২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: বিদেশি চাপে আমাদের বহু চেষ্টা নস্যাৎ হয়ে গেছে: ইন্দিরা গান্ধী

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৯ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক ভাষণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘ভারতীয় জনগণ বাংলাদেশের মানুষের জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের চাপে এবং ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েও ভারত নিরীহ আর্ত শরণার্থীদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের বহু চেষ্টাই নস্যাৎ হয়ে গেছে বহির্মুখী চাপে। এই বছরের শুরুর দিকে আমাদের সাধারণ নির্বাচনে ভারতের জনগণ আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অঙ্গীকার করেছে। আমরাও আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে জোর দিয়েছি। শরণার্থী সমস্যার ফলে আমরা বেশ বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু এরা তো কোনো সশস্ত্র লোক নয়। প্রাণে বেঁচে থাকার আশায় ক্ষুধায় জর্জরিত অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের একটি সুবিশাল অন্তঃপ্রবাহ চলতে থাকল। এদের অনেকে আহত, অসুস্থ এবং সবাই ক্ষুধার্ত। গত ছয় মাসের মধ্যে ৯০ লাখ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে। এখনো এসেই চলেছে। ইতিহাসে আমরা এর চেয়ে বড় শরণার্থী ঢল আগে দেখিনি। আমরা সবাই জানি যখন লাখ লাখ মানুষ অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে তখন সেই দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবন, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, নিরাপত্তা ও শান্তি হুমকির মুখে পড়ে। তবে আমরা সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখাচ্ছি। কিন্তু প্রয়োজনে সঙ্কটের মূল কারণ দূর করার জন্য অবিলম্বে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এমন কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না। এটা বিশ্ববাসীর দায়িত্ব যে আর দেরি না করে নিরাপত্তা এবং মর্যাদার সঙ্গে উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করা। আমরা আশা করছি একটি সমাধানের। এই সমাধানটি হলে শরণার্থীরা নিজ দেশে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে।’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৯ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক ভাষণে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'ভারতীয় জনগণ বাংলাদেশের মানুষের জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের চাপে এবং ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েও ভারত নিরীহ আর্ত শরণার্থীদের সব ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের বহু চেষ্টাই নস্যাৎ হয়ে গেছে বহির্মুখী চাপে। এই বছরের শুরুর দিকে আমাদের সাধারণ নির্বাচনে ভারতের জনগণ আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অঙ্গীকার করেছে। আমরাও আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নে জোর দিয়েছি। শরণার্থী সমস্যার ফলে আমরা বেশ বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু এরা তো কোনো সশস্ত্র লোক নয়। প্রাণে বেঁচে থাকার আশায় ক্ষুধায় জর্জরিত অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের একটি সুবিশাল অন্তঃপ্রবাহ চলতে থাকল। এদের অনেকে আহত, অসুস্থ এবং সবাই ক্ষুধার্ত। গত ছয় মাসের মধ্যে ৯০ লাখ শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে। এখনো এসেই চলেছে। ইতিহাসে আমরা এর চেয়ে বড় শরণার্থী ঢল আগে দেখিনি। আমরা সবাই জানি যখন লাখ লাখ মানুষ অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে তখন সেই দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবন, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, নিরাপত্তা ও শান্তি হুমকির মুখে পড়ে। তবে আমরা সর্বোচ্চ সহনশীলতা দেখাচ্ছি। কিন্তু প্রয়োজনে সঙ্কটের মূল কারণ দূর করার জন্য অবিলম্বে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, এমন কোনো চেষ্টা করা হচ্ছে না। এটা বিশ্ববাসীর দায়িত্ব যে আর দেরি না করে নিরাপত্তা এবং মর্যাদার সঙ্গে উদ্বাস্তুদের তাদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করা। আমরা আশা করছি একটি সমাধানের। এই সমাধানটি হলে শরণার্থীরা নিজ দেশে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে।'

ঢাকায় এদিন

২৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সের ২ সদস্যের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকায় আসে।

সেদিন সচিবালয়ে ডা. মালিকের সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে মন্ত্রীরা যুদ্ধকালীন ও দেশের এই দুরবস্থায় তাদের বেতন ৫ থেকে ১০ ভাগ কম নিবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন।

ঢাকার দিলকুশা ইউনিয়ন শাখার শান্তি কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে মন্ত্রীদের সম্বর্ধনা দেয়। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম। সভায় শামসুল হক বলেন, 'ভারতের দুরভিসন্ধি ফাঁস হয়ে যাবে ভেবেই তারা জাতিসংঘ, রেডক্রস, সাংবাদিক এবং মানবতাবাদীদের দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না।'

পাকিস্তানে এদিন

২৯ সেপ্টেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে অভিযুক্ত অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে দায়েরকৃত মামলায় এ পর্যন্ত ২০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২৯ সেপ্টেম্বর মস্কো থেকে প্রকাশিত সোভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, 'দুই পক্ষই পুরোপুরিভাবে একমত হয়েছে যে এই চুক্তির প্রভাব অসামান্য এবং উভয় রাষ্ট্রের জন্যই ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ। এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্ব পারস্পরিক সম্মান, আস্থা এবং প্রতিবেশীসুলভ সহযোগিতাকে শক্তিশালী করবে। এই চুক্তি নিশ্চিত করে যে সোভিয়েত-ভারত বন্ধুত্ব কোনো ক্ষণস্থায়ী পরিস্থিতির ওপর নয় বরং দুই দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদী পারস্পরিক উন্নতি ও অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য বহুমুখী পারস্পরিক সহযোগিতা এবং দুই দেশের শান্তি এবং নিরাপত্তার ওপর প্রতিষ্ঠিত। দুই পক্ষই চুক্তির শর্ত এবং মূলনীতি অনুসারে সোভিয়েত-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নে তাদের দৃঢ় সংকল্পের ঘোষণা দিল।'

এদিন জাতিসংঘে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি এম আর সিদ্দিকীর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ও জাতিসংঘের যেকোনো আয়োজনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের মহাসচিব উ'থান্টের কাছে আবেদন জানান।

২৯ সেপ্টেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে চিঠি পাঠান ব্রিটিশ লেবার পার্টির সচিব টিম রিড আউট। এই চিঠিতে অক্টোবরে লন্ডনে অনুষ্ঠিত লেবার পার্টির সম্মেলনে যোগদানের জন্য আবু সাঈদ চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

২৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালেক ডগলাস হোম জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে বলেন, 'ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্তের ওপর বিশ্বমহল গভীর উদ্বেগের সঙ্গে নজর রাখছে। সেখানকার পরিস্থিতি শঙ্কাজনক। এই অবস্থায় ভারত এবং পাকিস্তানকে নিজেদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। যুদ্ধ কখনোই কাম্য নয়। পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থীদের চাপে ভারতের অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গে যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষ যে পরিস্থিতিতে বসবাস করছে তা না দেখলে বিশ্বাস করার মতো না। সেখানে ব্যাপক ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন। এই জন্য বিশ্ব মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে।

২৯ সেপ্টেম্বর প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক 'দ্য টাইমস' এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার চলছে। এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। গত ১১ আগস্ট এই মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণের পর বিচার শুরু হয়েছিল। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর ওই মামলা চলমান ছিল। এই মামলার বিরুদ্ধে বিশ্বের বহু জায়গায় বিক্ষোভ হলেও পাকিস্তান সরকার তাতে কর্ণপাত না করে বিচার চালু রেখেছে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

২৯ সেপ্টেম্বর ফেনীর পরশুরামের নয়নপুরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে চতুর্থ বেঙ্গলের 'বি' কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই হামলায় মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করে ভারতীয় আর্টিলারি। প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে চলা এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১০ সৈন্য নিহত হন, ১৫ জন আহত এবং ৬ জনকে আটক করে মুক্তিবাহিনী। পরে হানাদার বাহিনী ফুলগাজীর মুন্সিরহাট থেকে আরও ব্যাপক সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করলে মুক্তিবাহিনী ফের আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গুলি ও রসদ ফুরিয়ে আসলে মুক্তিবাহিনীর নিরাপদে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায়। এদিন যুদ্ধের সময় মুন্সিরহাট থেকে একটি হানাদারদের ট্রলি পরশুরামের বিলোনিয়া যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়।

২৯ সেপ্টেম্বর রাত এগারোটার দিকে ফেনীর বল্লভপুর ও ছাগলনাইয়ায় মুক্তিবাহিনীর দুটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহে দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালায়। বল্লভপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যদিও কেউ হতাহত হননি। অন্যদিকে ছাগলনাইয়ায় মুক্তিবাহিনী আর্টিলারির সহায়তায় হামলা চালায়। এসময় বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হন ও ৭ জন আহত হন।

২৯ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ভালুকায় আফসার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার আবুল কাশেম ও প্লাটুন কমান্ডার মনিরুদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল ভালুকা ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। এই হামলায় ৪ জন হানাদার সেনা ও ৩ জন রাজাকার নিহত হন।

২৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার নওয়াবগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক মোট তিনটি অভিযানে ব্যর্থ হয়ে আড়িয়াল বিল ও আশপাশ থেকে মুক্তিবাহিনীর উপর ত্রিমুখী আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধে সেই প্রচেষ্টাও ভেঙে পড়ে।

২৯ সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটার দিকে চট্টগ্রামের পূর্বমধুপুরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আসার খবর পেয়ে আগে থেকেই ফাঁদ পেতে রাখে মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশে দল। এসময় মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি গাড়ি ধ্বংস হয়।

২৯ সেপ্টেম্বর বগুড়ার নশরতপুর স্টেশনের কাছে রেললাইনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে হানাদার সৈন্যবাহী ট্রেনের বেশ কয়েকটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সূত্র- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান, ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

দ্য টাইমস ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka denounces US 2023 human rights report

Criticising the recently released US State Department's 2023 Human Rights Report, the foreign ministry today said it is apparent that the report mostly relies on assumptions and unsubstantiated allegations

2h ago