আবুল মনসুর আহমদ: ‘ইতিহাসে নিজের মতো করে অবদান রেখে গেছেন’
'আবুল মনসুর আহমদ নিজের মতো করে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য সব কিছু নিয়েই চিন্তা করেছেন এবং ওই সময়কার পরিস্থিতি বদলাতে হবে, সে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে গেছেন। তিনি বড় মাপের মানুষ ছিলেন সেজন্য নয়, বরং তাকে স্মরণ করতে হবে তিনি জাতীয় যে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, অগ্রসর হয়েছে তার সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত ছিলেন। তিনি ইতিহাসে নিজের মতো করে অবদান রেখে গেছেন।'
এই মূল্যায়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। তিনি বলেন, 'এদেশের কৃষক আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, পরবর্তীতে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান- এগুলোর সবই আবুল মনসুর আহমদ দেখেছেন এবং কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। সেখানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি সাংবাদিক ছিলেন, আইনজীবী ছিলেন, রাজনীতিবিদ ছিলেন, কিন্তু সব মিলিয়ে তিনি একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন।'
সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে চতুর্থবারের মতো আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে আজ শনিবার এসব কথা বলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
ডেইলি স্টার সেন্টারে আযোজিত এই অনুষ্ঠানের আগে গত চার বছরের ৪২ জন বিজয়ীসহ গবেষণায় আগ্রহী এমন ৭০ জনকে নিয়ে দিনব্যাপী গবেষণা সম্পাদনা ও সৃজনশীল চর্চা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আবুল মনসুর আহমদ জগতকে ব্যাখ্যা করেছেন, সেই ব্যাখ্যাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন তার লেখনি, রাজনীতি, বক্তৃতার মাধ্যমে। তার উদ্দেশ্য ছিল এই ব্যবস্থার বদল করা।
'সেজন্য আমরা দেখবো ঐতিহাসিকভাবে ২১ দফার যে রচনা সেটা আবুল মনসুর আহমদ তৈরি করেছিলেন। এটাও দেখবো যে, ৬ দফার যে ব্যাখ্যা-- যেটা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রচার করা হয়েছিল-- সেটা আবুল মনসুর আহমদ লিখে দিয়েছিলেন। এগুলো হচ্ছে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা এবং এই ভূমিকাটা তিনি পালন করেছেন', বলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
আবুল মনসুর আহমদ লেখক হিসেবে অত্যন্ত উঁচুমানের ছিলেন উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'তিনি "আয়না" ও "ফুড কনফারেন্স" এর মতো যে ব্যঙ্গ রচনা লিখেছেন, সেই রকম লেখা পরে বাঙালি মুসলমানের কাছে আর পাইনি। আজকে ওইরকম একটা লেখা লিখতে কেউ সাহসই করবে না। আয়নাতে কাজী নজরুল ইসলাম যে ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি লিখেছেন যে আয়নার হাসির পেছনে -এই যে তিনি হাসাচ্ছেন আমাদের-- তার পেছনে গভীর কান্না আছে এবং সেই কান্নাটাই হচ্ছে বড় সত্য।'
'তার প্রত্যেক লেখার মধ্যেই একটা অর্ন্তদৃষ্টি আছে, তিনি পরিবর্তনের পক্ষে লিখেছেন' মন্তব্য সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর।
"আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর" বইয়ের একটি অংশের উল্লেখ করে বলেন, 'তিনি (আবুল মনসুর আহমদ) বলেছেন যে, চিত্তরঞ্জন দাশের যখন মৃত্যু হলো তখনই বাংলার রাজনীতি শেষ হয়ে গেল। বাংলার রাজনীতি তখন ভারতীয় রাজনীতির অংশ হয়ে গেল। এই ইতিহাস আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে, বাংলার রাজনীতিকে আমরা বাঙালিরা যদি স্বতন্ত্রভাবে রাখতে পারতাম, যদি সর্বভারতীয় কংগ্রেস বা সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের হাতে ছেড়ে না দিতাম তাহলে এ অঞ্চলের ইতিহাস অন্যরকম হতো।'
সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'তাহলে হয়তো ৪৭-এ দেশভাগ হতো না, আরও যে বিপর্যয়গুলো হয়েছে সেগুলো হতো না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো না। চিত্তরঞ্জন দাশ মারা যাওয়ার মানে শুধু এটা নয় যে, আমরা বড় একজন নেতাকে হারালাম, তার তাৎপর্য এটাও যে, বাংলার রাজনীতিকে স্বাধীনভাবে রাখার যে নেতৃত্ব ছিল সে নেতৃত্বও চলে গেল- এই অর্ন্তদৃষ্টি আবুল মনসুর আহমদের ছিল। এরপর গান্ধী এলেন, জিন্নাহ এলেন কিন্তু তারা তাদের রাজনীতি করেছেন, বাংলার রাজনীতি নয়, কৃষকের রাজনীতি নয়, যেই রাজনীতিতে আবুল মনসুর আহমদ বিশ্বাস করতেন।'
আবুল মনসুর আহমদ বিশ্বাস করতেন কৃষকের মুখের ভাষাই গদ্যের ভাষা হবে এবং সে ভাষাতেই তিনি প্রথম উপন্যাস 'জীবনক্ষুধা' লিখেছিলেন উল্লেখ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'বাংলা ভাষাকে একের পর এক সাহিত্যিকরা এসে বদলেছেন। বিদ্যাসাগর এসে এর মধ্যে ছন্দ নিয়ে এসেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যে এনেছেন, রবীন্দ্রনাথ এসে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন কিন্তু ভাষার কৃত্রিমতা রয়ে গেল। মুখের ভাষা ও গদ্যের ভাষা আলাদা রয়ে গেল। আবুল মনসুর আহমদেরা এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তারা রেঁনেসা সোসাইটি নামে ১৯৪৩ সালে একটা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, সাহিত্য সম্মেলন করেছেন।'
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলেও করোনাভাইরাস ওইরকম একটা যুদ্ধের চেয়ে কম ক্ষতি করেনি বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'কত মানুষ বেকার হয়েছে, দরিদ্র হয়ে গেছে, মৃত্যু ঘটে গেছে হিসাব দিয়ে কুলানো যাবে না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আজকে যারা তরুণ তাদের দায়িত্ব নিতে হবে, বদলের স্বপ্ন থাকতে হবে। আগামীর ভবিষ্যত তরুণদের ওপরই নির্ভর করছে। সেই তরুণদের নির্মাণে মুক্তিফৌজ, চাঁদের আসর, কচি কাঁচার মেলার মতো 'কিশোর আন্দোলন' গড়ে তুলতে হবে। তিনি দেশের লাইব্রেরিগুলোকে সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, লাইব্রেরিতে বই নিয়ে আলোচনা হবে, বিনোদনের কেন্দ্র হবে, সন্ধ্যার পর আবৃত্তি হবে, গান হবে, নাটক হবে। এভাবে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব আনতে হবে যাতে তরুণদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফকরুল আলম বলেন, 'আবুল মনসুর আহমেদ আমাদের ইতিহাসের অংশ। যে ইতিহাসে আমরা এই পর্যায়ে এসেছি, সেটি বুঝতে না পারলে এ দেশের কোনো ভবিষ্যত নেই। এই প্রজন্মের অনেক কিছুই জানার বাকি আছে।'
আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের সভাপতি আরিফ খান।
ইমরান মাহফুজের সঞ্চালনায় কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন সম্পাদনা'র প্রধান সম্পাদক রাখাল রাহা; অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম ও অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ।
দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম সমাপনী বক্তব্য দেন।
যারা পুরস্কার পেলেন
'আবুল মনসুর আহমদ ও তার সাংস্কৃতিক চিন্তা' বিভাগে প্রথম পুরস্কার জিতেছেন ঈশিতা ফারজানা, দ্বিতীয় আসমাউল হুসাইন এবং যৌথভাবে তৃতীয় তাসনীম তিশা ও মোস্তাফিজুর রহমান সাফি। 'আবুল মনসুর আহমদ ও তার জাতীয়তাবোধ' বিভাগে প্রথম পুরস্কার জয়ী আজিজ সারতাজ জায়েদ, দ্বিতীয় মুহম্মদ নুরুদ্দীন শহীদ এবং তৃতীয় সুলাইমান মাহমুদ।
'আজকের গণমাধ্যম ও আবুল মনসুর আহমদের সাংবাদিকতা' বিভাগে প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ, দ্বিতীয় আলিফ নূর শর্মী এবং তৃতীয় কামরুল হাসান মাসুক।
প্রতিটি বিভাগে প্রথম পুরস্কার ১০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ৫ হাজার টাকা এবং তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে আবুল মনসুর আহমদের এক সেট বই দেওয়া হয়। বিজয়ী প্রত্যেককে সনদ ও ক্রেস্ট দেওয়া হয়।
Comments