মুক্তিযুদ্ধ

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১: একমাত্র লক্ষ্য বিজয় অর্জন

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৬ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে আসা বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রতিটি দেশেরই এখন শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে এগিয়ে আসা উচিত।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৬ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে আসা বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রধান ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী পিটিআইকে এক সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রতিটি দেশেরই এখন শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে এগিয়ে আসা উচিত। এখানে স্বার্থের খোঁজ না করে মানবিকতার খাতিরেই এগিয়ে আসা উচিত। এক্ষেত্রে জাতিসংঘকেই প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে। আজ বাংলাদেশকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। অথচ কিছু দেশ এখনো অব্যাহতভাবে গণহত্যা, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরেও পাকিস্তানকে সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে। এটি দুঃখজনক। বাংলাদেশ এখন স্বতন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষের এখন একমাত্র লক্ষ্যই বিজয় অর্জন করা।'

ঢাকায় এদিন

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এ এম মালিক রেডিও পাকিস্তানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গভর্নর বলেন, 'ছাত্রদের কোনো ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপে অংশ না নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে হবে। দেশ এক সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে এই সঙ্কটকালীন সময়ে ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বর জন্য ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। যদি কোনো ছাত্রকে দেশদ্রোহী কার্যকলাপে অংশ নিতে দেখা যায় তবে তাদের শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।'

২৬ সেপ্টেম্বর গোপীবাগে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা জেলার সভাপতি মোহাম্মদ হোসেনের বাসভবনে হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা। এসময় গেরিলা ও বাড়ির পাহারাদারদের সঙ্গে গোলাগুলি হয়।

ভারতে এদিন

২৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে 'নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বৈপ্লবিক মতবাদ ও বাংলাদেশ' এক আলোচনা সভার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয় 'বাংলাদেশ বিষয়ক আলোচনার জন্য এশীয় দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। বিশেষ করে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করা চীন ও ইরানকে। সেখানে শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয়টিও তুলে ধরা হোক। এতে করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বব্যাপী জোরদার হবে।

২৬ সেপ্টেম্বর ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড বিসিসিআইয়ের বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে মুক্তিসংগ্রামের সাহায্যে বিসিসিআই একাদশ চারটি চ্যারিটি ম্যাচ খেলবে হবে সিদ্ধান্ত হয়। সভায় একই সঙ্গে ২৬ সেপ্টেম্বর সর্বভারতীয় কিষান সভার ২১তম বার্ষিক অধিবেশনের প্রস্তাবে সোভিয়েত চুক্তির বিষয়ে অনুধাবন করার আহবান জানানো হয়। এতে বলা হয় ভারত সোভিয়েত চুক্তির পর আর কোনো ধরনের সংকোচ থাকা উচিত নয়। কারণ এই চুক্তির ফলে ভারত এবং সোভিয়েত নিজেদের সমর্থন প্রকাশ করেছে মুক্তিসংগ্রামের প্রতি।

পাকিস্তানে এদিন

২৬ সেপ্টেম্বর করাচিতে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে উত্থাপিত এক প্রস্তাবে বলা হয় অতিসত্বর শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হোক। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধ হোক। শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তিনিই নির্বাচিত হতেন। অথচ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হওয়া সত্ত্বেও তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়নি। এটি সম্পূর্ণরূপে তার প্রতি ও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি অবিচার। পূর্ব পাকিস্তানে কী হচ্ছে তা সমস্ত পৃথিবীর মানুষ দেখছে। ওখানে কী ধরনের বর্বরতা চলছে। এটি আমাদের পাকিস্তানি হিসেবেও চূড়ান্ত লজ্জাজনক।'

২৬ সেপ্টেম্বর সারগোদায় জমিয়তে উলামা ইসলামের সংবাদ সম্মেলনে দলটির সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ বলেন, 'উপনির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অবিলম্বে রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হোক এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা শাসন সরিয়ে বেসামরিক সরকার গঠন করা হোক। নয়তো শান্তির আশা করা যায় না। একমাত্র গণতন্ত্র পুনর্বহালের মধ্য দিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ 

২৬ সেপ্টেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে ২নং সেক্টরে ২৫০ সৈন্য ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল রামগঞ্জ বাজারের পূর্বদিকে অবস্থান নেয়। পরে হানাদার সৈন্য ও রাজাকারদের দলটি অগ্রসর হওয়ার সময় তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর দলটি। এই হামলায় ২০ হানাদার সেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং ২৭ জন আহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জে মুক্তিবাহিনী রায়চন্দ্রপুরের মধুমতী নদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর খাদ্য ও অস্ত্র বোঝাই ৪টি নৌকার উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি নৌকা ডুবে যায়। ১৫ জন রাজাকার ও ২ জন পাঞ্জাবি পুলিশ নিহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর ৪নং সেক্টরে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মুক্তিবাহিনীর ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল কুমারসাইলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যায়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর ৮নং সেক্টরের বানপুর সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দত্তনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এসময় হানাদার বাহিনীর ২ সৈন্য নিহত হয় এবং ২ জন আহত হয়।

২৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর  অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর দলটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং সবাই নিহত হয়।

সূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ 

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Diagnose dengue with ease at home

People who suspect that they have dengue may soon breathe a little easier as they will not have to take on the hassle of a hospital visit to confirm or dispel the fear.

9h ago