মুক্তিযুদ্ধ

২৬ জুলাই ১৯৭১: উন্মোচিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের ডাকটিকিট

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৬ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন লন্ডনে হাউস অব কমন্সের হারকোর্ট হলে সাংবাদিকদের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট উন্মোচন করা হয়। এই ডাকটিকিটগুলোর নকশা করেছিলেন প্রবাসী ভারতীয় বাঙালি বিমান মল্লিক।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৬ জুলাই গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন লন্ডনে হাউস অব কমন্সের হারকোর্ট হলে সাংবাদিকদের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকিট উন্মোচন করা হয়। এই ডাকটিকিটগুলোর নকশা করেছিলেন প্রবাসী ভারতীয় বাঙালি বিমান মল্লিক।

ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি জন স্টোনহাউস এই উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
মওলানা ভাসানীর বিবৃতি 
২৬ জুলাই ন্যাপ প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, 'বাম শক্তিসমূহকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে। আমাদের লক্ষ্য আমাদের প্রিয় দেশের স্বাধীনতা। আমরা যে যে মতাদর্শে বিশ্বাস করি না কেন, যে যে পন্থীই হই না কেন আমাদের উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো স্বাধীনতা অর্জন। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু অপশক্তি ও মীরজাফর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে হানাদারদের সাথে একত্রিত হয়ে জুলুম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই মীরজাফরদের বিরুদ্ধে আমাদের একত্রিত হতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে। 
ঢাকায় এদিন
২৬ জুলাই ইসলামী সাহায্য সংস্থা (ওআইসি) মহাসচিব টুংকু আবদুর রহমান চার দিনের ঢাকা সফর শেষে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। 
ভারতে এদিন 
২৬ জুলাই উত্তর প্রদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. রাজেন্দ্রকুমারী বাজপেয়ী উত্তর প্রদেশের ইরাফতগঞ্জ শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকার ইরাফতগঞ্জ শরণার্থী শিবিরে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত এক লাখ শরণার্থীকে স্থান দবে। কয়েকদিন আগেই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পতিত জমিতে এই শরণার্থী শিবির নির্মাণ করা হয়েছিল।
২৬ জুলাই দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পি সুন্দরিয়া বলেন, 'ভারত যদি বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় তবে পাকিস্তানকে উদ্ধার করতে চীনের সেনাবাহিনী এগিয়ে আসবে না। কারণ আমরা জানি চীন সমাজতন্ত্রের পাশেই থাকবে। অনেকে বলছেন ভারত চীনের ভয় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। এটা পুরোপুরি মিথ্যাচার। বরং ভারত ভয় পাচ্ছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তিকে। ভারতের উচিৎ শীঘ্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা। কারণ এতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নতুন এক জোয়ার সৃষ্টি হবে। ভারত যদি স্বীকৃতি দান করে সিপিএমের প্রতিটি সদস্য এবং কর্মী বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে।'
পাকিস্তানে এদিন 
২৬ জুলাই পাকিস্তান সরকার এক বিবৃতিতে বলে 'পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান কখনোই ভারতের আকাশসীমা অতিক্রম করেনি। ভারত যে অভিযোগ করছে তা ষড়যন্ত্রমূলক, বানোয়াট ও তীব্র মিথ্যাচার।' এর আগে গত ১৩ জুলাই ভারত সরকার দাবি করেছিল পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভারতের আকাশসীমায় ঢুকেছে। 
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন 
২৬ জুলাই জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন ও পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহীর সঙ্গে পৃথক বৈঠকে মিলিত হন। এসময় দুদেশের পরস্পর সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিরসনে ও শরণার্থীদের বিষয়ে জাতিসংঘের মনোভাব জানান উ থান্ট। উ থান্ট দুজনের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে বলেন, জাতিসংঘ সবসময় শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে। আলোচনার মধ্যে সবকিছু সমাধান সম্ভব। তিনি এসময় দুই পক্ষকেই আলোচনার টেবিলে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সবার জন্যই জাতিসংঘের দ্বার সবসময় উম্মুখ রয়েছে।  
২৬ জুলাই মার্কিন সিনেটে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চার্লস ব্রে বলেন, শরণার্থীবিষয়ক উপকমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি সম্প্রতি যে অভিযোগ করেছেন তা অমূলক। কেনেডি যদি অব্যাহতভাবে গোপন কূটনৈতিক তারবার্তা ফাঁস করেন এবং মার্কিন প্রশাসনের প্রতি দোষারোপ করতে থাকেন, তাহলে পররাষ্ট্র দপ্তর তাকে সাহায্য করতে পারবেন না। যা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে যাবে। প্রত্যেক সিনেটরেরই উচিৎ নিজের দেশের রাষ্ট্রীয় নথির গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এর আগে কেনেডি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে 'মার্কিন প্রশাসন পূর্ববঙ্গে চলমান গণহত্যা নিপীড়নের বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।' 
২৬ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টকে চিঠি পাঠান বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা। এই চিঠিতে তারা বলেন, ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার নিয়ে বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সামরিক আদালতে হবে গোপনে। এতে তিনি সুবিচার পাবেন বলে মনে হয় না। এমনকি আমরা তার প্রাণনাশের আশংকাও করছি।'
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
২৬ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকার 'শরণার্থীদের অন্য রাজ্যে পাঠানোর ব্যবস্থা নৈরাশ্যজনক' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়। 'যে হারে শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নেওয়া হচ্ছে তা একান্ত নৈরাশ্যজনক বলে রাজ্য সরকার মনে করছেন। কেন্দ্রের এই শম্ভুকগতি ব্যবস্থার ফলে সীমান্ত অঞ্চলে বহু এলাকায় শরণার্থী সাহায্য ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, পথ্য, ওষুধপত্র ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা এ যাবৎ করা সম্ভব হয়নি। রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের আশংকা এভাবে চললে শীঘ্রই শরণার্থীর স্রোতে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ভেসে যাবে। ওই দফতরের হিসাব অনুসারে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ৫২ লক্ষ ৭২ হাজার ১৫০ শরণার্থী এসেছেন।' 
২৬ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় 'শরণার্থী সেবায় টাটা গোষ্ঠী সংস্থা' শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'টাটা শিল্পগোষ্ঠীভূত সংস্থাগুলি বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ কাজ শুরু করেছেন চিকিৎসক সমাজসেবী ও ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে গঠিত টাটার এক সাহায্যকারী দলের জন্য টাটা গোষ্ঠীর সংস্থাগুলি ১০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছেন। এ ছাড়া প্রত্যেকটি সংস্থা ও টাটা ট্রাস্ট বাংলাদেশ সাহায্য কমিটিকে এক লক্ষ টাকা করে দিয়েছেন। এর আগে জামশেদপুরের টাটা সংস্থাগুলিও বিহার রেডক্রস সোসাইটিকে এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন। টিসকো, টেলকো ও ইনডিয়ান টিউবের কর্মীগণ ত্রাণ কাজের জন্য ১ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা দিয়েছেন।' 
দেশজুড়ে প্রতিরোধযুদ্ধ 
২৬ জুলাই কুমিল্লার মনোরা সেতুতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রথমে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও এক পর্যায়ে পিছু হটে। মুক্তিবাহিনীর হামলায় এসময় ৪ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। 
২৬ জুলাই কুমিল্লার নওগাঁও এবং আকসিনার মাঝামাঝি এলাকায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করে। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৭ সেনা নিহত হয় এবং চার জন আহত হয়। অন্যদিকে এক মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন। মুক্তিবাহিনীর দলটি নিজেদের ঘাঁটিতে ফেরার পথে সাইদাবাদ থেকে কসবাগামী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানী সৈন্যের উপর অ্যামবুশ করে। এই অ্যামবুশে হানাদার বাহিনীর ২১ সৈন্য ও ১ রাজাকার নিহত হয় এবং ৯ জন সেনা আহত হয়।  
২৬ জুলাই টাঙ্গাইলের ঘাটাইল কালিদাস পাড়ায় স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। প্রায় দুই ঘণ্টা ব্যাপী এই যুদ্ধে ১৯ জন রাজাকার নিহত হয় এবং ৭ রাজাকার আহত হয়। 
২৬ জুলাই কুমিল্লার নরসিংহের কাছে মুক্তিবাহিনী সাত রাজাকারের ছোট এক দলের ওপর অ্যামবুশ করে। এসময় তাদের কাছ থেকে ২টি রাইফেল, ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি ওয়ারলেস সেট ও ১২০ রাউন্দ গুলি উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনী। এসময় তারা আটক সাত রাজাকারকে ধরে নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। 
২৬ জুলাই নোয়াখালীর নরিমপুরে রেকি করতে গেলে রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার সুবেদার ওয়ালিউল্লাহকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে আটক করে। তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত বুদ্ধিতে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ এক রাজাকারকে গুলি করে দৌড়ে পালিয়ে যান।
তথ্যসূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র চতুর্থ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড।
দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জুলাই ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ২৭ জুলাই ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৭ জুলাই ১৯৭১   
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected] 

Comments

The Daily Star  | English
NBR suspends Abdul Monem Group's import and export

NBR suspends Abdul Monem Group's import, export

It also instructs banks to freeze the Group's bank accounts

3h ago