মুক্তিযুদ্ধ

৬ অক্টোবর ১৯৭১: ‘যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি করে গণহত্যার বৈধতা দিয়েছে’

১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সেই নিবন্ধে বলা হয়, ‘পূর্ব বাংলার আজকের অসহনীয় পরিস্থিতির জন্য একমাত্র দায়ী পাকিস্তান সরকার। তাদের সামরিক বাহিনীর চালানো গণহত্যার কারণেই আলোচনার সব সম্ভাবনা আজ শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

১৯৭১ সালের ৬ অক্টোবর ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সেই নিবন্ধে বলা হয়, 'পূর্ব বাংলার আজকের অসহনীয় পরিস্থিতির জন্য একমাত্র দায়ী পাকিস্তান সরকার। তাদের সামরিক বাহিনীর চালানো গণহত্যার কারণেই আলোচনার সব সম্ভাবনা আজ শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া সত্ত্বেও, শেখ মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হওয়া সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে তাকে বঞ্চিত করে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে যার মাশুল আজ পাকিস্তানের সমস্ত মানুষ গুনছে। পাকিস্তানের উপর সর্বপ্রকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অস্ত্র বিক্রি করে গণহত্যার বৈধতা দিয়েছে। বিশ্বের সব মানবতাবাদী ও বিবেকবান মানুষের প্রতি আমরা আহবান জানাচ্ছি আপনারা পূর্ব বাংলার অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ক্ষমতাসীন দেশগুলো পাকিস্তানের উপর কূটনীতিক চাপ আরোপ করুন। পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বাধ্য করুন।'

ঢাকায় এদিন

৬ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খানের সঙ্গে তার বাসায় দেখা করেন জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এসময় তারা মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগকে নির্মূলে সামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেন।

৬ অক্টোবর কাইয়ুম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খান এ সবুরের বাসায় মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) এর কর্মী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের প্রধান কাইয়ুম খান বলেন, 'রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মূলত পাকিস্তানকে ভাঙারই ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।'

৬ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল টহলরত রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ৩ রাজাকার ঘটনাস্থলেই নিহত হয় এবং ২ রাজাকার আহত হয়।

ভারতে এদিন

৬ অক্টোবর 'সংগ্রামী বাংলা' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ২২ জন অফিসার ও ৪০০০-এর বেশি সৈন্য, রাজাকার এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গণে প্রায় আড়াই হাজার কমান্ডো আক্রমণে ঐ শত্রুসেনাদের হত্যা করেছে।'

পাকিস্তানে এদিন

৬ অক্টোবর পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সিয়াও চিউজই বলেন, 'চীন সর্বক্ষেত্রেই পাকিস্তানের সঙ্গে আছে এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে চীনের হাত প্রসারিত থাকবে। চীন কারো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোকে সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করে। কোনো দেশ পাকিস্তানে হামলা চালানোর ধৃষ্টতা দেখালে চীন তার উপযুক্ত জবাব দেবে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

এদিন, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ভাষণে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের চলমান অবস্থা সম্পর্কে বহির্বিশ্ব কোনো ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। কারণ এটি সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যে পদক্ষেপটি একমাত্র পাকিস্তান সরকারকেই নিতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের চলমান অবস্থায় পাকিস্তানের বিষয় মন্তব্য বা হস্তক্ষেপ করা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। এখন পর্যন্ত যেসব শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আমরা আশা করতে পারি পাকিস্তান দ্রুততম সময়েই শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। একই সঙ্গে এই ব্যাপারে ভারতকেও সহযোগিতা করতে হবে। আমরা এই অঞ্চলে শান্তি ও সংহতি কামনা করি। শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য একই সঙ্গে আলোচনারও প্রয়োজন। আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠা স্থাপনের ক্ষেত্রে আলোচনার জন্য মার্কিন সরকার সব সময়েই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।'

এদিন, মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি পাকিস্তানকে সব ধরনের সাহায্য দেওয়া সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি প্রস্তাব অনুমোদন করে।

৬ অক্টোবর জেদ্দায় সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান আবদুর রহিম খান। এসময় সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ বলেন, 'পাকিস্তানের সকল প্রকার প্রয়োজনে পাশে থাকবে সৌদি আরব।' এসময় সাম্প্রতিক সময়ে পাক ভারতের তীব্র উত্তেজনা নিয়েও আলোচনা হয় দুজনের মধ্যে।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাউজানে হালদা নদীর মদুনা ঘাটের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি দল বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের ২টি ট্রান্সফারমার ধ্বংস করে। এসময় রাজাকারদের গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মান্নান গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

৬ অক্টোবর কুমিল্লার দুর্লভপুরের কাছে রাত ৩টা দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি টহল দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশের মধ্যে পড়ে বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

৬ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার শালদা নদী ও নদী তীরবর্তী নয়নপুর বাজারে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এসময় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।

৬ অক্টোবর রাজশাহীর ঘোষপুরে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাবিনিময় হয়। মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।

এদিন ফেনীর ছাগলনাইয়া - মুহুরিগঞ্জ সড়কের একটি সেতু উড়িয়ে দেয় গেরিলারা।

৬ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কুমারসাইল চা বাগানের কাছে টহলরত হানাদার সেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

৬ অক্টোবর ফেনীর ছাগলনাইয়ার বিওপিতে পাহারারত হানাদার সেনাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় গেরিলারা। হামলার পর মুক্তি বাহিনী নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে ক্যাম্পে ফিরে যায় মুক্তিবাহিনীর এই হামলায় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়। এসময় হানাদারদের শেলে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৬ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের ধুমঘাট ও মুহুরিগঞ্জের সংযোগকারী রেল ব্রিজ উড়িয়ে দেয় মুক্তিবাহিনী। রেল ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার ফলে ঢাকা চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

৬ অক্টোবর ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি গাড়িতে গ্রেনেড হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় ৩ সৈন্য নিহত হয় এবং একটি গাড়ি বিধ্বস্ত হয়।

৬ অক্টোবর কুমিল্লার চান্দিনা, গোপীনাথপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় মুক্তিবাহিনীর। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয় ও বেশ কয়েকজন আহত হয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দ্য গার্ডিয়ান, ৬ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক পাকিস্তান, ৭ অক্টোবর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ৭ অক্টোবর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Civil society in Bangladesh

Our civil society needs to do more to challenge power structures

Over the last year, human rights defenders, demonstrators, and dissenters have been met with harassment, physical aggression, detainment, and maltreatment by the authorities.

9h ago