি ফের এসেছিলেন এবং আশালতা সেনগুপ্তকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আশালতা সেনগুপ্তের মা গিরিবালা দেবী ছাড়া আর কারোরই এই বিয়েতে সম্মতি ছিল না। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় বিয়ে হয়েছিল নজরুল ও আশালতা সেনগুপ্ত বা প্রমীলা দেবীর। নজরুল মোট ৫ দফায় কুমিল্লায় এসে থেকেছিলেন প্রায় ১১ মাস।

নজরুল প্রথম ফরিদপুরে এসেছিলেন ১৯২৫ সালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিতে। ফরিদপুরে মোট ৭ বার এসেছিলেন নজরুল। তার আগমনের হেতু ছিল যথাক্রমে- কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দেওয়া, মৎস্যজীবী সম্মেলনে যোগদান, নির্বাচনী প্রচারের কাজে, কৃষি-শিল্প সংস্কৃতি সম্মেলনের অতিথি হিসেবে, জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনীতে যোগদান, ফরিদপুর সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের ছাত্র সম্মেলনে যোগদানের অনুষ্ঠান। ১৯৪১ সালে ফরিদপুরে জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের ছাত্র সম্মেলনেই নজরুলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।

১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় প্রথম আসেন নজরুল। সেই সফরে মাত্র ২ দিন ঢাকায় ছিলেন তিনি।

তবে নজরুলের পরের সফর ভীষণ আলোচিত। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে অতিথি হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন নজরুল। উঠেছিলেন বর্ধমান হাউসে। সে সফরে নজরুল ঢাকায় ছিলেন ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেই বছরের আষাঢ় মাসে ঢাকায় আবার এসেছিলেন নজরুল।

আষাঢ় মাসে নজরুলের সেই ঢাকা সফর পাওয়া যায় বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুর বর্ণনায়। সেই সফরে প্রতিভা বসুকে গানও শিখিয়েছিলেন নজরুল। 'জীবনের জলছবি গ্রন্থে রানু সোম বা প্রতিভা বসু লিখেছিলেন, `মস্ত বড় বড় কালো টানা চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রং, সহজ সরল অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা, সবটা মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে।'

নজরুল ঢাকায় এসেছেন মোট ৬ বার। সুস্থ অবস্থায় নজরুল সর্বশেষ ঢাকায় আসেন ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বেতারের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।

পুরনো ঢাকায় নাজিমুদ্দিন রোডে একটি ভাড়া করা বাড়ি থেকে প্রচারিত ঢাকা বেতারে নজরুল 'পূর্বলি' নামের একটি গীতবিচিত্রা পরিচালনা করেছিলেন।

নজরুলের পূর্ববঙ্গ সফরে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে চট্টগ্রাম সফর। চট্টগ্রামে নজরুল এসেছিলেন চার বার। প্রথমবার ১৯২৬ সালে। দ্বিতীয়বার ১৯২৯ সালে তৃতীয়বার ১৯৩৩ সালে এবং সর্বশেষ অসুস্থ অবস্থায় ১৯৭৩ সালে।

১৯২৬ সালে চট্টগ্রাম সফরে কাজী নজরুল ইসলাম। পাশে হবীবুল্লাহ বাহার ও অধ্যাপক হেমন্তকুমার। ছবি: সংগৃহীত

১৯২৬ সালে নজরুল চট্টগ্রামে প্রথমবার এসেছিলেন সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও শামসুন্নাহার মাহমুদের আমন্ত্রণে। সেই সফরে নজরুল হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর অনুরোধে ফেনীও সফর করেছিলেন।

১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলের দ্বিতীয়বারের জন্য এসেছিলেন চট্টগ্রামে। নজরুলকে নিয়ে 'মোহাম্মদী' পত্রিকায় সমালোচনা হলে চট্টগ্রামবাসী ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুলকে ব্যাপক সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। সেই সফরে বন্ধু ও বিখ্যাত রাজনীতিবিদ কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সঙ্গে সন্দ্বীপে তার বাড়িতে গিয়েছিলেন নজরুল। তৎকালীন সময়ে সন্দ্বীপ ছিল নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত। সন্দ্বীপের কার্গিল স্কুলমাঠে নজরুলকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল।

সেই সফরে নজরুল সীতাকুণ্ড ঝর্ণা, চন্দ্রনাথ পাহাড় দর্শন করেছিলেন। চন্দ্রনাথ পাহাড় নিয়ে তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গান, 'আকাশে হেলান দিয়ে, পাহাড় ঘুমায় ঐ!'

১৯৩৩ সালের চট্টগ্রাম সফরই ছিল নজরুলের সুস্থ অবস্থায় শেষ চট্টগ্রাম সফর। নজরুলের সেই সফরের আয়োজক ছিলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও কথাসাহিত্যিক মাহবুব-উল আলম। সেই সফরে নজরুল বেশ কয়েকটি এলাকায় সফর করেছিলেন। যদিও তার এই সফরে মুখ্য ছিল রাউজান তরুণ কনফারেন্স ও শিক্ষা সম্মিলনীতে যোগদান। সেখানে নজরুলকে একনজর দেখতে এসেছিলেন অজস্র মানুষ।

নজরুল শেষ চট্টগ্রামে এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে। তার বয়স তখন ৭৫। তিনি তখন রোগাক্রান্ত হয়ে বাক ও স্মৃতিশক্তি হারিয়েছেন। সেই সফরে নজরুল মাত্র একদিন চট্টগ্রামে ছিলেন।

বলা বাহুল্য নজরুল দ্বিতীয় ও তৃতীয় সফরে গিয়েছিলেন ফটিকছড়ির মহানগর গ্রামে খান বাহাদুর মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের বাড়িতেও। এই খান বাহাদুর সিরাজুল ইসলামের পুত্র প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম। সেই সফরে জামাল নজরুল ইসলামদের বাড়িতে বসে নজরুল লিখেছিলেন বিখ্যাত কবিতা 'বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি'। পরবর্তীতে সিরাজুল ইসলাম স্বীয় পুত্রের নাম রেখেছিলেন কবির নামের সঙ্গে মিলিয়েই।

১৯২৬ সালে প্রথমবারের মতো রংপুরে এসেছিলেন নজরুল। মুন্সীপাড়ার বিখ্যাত কাজী পরিবারের আমন্ত্রণেই সেবার রংপুরে এসেছিলেন নজরুল। কাজী মুহাম্মদ ইলিয়াসের সঙ্গে সখ্যতার সূত্র ধরেই দেবেন ঘোষের সঙ্গে রংপুরে এসেছিলেন নজরুল। সেই সফরে নজরুলকে রংপুর আইনজীবী সমিতি সংবর্ধনা দেয়।

নজরুল দ্বিতীয়বার রংপুরে এসেছিলেন ১১ অগ্রহায়ণ ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ বা ১৯২৮ সালে। সেবার তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রংপুরের হারাগাছ ক্রীড়াচক্র। সেই সফরে নজরুল লিখেছিলেন 'ভোরের সানাই' ও 'ভোরের পাখি' নামের দুটি গান। যা সে বছর সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

নজরুল কুষ্টিয়া সফর করেন ১৯২৯ সালে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষক সম্মেলনে যোগ দেওয়া। সেই সফরে সফরসঙ্গী হিসেবে নজরুলের সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী প্রমীলা দেবী ও দুই পুত্র । কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সঙ্গে নজরুলের এটিই ছিল সর্বশেষ রাজনৈতিক মঞ্চে একত্রিত হওয়া।

যৌবনে নজরুল বেশ কয়েকবার এসেছিলেন চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায়। কার্পাসডাঙ্গার সন্তান মহিম সরকার কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটে সপরিবারে বাস করতেন। মহিম সরকারের সঙ্গে নজরুলের ভীষণ সখ্যতা ছিল। সেই সুত্রেই নজরুল বেশ কয়েকবার এসেছিলেন কার্পাসডাঙ্গায়। ১৯২৬ সালে সপরিবারে নজরুল প্রায় ২ মাস অবস্থান করেছিলেন ভৈরব নদ তীরবর্তী কার্পাসডাঙ্গায়।

সিলেটে কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

নজরুল সিলেট সফর করেছিলেন দুবার। প্রথমবার ১৯২৬ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। প্রথমবারের চেয়ে নজরুল সিলেটে এসেছিলেন সিলেটের কংগ্রেস সদস্যদের নিমন্ত্রণে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সিলেটে আসার পর অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন নজরুল। এসময় তাকে রাখা হয়েছিল সিলেটের নয়াসড়কে রায় বাহাদুর রমনী মোহন দাসের বাড়িতে। পরে মরমী সঙ্গীত সাধক হাসন রাজার পুত্র একলিমুর রাজা একপ্রকার জিদ করেই তার জিন্দাবাজারের বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন কবিকে।

নজরুলের দ্বিতীয়বার সিলেট সফর ছিল ১৯২৮ সালে। উদ্দেশ্য প্রাদেশিক মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্সে যোগ দেওয়া। এই সফরে নজরুল ছাড়াও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকেও। দ্বিতীয়বার নজরুল প্রায় মাসখানেক সিলেটে অবস্থান করেছিলেন।

১৯২৮ সালে রাজশাহী মুসলিম ক্লাবে কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

একই বছর অর্থাৎ ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে রাজশাহী মুসলিম ক্লাবের আমন্ত্রণে নজরুল রাজশাহী সফর করেছিলেন। কলকাতা থেকে নাটোর হয়ে রাজশাহীতে আসেন নজরুল। কবি থাকেন রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের মেস 'চৌধুরীর দালানে'। প্রথমে আমন্ত্রণকারীরা বিব্রতবোধ করলেও নজরুলের কাছে তা ধোপে টেকেনি। নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল রাজশাহীর টাউন হলে। কবির রাজশাহী সফরে সফর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন কবি বন্দে আলী মিয়া।

নজরুল নোয়াখালীতে এসেছিলেন ১৯৩০ সালে। এসময় ঘোড়ার গাড়িতে করে পুরো নোয়াখালী শহরে ঘুরিয়ে কবিকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আগেই ঠিক করা হয়েছিল সকালের ট্রেনে নজরুল নোয়াখালীতে আসবেন। কিন্তু নজরুল যে শেষরাতের ট্রেনে চলে আসবেন কেউ ধারণা করতে পারেনি। নজরুলের হঠাৎ আগমনে সবাই অপ্রস্তুত হয়ে গেলে তাকে একপ্রকার জোর করেই লাকসাম নিয়ে যাওয়া হলো। পরে ভোরেই নজরুলকে নোয়াখালীতে আনা হয়েছিল। এরপর তাকে খাদেমুল ইসলাম হলে সংবর্ধনা দেয়া হলো। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবিকে সোনার দোয়াত কলম উপহার দেয়া হয়েছিল।

১৯৩২ সালে 'বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনে' যোগ দিতে সিরাজগঞ্জ সফর করেন নজরুল। সে বছরের ৫ ও ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব ও করেছিলেন নজরুল। কলকাতা থেকে ট্রেনে করে সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশন হয়ে সিরাজগঞ্জে এসেছিলেন নজরুল। নজরুলকে দেখতে সেদিন তিল ধারণের জায়গা ছিল না গোটা স্টেশন এলাকাতেই।

নজরুল জীবদ্দশায় সফর করেছেন বর্তমান বাংলাদেশের সর্বমোট ২৬টি জেলায়। নজরুলের সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ মে। সঙ্গী হিসেবে ছিলেন কবির বড় ছেলে কাজী সব্যসাচী ও তার স্ত্রী উমা কাজী, ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধ ও তার স্ত্রী কল্যাণী কাজী এবং তাদের সন্তানেরা। ঢাকায় নামার পর কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় ধানমন্ডিতে কবির জন্য নির্ধারিত বাড়িতে। সেখানেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বসবাস করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।

 

সূত্র:

জীবনের জলছবি/ প্রতিভা বসু

বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল-জীবনী/ গোলাম মুরশিদ

কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা/ মুজফফর আহমদ

স্মৃতিকথা/  কাজী মোতাহার হোসেন

Comments