মুক্তিযুদ্ধ

১৭ আগস্ট ১৯৭১: ইয়াহিয়াকে সতর্ক করলেন কোসিগিন

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন রাষ্ট্রদূত এ এ রদিনভ। তিনি ইয়াহিয়া খানের হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্স কোসিগিনের দেয়া একটি চিঠি তুলে দেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন রাওয়ালপিণ্ডিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন পাকিস্তানে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন রাষ্ট্রদূত এ এ রদিনভ। তিনি ইয়াহিয়া খানের হাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্স কোসিগিনের দেয়া একটি চিঠি তুলে দেন।

এই চিঠিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্স কোসিগিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে সতর্ক করে লিখেছিলেন 'পাকিস্তান যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় তবে তা হবে আত্মহত্যার শামিল। পাকিস্তানের উচিত অযথা ভারতকে হুমকি না দিয়ে পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করা। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সরকার যে ধরনের নিপীড়ন চালাচ্ছে তা ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের জন্য পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসন যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে এবং বক্তব্য রেখেছে তা খোদ পাকিস্তানের জন্য ভয়ংকর আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যা করা হয়েছে তা চূড়ান্ত লজ্জাজনক। তিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত এবং এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া জনপ্রতিনিধি। অথচ তাকেই কিনা বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে।'

এদিন পাকিস্তানের 'খ' অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগের ১৬ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে ২৩ আগস্টের মধ্যে সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়। এই ১৬ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য হলেন, রাজশাহী থেকে নির্বাচিত আতাউর রহমান তালুকদার, দিনাজপুরের ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম, নওগাঁ থেকে মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ, রাজশাহী থেকে নির্বাচিত এ এইচএম কামরুজ্জামান, খালিদ আলী মিয়া ও শাহ মোহাম্মদ জাফরউল্লাহ, কুষ্টিয়া থেকে আমিরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান আক্কাস ও আবু আহমদ আফজালুর রশিদ বাদল, মেহেরপুর থেকে নির্বাচিত শহীদ উদ্দিন, নড়াইল থেকে খোন্দকার আব্দুল হাফিজ, মাগুরা থেকে সোহরাব হোসেন, যশোর থেকে এম রওশন আলী ও সুবোধ কুমার মিত্র এবং খুলনা থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ মহসীন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় তারা যদি যথাসময়ে সামরিক আদালতে উপস্থিত না হন তবে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য শুরু হবে।

অপারেশন ওমেগা

১৭ আগস্ট পূর্ব অনুমতি ছাড়াই ভারত থেকে হঠাৎই একদল বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। লন্ডনের পিস নিউজ পত্রিকার সম্পাদক ও সমাজসেবক রজার মুডি অপারেশন অমেগা নামের এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন। ত্রাণ সরবরাহের জন্য রজার মুডি কলকাতা থেকে আধা টন বিস্কুট, ওষুধ ও ৫০০ শাড়ি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এর আগে স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগের জন্য তাঁর সম্পাদিত পিস পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। অপারেশন ওমেগায় ছিল ৮ জন স্বেচ্ছাসেবী। যারা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ১৪৪ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর কোনো বিদেশি সাহায্য সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করলো। এদিন বেলা সোয়া ১২টার দিকে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তারা দুটো গাড়িতে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এসময় পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের গ্রেপ্তার করে যশোর নিয়ে যায়। পরদিন তাদের ভারতে পাঠানো হয়।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৭ আগস্ট নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের একজন মুখপাত্র বলেন, 'সম্প্রতি পূর্ব বাংলায় চলমান ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এবং সেখানে মানবিক অধিকার কতোখানি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং তার পরবর্তী ঘটনার রেশ কতদিন চলবে এই সম্পর্কে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য জাতিসংঘকে একটি কমিশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আইন কমিশন। একই সঙ্গে সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে ধরনের অত্যাচার সেনাবাহিনী ও সামরিক প্রশাসন করছে তা নিয়েও ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বন্ধ ও তাকে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছে আন্তর্জাতিক আইন কমিশন।'

১৭ আগস্ট বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলে, 'এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের অধীনে সামরিক আদালতে চরম গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের বিচারকার্য চলছে। লায়ালপুরের কাছে এই সামরিক আদালত বসেছে বলে ধারণা করছে বাকিরা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ হয়নি। যদিও কেউ কেউ বলছেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী এ কে ব্রোহি তার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়ও শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে যুক্ত ছিলেন এ কে ব্রোহি।

১৭ আগস্ট ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তা পরিষদের কয়েকজন সদস্যের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেয়। জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির নিকট এক বিশেষ বার্তাবাহী চিঠিতে এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন ভারত ক্রমাগত যে ধরনের উসকানিমূলক কথা বলছে তা চরম বিভ্রান্তমূলক।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৭ আগস্ট দাউদকান্দি ফেরিঘাটে আক্রমণ করে নৌ কমান্ডোদের একটি দল। ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে আক্রমণে রওনা হয়েও প্রবল ঝড়-বৃষ্টি ও গাইড অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেদিনের আক্রমণ একদিনের জন্যে স্থগিত করেছিলেন দাউদকান্দি ফেরিঘাটে আক্রমণকারী নৌ-কমান্ডো দলনেতা শাহজাহান সিদ্দিকী। এ অপারেশনটিও ছিল মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোদের 'অপারেশন জ্যাকপট'-এরই অংশ। একদিন পরে ১৭ আগস্ট দিবাগত রাত পৌনে তিনটায় ৯ জনের এই কমান্ডোদল সফল আক্রমণ চালায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটে এবং এতে দুটি ফেরি, পন্টুন, লঞ্চঘাট ও জ্বালানি তেলের ড্রামগুলো তেলসহ ধ্বংস হয়। এ অপারেশনে অন্তত ১২ জন পাহারারত রাজাকার ও পুলিশ নিহত এবং বেশ কিছু সংখ্যক হানাদার সেনা আহত হয়। সফল অপারেশন শেষে নৌ-কমান্ডোরা নিরাপদে তাদের ক্যাম্পে ফিরে যান।

১৭ আগস্ট ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিন আহমদের আহ্বানে তার নিয়ন্ত্রণাধীন সুন্দরবন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় বরিশালের চারটি থানা আক্রমণের জন্য পৃথক পৃথক দল গঠন করা হয়। দলগুলো, ভান্ডারিয়া থানার জন্য সুবেদার আজিজ এবং লতিফের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল, কাউখালী থানার জন্য কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল, রাজাপুর থানার জন্য সুবেদার রুস্তমের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ও মঠবাড়িয়া থানার জন্য ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি দল গঠন করা হয়।

১৭ আগস্ট কুমিল্লায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনটি নৌকায় সৈন্য বোঝাই হয়ে শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। হানাদার সেনাদের এই দলটিকে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশে নৌকার আরোহী ১৮ জন হানাদার সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর আরেকটি দল এগিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।

১৭ আগস্ট সিলেটের বানিয়াচঙ্গ থানা সদর থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক বিশাল দল মাকালকান্দি গ্রামে এসে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানি হানাদারদের ব্রাশফায়ারে এদিন ৮৭ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আরো কয়েকশ মানুষ। গণহত্যা শেষে প্রতিটি বাড়িতে লুটপাট চালায় হানাদার সেনা ও রাজাকারেরা। এদিন পাশের গ্রাম হারুনিবাসী ৫ জনকেও হানাদাররা হত্যা করে।

১৭ আগস্ট রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনী সারদা পুলিশ একাডেমীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কোম্পানীর ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই অপারেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই শহীদ হন।

১৭ আগস্ট টাঙ্গাইলে ভাতকুরা ও পয়লার মাঝখানে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা বাকু শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধা বিমান বিহারী দাস হানাদার সেনাদের হাতে ধরা পড়েন।

১৭ আগস্ট কুড়িগ্রামের চিলমারীর পূর্বদিকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের দুটি অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। এসময় ৪ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র সপ্তম, দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান ১৮ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৮ আগস্ট ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

16m ago