দেশভাগ ও হাসান আজিজুল হক

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক-মর্মন্তুদ-করুণতম অধ্যায়ের নাম দেশভাগ—বাঙালি জীবনের বৃহত্তম ট্রাজেডি—পৃথিবীর ইতিহাসেও। পৃথিবীর দিনপঞ্জিতে ঠান্ডা মাথায় সংঘটিত এরমকম ট্রাজেডির দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই। ট্রাজেডির ধর্ম হলো শিল্পের মধ্য দিয়ে নিজেকে ভিন্নতর এক মাত্রায় হাজির করে, কালের হাত ধরে মহাকালের পটে আঁকে চিরস্থায়ী এক আবাস- অভিঘাত রাখে নতুন সৃজনে, শিল্পের বিস্তার ও বাঁক উজানে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত দুটো বিশ্বযুদ্ধ ইহজাগতিক পৃথিবীর ক্ষয়-ক্ষতি-প্রাণ সংহারের পাশাপাশি মনোজাগতিক দুনিয়ায় ব্যাপকতর পরিবর্তনসহ মূল্যবোধের খোলনলচে উলটপালট করলেও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃথিবীকে দিয়েছে ভিন্নতর সব তত্ত্ব। বাঙালির জীবনে দেশভাগ দুই বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও সৃষ্টি করেছে গভীরতর এক ক্ষত, জন্ম দিয়েছে বৃহত্তম এক ট্রাজেডি।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্তক-মর্মন্তুদ-করুণতম অধ্যায়ের নাম দেশভাগ—বাঙালি জীবনের বৃহত্তম ট্রাজেডি—পৃথিবীর ইতিহাসেও। পৃথিবীর দিনপঞ্জিতে ঠান্ডা মাথায় সংঘটিত এরমকম ট্রাজেডির দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ নেই। ট্রাজেডির ধর্ম হলো শিল্পের মধ্য দিয়ে নিজেকে ভিন্নতর এক মাত্রায় হাজির করে, কালের হাত ধরে মহাকালের পটে আঁকে চিরস্থায়ী এক আবাস- অভিঘাত রাখে নতুন সৃজনে, শিল্পের বিস্তার ও বাঁক উজানে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত দুটো বিশ্বযুদ্ধ ইহজাগতিক পৃথিবীর ক্ষয়-ক্ষতি-প্রাণ সংহারের পাশাপাশি মনোজাগতিক দুনিয়ায় ব্যাপকতর পরিবর্তনসহ মূল্যবোধের খোলনলচে উলটপালট করলেও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পৃথিবীকে দিয়েছে ভিন্নতর সব তত্ত্ব। বাঙালির জীবনে দেশভাগ দুই বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও সৃষ্টি করেছে গভীরতর এক ক্ষত, জন্ম দিয়েছে বৃহত্তম এক ট্রাজেডি।

বৃহত্তম ট্রাজেডি জন্ম দেয় মহোত্তম শিল্প। বাঙালির বেদনাবিধুর 'দেশভাগ' সেই মহোত্তম শিল্পের আধার, মহাকাব্যিক এক ক্যানভাস। যদিও ক্যানভাসে নেই আমাদের শিল্পীসমাজ-মেধাজীবীর দল-কবি-লেখক-সাহিত্যিকদের দোর্দণ্ড উপস্থিতি, অবাধ যাতায়াতের প্রেম ও প্যাশন। আঙুলের কড়ে গুণে রয়েছেন কয়েকজন, বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জাগানিয়া ওপারে দেবেশ রায়; এপারে হাসান আজিজুল হক, সদ্য ইহজাগতিক পৃথিবীর হিসেব-নিকেশ সমাপ্ত করেছেন যিনি।

হাসান আজিজুল হক নিঃসন্দেহে 'দেশভাগ'- এর লেখক কূল শিরোমণি। 'দেশভাগ' নামক বৃহত্তম ট্রাজেডি নিয়ে লিখতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সাধনা-অভিনিবেশ-তপস্যা জীবনব্যাপী একই মন্ত্রে বুঁদ হয়ে থাকার পণ এবং নৈতিক জীবনাচরণের দীপ্র উচ্চারণ। হাসান আজিজুল হক এসবে উত্তীর্ণ, ব্যতিক্রম ও স্বতান্ত্রিক প্রজ্ঞায় দ্যুতি ছড়ানো এক প্রতিভা, সৃজনশৈলীতে সামর্থ্যবান, ঋজুপ্রতীম।

হাসানের গল্প-উপন্যাসে দেশ-কাল-ইতিহাসের গভীরতার নির্যাস ও নির্মোহ উচ্চারণ সর্বদাই উচ্চকিত, কারণ তিনি জীবনভর 'দেশভাগ'কে ধারণ করেছেন। আমৃত্যু বাঙালির মহাকাব্যিক শোকগাঁথা থেকে তিনি বেরোননি-কিংবা সচেতন ভাবেই চাননি। লেখালেখির শুরুতে হাসান নিজেকে প্রস্ফুটিত করেছেন সেই অধ্যায়কে জারি রেখে। জীবন সংলগ্ন কথামালা শুধু নয় জীবনকে উপরিতলের বাইরে গিয়ে দেখার মন্ত্রও তিনি জপেছেন ধ্যানমগ্ন এক ঋষির মতো। যা হাসানকে লিখিয়েছে, সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, দেশভাগের গল্প, রাঢ়বঙ্গের গল্প, আগুন পাখি, সাবিত্রি উপাখ্যান এর মতো অমর কথাসাহিত্য। আগুনপাখি উপন্যাসের একেবারে শেষে এসে মায়ের জবানীতে হাসান যখন বলেন, 'আমি কি ঠিক করলম? আমি কি ঠিক বোঝলম? সোয়ামির কথা শোনলম না, ছেলের কথা শোনলম না, মেয়ের কথা শোনলম না। ই সবই কি বিত্তি-বাইরে হয়ে গেল না? মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে, কিছু একটা পাবার লেগে কিছু একটা ছেড়ে দেয়। আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলম। শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি। আমি জেদ করি নাই, কারুর কথার অবাধ্য হই নাই। আমি সবকিছু শুদু নিজে বুঝে নিতে চেয়েছি। আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলেদা একটো দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদ কিসের? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরো বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ কিন্তুক আলেদা মানুষ।'

'দেশভাগ' নিয়ে এরকম প্রশ্ন কিংবা আরও গভীরতর কোনো জিজ্ঞাসা হাসানেরও ছিল নিশ্চয়, থাকাটাই স্বাভাবিক-সংগত। হাসান কথাশিল্পী, উচ্চশিক্ষার বড় বিদ্যাপীঠের শিক্ষক। হাসানের সৃষ্ট চরিত্র স্বল্পশিক্ষিত একজন মা। তারপরও যে প্রশ্ন ছুঁড়েছেন তিনি দেশভাগ নিয়ে সেটা মৌলিক এবং পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী এক প্রশ্ন, এবং হাসান সৃষ্ট চরিত্রের মা-ই যেন 'দেশভাগ' এর শিকার হওয়া অগণন-অসংখ্যা ঘটনার প্রতীকি এক প্রতিবাদ। মা-র প্রশ্ন তাই গবেষণালব্ধও। যেমনটা উচ্চারিত হয়েছে, ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের 'দেশবিভাগ পশ্চাৎ ও নেপথ্য কাহিনী' গ্রন্থে, 'মাউন্টব্যাটেন যে-কাজের জন্য এসেছিলেন সেই কাজ শেষ হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। ভারতবর্ষকে যারা প্রায় দুশ বছর ধরে শাসন করেছে, শোষণ করেছে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সদ্ভাব বজায় রেখেই ক্ষমতার হস্তান্তর হয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে যুগ যুগ ধরে যারা একই সঙ্গে বসবাস করেছে, যাদের ধমনীতে একই রক্ত প্রবাহিত, যাদের জীবনচর্চা প্রায় একই রকম তারা পৃথগন্ন হয়ে গেল। কেবল দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রই গঠিত হলো না, তারই সঙ্গে দুই রাষ্ট্রের মানুষের মনের মধ্যে দূরতিগম্য এক ব্যবধান রচিত হয়ে গেল। পশ্চিম ভারতবর্ষে শুরু হয়ে গেল অসংগঠিত লোক বিনিময়, অপরিসীম অত্যাচারে জর্জরিত হলেন অসংখ্য মানুষ। ভ্রাতৃহত্যায়, নারী নির্যাতনে কলঙ্কিত হলো ভারতবর্ষেও সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্মবোধ। জিন্না কি এ জিনিস চেয়েছিলেন? আজাদ বলেছিলেন যে দেশবিভাগ হলো জলের উপর দাগ কেটে নদীকে দু ভাগ করার মতো ব্যাপার। দুটি দেশ আবার জোড়া লাগবে। আজাদ যা ভেবেছিলেন তা হয়নি। হবেও না। দেশবিভাগের সঙ্গে সঙ্গে মনের ভাগও হয়ে গিয়েছিল। ক্ষয়িষ্ণু নীতিবোধের মধ্যেই কি গান্ধীজী তার মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন?'

আগুনপাখি'র মা কোনোকিছুতেই ভেঙে পড়ার নয়, বিচলিত হওয়া তার সাজে না। উপন্যাসের শুরুতেই হাসান সেটা পরিষ্কার করেছেন এবং কাহিনী এগুনোর সঙ্গে সঙ্গে সেই সত্য মিলেছে তার ডানা, 'আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল' বছল হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু বছর। এই দুই ভাই-বুনকে অকূলে ভাসিয়ে মা আমার চোখ বুজল। ত্যাকনকার দিনে কে যি কিসে মরত ধরবার বাগ ছিল না। এত রোগের নামও ত্যাকন জানত না লোকে। ডাক্তার-বদ্যিও ছিল না তেমন। মরবার আগে মুখে যেদি ওষুধ পড়ত, তাই কতো! পেরায় পিতি বছর কলেরা বসন্তেই কতো যি লোক মরত, তার সীমাসংখ্যা নাই। আমার মা যি কলেরা-বসন্তে না মরে অজানা কি একটো রোগে মারা গেল তাই কতো ভাগ্যি!

মায়ের মওত আমার পষ্ট মনে পড়ে। এক বাদলের রাত-দোপওে জান গেল। কাঁদবার পর্যন্ত লোক নাই। বাপজি দখিন-দুয়োরি ঘরের উসারায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকলে। তার এক খালা ছিল, আমি দাদি বলতম-সেই দাদি এসে সব দেখাশোনা করলে।'

আগুনপাখি'র মা'র উত্তম পুরুষে বয়ানের প্রারম্ভিকে পাঠক বুঝে যান বিচ্ছিন্নতা- নিঃসঙ্গ বাস্তবতা এই চরিত্রের ললাট লিখন। উপন্যাসের অধ্যায়গুলোর উপ-শিরোনামেই স্পষ্ট হয় তার জীবনপ্রবাহ কতোটা ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ- ০১. ভাই কাঁকালে পুঁটুলি হলো ০২. বিছেনা ছেড়ে একদিন আর উঠলে না ০৩. আমার বিয়ের ফুল ফুটল ০৪. মাটির রাজবাড়িতে আমার আদও ০৫. বড়ো সোংসারে থই মেলে না ০৬. আমার একটি খোঁকা হলো, ০৭. সোয়ামি সংসার নিয়ে আমার খুব গরব হলো ০৮. সোংসার সুখ-দুখের দুই সুতোয় বোনা বই-তো লয় ০৯. ও মা, মাগো, কতোদিন যাই নাই, এইবার বাপের বাড়ি যাব ১০. ছেলে চলে গেল শহরে ১১. সব গোলমাল লেগে যেচে ১২. খোঁকা ভালো আছে তবে সোময়টো খারাপ ১৩. ছেলে আনো বাড়িতে, আর পড়তে হবে না ১৪. যা ভয় করেছেলম তা-ই হলো, ই সান্নিপাতিক জ¦র ১৫. সারা জাহান খাঁ খাঁ- হায়রে শোধ তোলা ১৬. সোংসার কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না ১৭. কতো লোকের কতো বিচের, কতো বিধেন ১৮. পিথিমির র্পেজা আর কতো বাড়াবো ১৯. কি দিন এল, সারা দুনিয়ায় আগুন লাগল ২০. আবার অনেকদিন বাদে বাপের বাড়ি ২১. গিন্নি বিছেনা নিলে, আর উঠলে না ২২. আকাল আর যুদ্ধুর দুনিয়ায় কেউ বাঁচবে না ২৩. নোহ নবীর সোমায়ের কেয়ামত কি আবার এল ২৪. দুনিয়ায় আর থাকা লয়, গিন্নি দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল ২৫. সোংসার তাসের ঘর, তুমি রাখতে চাইলেই বা কি ২৬. ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই, সবাই পেথগন্ন হলো ২৭. এত খুন, এত লউ, মানুষ মানুষের কাছে আসছে খুন করার লগে ২৮. আর কেউ নাই, এইবার আমি একা।

উপর্যুক্ত উপশিরোনামই বলে আগুনপাখি'র মা লড়াকু এবং বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সময়ের সঙ্গে একাত্ম হওয়া চিরন্তন বাঙালি মায়ের প্রতিভূ। ঈশ্বরী পাটনির মতোই, 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে', সেই মা'রও চাওয়া। কিন্তু ৪৭ এর 'দেশভাগ' ঈশ্বরী পাটনীর প্রতিরূপ মা-কেও পাল্টে দেয় 'দেশভাগ' এর প্রশ্নে। এ কারণে আগুনপাখি'র শেষে বাস্তবিকই একা হয়ে গেলেও বিশ্বাসে অনঢ় থিতু। একা মানে একা-সন্তান নেই সঙ্গে এমনকি স্বামীও। মা থেকে যান দেশের প্রশ্নে-মাতৃভূমির জন্য, আর ছুঁড়ে একরাশ প্রশ্ন, 'সত্যি বলছি বাবা, আমি ক্যানে তোমাদের সাথে দেশান্তরী হব এই কথাটি কেউ আমাকে বুঝুইতে পারে নাই। পেথম কথা হচে, তোমাদের যে একটো আলেদা দ্যাশ হয়েছে তা আমি মানতে পারি না। একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা, শুধু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আলেদা আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদনি হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ, একটি তালগাছ উদিকেও তেমনি একটি আমগাছ, একটি তালগাছ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল? কই ঐখানটোয় আসমান তো দুরকম লয়। শুদু ধম্মোর কথা বলো না বাবা, তাইলে পিথিমির কুনো দ্যাশেই মানুষ বাস করতে পারবে না।'

হাসান আগুনপাখি'র মা'র এই বেদনা জীবন দিয়ে ধারণ করেছেন, এ কারণে আগুনপাখির আগেই তিনি লিখেছেন, 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ' এর মতো গল্প, যেখানে এক বুড়োর জবানিতে বলছেন, 'এখানে যখন এলাম- আমি প্রথম একটা করবী গাছ লাগাই... তখন হু হু করে কে কঁদে উঠলম চুড়ির শব্দ এলো, এলোমেলে শাড়ির শব্দ আর ইনামের অনুভবে ফুটে উঠল নিটোল সোনারঙের দেহ- সুহাস হাসছে হি হি হি- আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? বলে থামলে বুড়ো, কান্না শুনল, হাসি শুনল, ফুলের জন্যে নয়, বুড়ো বলল, বিচির জন্যে, বুঝেছ, করবী ফুলের বিচির জন্যে। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে।'

হাসানের এই বুড়োকে বুঝতে হলে-বুড়োর বেদনা অনুভব করতে হলে, আগুনপাখির মা'র প্রশ্নে ব্যথিত হতে হলে- সবকিছু ছেড়ে শুধু দেশের জন্য সংশপ্তক হয়ে ওঠার ব্যাকরণ পাঠ করা সহজ কথা নয়। এ কারণে হাসান কারও কাছে দুর্বোধ্য, অবাধ যাতায়াতে ঈর্ষণীয়।

হাসানকে বুঝতে হলে বাঙালির সমাজতত্ত্ব-ধর্মবোধ-ঐতিহাসিক পরম্পরা-প্রশাসনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক জ্ঞান বুঝতে হবে নির্মোহ দৃষ্টিতে-বিজ্ঞান মনস্কতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জারি রেখে। এসব বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে রপ্ত করতে হবে 'দেশভাগ' কে দেখা-জানা-বোঝা এবং হৃদয়জ উপলব্ধি ও আত্মীকরণ বিদ্যা। বাঙালির ইতিহাসের দুই মহান স্মারকের নাম দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ- '৪৭ ও '৭১। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা গৌরবের-গর্বের যেমন, তেমনি স্বজন হারানোর-পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতা-বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ও নির্দয় অত্যাচার-অনাচারের মর্মন্তুদ ইতিহাস। কিন্তু 'দেশভাগ' কেবলই বেদনার-বঞ্চনার বৃহত্তম এক ট্রাজেডি। পৃথিবী দুই বিশ্বযুদ্ধের কথা একসময় ভুলেও যেতে পারে। কিন্তু বাঙালির ইতিহাস থেকে 'দেশভাগ' এর দুঃসহ স্মৃতি- বেদনাবিধুর ঘটনা ভুলে যাবার নয়, বিশেষ করে তাদের যারা কোনো প্রকার সাতে পাঁচে না থেকে শুধু ধর্ম পরিচয়ের কারণে এই ঘটনার শিকার হয়েছেন, রাজনীতিবিদরা মেতে থেকেছেন নিজেদের পদ-পদবি-লাভালাভ আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খেরোখাতার দিকে, যারা প্রায় দুশ বছর দেশ দখলে রেখে শাসনের নামে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছে তারাই ঠিক করেছেন আমরা কে কোথায় থাকব, আমাদের কার দেশ কোনটা হবে-কতটুকু হবে, আমাদের ভাগ্য-সীমানা-গাছপালা-পশুপাখি-নদীনালা-ঘরবাড়ি-আমগাছ তালগাছ-বাড়ির উঠোন- খেলার মাঠ সব ভাগ হয়েছে দখলদারী সাম্রারাজ্যের ইচ্ছেমতো।

'দেশভাগ' এর বৃহৎ কলেবর ও ক্যানভাসের লেখককে আঁতকা বোঝা সম্ভব নয় কখনোই। 'দেশভাগ' এর হাহাকার যদি নিজের ভেতরে অভিঘাত তৈরি না করে তাহলে 'দেশভাগ' এর লেখক হাসানকে বোঝা দুরুহ-দুঃসাধ্যও বটে। আগুনপাখির মা তো হাসানেরই মা। হাসানতো সোহরাব-রুস্তমের কাহিনীর সোহরাব, যিনি মা তাহমিনার জন্য নিজের প্রাণপাত করেছিলেন তুচ্ছ ও কর্তব্য জ্ঞান। হাসান যেহেতু কলম যোদ্ধা একারণে সোহরাবের মতো যুদ্ধের মাঠে প্রাণ বিসর্জন নয়, শিল্পীর জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য-মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে।

ড. কাজল রশীদ শাহীন: লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

5h ago