মুক্তিযুদ্ধ

৮ অক্টোবর ১৯৭১: ‘৪ দফা দাবি পূরণ ছাড়া রাজনৈতিক মীমাংসা সম্ভব না’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৮ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অমৃতবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপসারণ এবং পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে। এই ৪ দফা দাবি পূরণ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক মীমাংসা সম্ভব নয়। রণাঙ্গনেই মুক্তিযোদ্ধারা সকল জবাব দিচ্ছেন।’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৮ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অমৃতবাজার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'বাংলাদেশকে স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি, বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপসারণ এবং পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে। এই ৪ দফা দাবি পূরণ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক মীমাংসা সম্ভব নয়। রণাঙ্গনেই মুক্তিযোদ্ধারা সকল জবাব দিচ্ছেন।'

'আমাদের এতোদিনের ক্ষোভ আর আমাদের উপর চলা নির্যাতনের জবাব আমরা পরিশোধ করবো। যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত। মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনেই বাংলাদেশ সমস্যার চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন। আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে, আমাদের বিজয় আমাদেরই অর্জন করতে হবে। এছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। কোনো রাষ্ট্রের কারণে আমাদের স্বাধীনতা যেমন অর্জিত হয়নি তেমনি বিজয় অর্জন ও সম্ভব নয়।'

ভারতে এদিন

৮ অক্টোবর দিল্লিতে রেডিও আকাশবাণীর প্রধান একে সেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'এ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রায় ১৫০ জন সংগীতশিল্পীকে আকাশবাণীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কার্যক্রমে অতিথি শিল্পী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই ভারতীয় শিল্পীদের সমপরিমাণ সম্মানী পাচ্ছেন। আমরা ইতোমধ্যে আরও কিছু অনুষ্ঠান নতুন করে নির্মাণের পরিকল্পনা করছি। সেখানেও কিছু বাংলাদেশি শিল্পী নিয়োগ পাবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৮ অক্টোবর লন্ডনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরির লক্ষ্যে এক সমাবেশে বক্তৃতার সময়ে প্রবাসী পাকিস্তানীরা তার উপর হামলা করার চেষ্টা করে, একইসঙ্গে তাকে শারীরিকভাব লাঞ্ছিত করা হয়। এসময় সভা পণ্ড হয়ে যায়। পরে ব্রিটিশ পুলিশ এসে তাকে ও তার সমর্থকদের উদ্ধার করে। এই ঘটনায় আবু সাঈদ চৌধুরী কিছুটা আহত হন।

৮ অক্টোবর মার্কিন সরকার ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তিপত্র অনুযায়ী, মার্কিন সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের সহায়তায় ৫ কোটি টাকা পাকিস্তান সরকারকে অর্থ সাহায্য দেবে।

৮ অক্টোবর মস্কোতে সোভিয়েত ছাত্র ও শিক্ষকেরা এক প্রতিবাদ সমাবেশে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা বন্ধের দাবিতে, শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সোভিয়েত সরকারের সমর্থন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি উত্থাপন করেন। এর আগের দিন সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা ও শরণার্থী শিবিরের চিত্র তুলে ধরা হয়। এদিন সমাবেশে ছাত্র ও শিক্ষক নেতারা বলেন, 'এখন বিশ্ববাসীর উচিত বাংলাদেশের বিষয়ে চোখ ফেরানো। পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মেতেছে।'

৮ অক্টোবর প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্র 'দ্য গার্ডিয়ান' পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'সম্প্রতি অপারেশন ওমেগার আরও দুজন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পূর্ব পাকিস্তানের যশোর জেলে পাঠিয়েছে পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসন। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মোট ছয় বার অপারেশন ওমেগার স্বেচ্ছাসেবকেরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল।'

দেশব্যাপী এদিন

৮ অক্টোবর বগুড়া শহরের আলতাফুন্নেছা ময়দানে প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্রে মেতেছে ভারত সরকার। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের ষড়যন্ত্র আজ বুঝতে পেরেছে। জনগণ তাতে কর্ণপাত না করলেও তাদেরকে নির্যাতন করে বাধ্য করা হচ্ছে। গোটা দেশে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের চরদের কারণে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস চরমে পৌঁছেছে। দেশে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও ভারত উদ্বাস্তুদের ফিরতে দিচ্ছে না। অথচ আমরা উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তনে সম্পূর্ণ রাজি এবং তাদের সাদরে গ্রহণ করবো। ভারতের কারণে পূর্ব পাকিস্তান আজ বিপর্যস্ত।'

৮ অক্টোবর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নূরুল আমিন পিপিআই প্রতিনিধিকে বলেন, 'জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানকারী সদস্য মাহমুদ আলীকে আমরা ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কারণ আসন্ন নির্বাচনে দলের কর্মসূচি নির্ধারণের জন্যে তার উপস্থিতি দরকার।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৮ অক্টোবর গোপালপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল গোপালপুর থানা মুক্ত করার লক্ষ্যে দিনভর মর্টার হামলা চালায়। কিন্তু কোনোভাবেই থানার দখল নিতে না পেরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মেজর হাকিম হানাদারদের অবস্থান রেকি করে ফেরার সময় মেজর হাকিমের কোম্পানির ১৩ বছর বয়সী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ভুলু ছদ্মবেশে হানাদারদের ঘাঁটিতে গিয়ে গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এসময় ৮ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

৮ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা ও কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি দল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শালদা নদী হানাদারদের ঘাঁটির চারটি অবস্থানের ওপর তিন দিক থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ আক্রমণে হানাদার সেনারা দুটি ঘাঁটি ছেড়ে অন্য দুটি ঘাঁটিতে সরে যায়। পরে ৪নং ইস্ট বেঙ্গলের সুবেদার বেলায়েত অতি দ্রুত তার বাহিনী নিয়ে শালদা নদী অতিক্রম করে পাকসেনাদের পরিত্যক্ত ব্যাংকারগুলোতে অবস্থান নেন। এসময় হানাদার সেনারা নয়নপুর বাজার থেকে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থানের সঙ্গে সমস্ত সংযোগ হারিয়ে ফেলে। পরে শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন হানাদার মুক্ত হয়।

৮ অক্টোবর ফেনীর পরশুরামের গুথুমায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুথুমা ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।

৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের পূর্বদেবপুরে টহলরত হানাদার সেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।

৮ অক্টোবর গোঁসাইরহাটে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের একটি দল গোঁসাইরহাট রেলস্টেশনের কাছে মাইন পেতে রাখে। এসময় একটি ট্রেন আসলে মাইনে পড়ে ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।

৮ অক্টোবর ঝিনাইদহের মহেশপুরের মথুরানগরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই প্লাটুন সৈন্যের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয়পক্ষের মধ্যে চার ঘন্টা গুলিবিনিময় হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১৫ জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৪ জন আহত হয়। অন্যদিকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। একইদিন মুক্তিবাহিনীর একটি দল কামদেবপুরে অবস্থানরত হানাদার সেনাদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় ৩০ জন হানাদার সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়।

৮ অক্টোবর ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার জেল সড়কে টহলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। পরে মুক্তিবাহিনী বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে।

৮ই অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার সেনারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্চারামপুরের উজানচরে কয়েকটি লঞ্চ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর উজানচরের গেরিলা ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। প্রথমে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা প্রতিরোধ গড়ে তুললে হানাদার সেনারা আর্টিলারি ও বিমান হামলা চালায়। এসময় বাধ্য হয়ে গেরিলারা অন্যত্র সরে যায়।

৮ অক্টোবর রাজশাহীর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী চাউকা গ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত হয়।

৮ অক্টোবর ময়মনসিংহের পোনাশাইলের বাগেরপাড়ার দিকে যাবার সময় রাজাকারের একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার নিহত হয়। পরে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা আরেকটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এসময় ক্যাম্পে থাকা রাজাকারেরা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আরও বেড়ে গেলে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প থেকে ৪টি রাইফেল এবং ১২০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান,  ৯ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৯ অক্টোবর ১৯৭১

দ্য গার্ডিয়ান, ৮ অক্টোবর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out in launch at Sadarghat

A fire broke out at a launch in Sadarghat this afternoon

Now