১৬ অক্টোবর ১৯৭১: শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশকে শত্রুমুক্ত করবো
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৬ অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দল। এদিন মুজিবনগরে সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, 'সারাদেশেই এখন মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে হানাদার বাহিনী দিশেহারা। মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষিত ও স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে সম্মুখযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে রকম শৌর্য ও বীরত্ব প্রদর্শন করছেন তাতে হানাদার বাহিনী প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা বহু জায়গায় রেললাইন ও সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানি সেনাবাহী ট্রেনের ওপর নিয়মিত আঘাত হানছেন। বহু জায়গায় হানাদার সৈন্যরা ট্রেনে উঠতেও ভয় পাচ্ছে। অনেক জায়গায় রাতে হামলার ভয়ে ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে।'
সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীর মুখপাত্র আরও বলেন, 'শীঘ্রই বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিবাহিনীর একটি নিজস্ব নৌ বহর চালু হচ্ছে। এরই মধ্যে বিমান সেনাদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিমান ইউনিট ও গঠন করা হয়েছে। আমরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও দেশকে শত্রুমুক্ত করবো।'
১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন এক প্রেসনোটে উপ-নির্বাচনের প্রতীকের নাম ঘোষণা করে। একই সঙ্গে এক ঘোষণায় নির্বাচন কমিশন বলে, 'গত নির্বাচনে যে দল যে প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল, এবারে নির্বাচনে সেই প্রতীকই বরাদ্দ থাকবে।'
ঢাকায় এদিন
১৬ অক্টোবর ঢাকায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাইদ চৌধুরীর ময়মনসিংহ রোডস্থ বাসায় আগুন লাগিয়ে দেয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির একটি দল।
এদিন পিলখানার পাশের রাস্তা দিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে হানাদার বাহিনীর যাওয়ার রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল মাইন পেতে রাখে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে হানাদার বাহিনীর একটি টহল দলের জিপ যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণে জিপে থাকা ৪ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ২৩ জন গুরুতর আহত হয়।
১৬ অক্টোবর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) সভাপতি মাহমুদ আলী এপিপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'পাকিস্তান আন্তরিকভাবেই পাকিস্তানি নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী এবং সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু ভারত বিভিন্ন অজুহাতে টালবাহানা করছে। ভারত মূলত উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনীতি করছে বিশ্বমহলে। ভারতের কারণেই উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তন বাধার মুখে পড়েছে।'
ভারতে এদিন
১৬ অক্টোবর দিল্লিতে নব কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'ভারত এখন সম্পূর্ণরূপে শত্রুদের হামলার মোকাবিলায় প্রস্তুত। যদি পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের ধৃষ্টতা দেখায় তবে ভারত তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৬ অক্টোবর ইরানের রাজধানী তেহরানে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে দুই ঘণ্টা ব্যাপী একান্ত বৈঠক করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এসময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নিকে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার আহবান জানান।
এদিন সন্ধ্যায় যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সঙ্গে বৈঠক করেন ইয়াহিয়া খান। এসময় দুই প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান ও যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৬ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার শালদা নদী রেল স্টেশনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনীর দুই প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা। এই যুদ্ধে ৫ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ১০ সেনা আহত হয়।
১৬ অক্টোবর খুলনার চালনা বন্দরে সাবমেরিনার বদিউল আলমের নেতৃত্বে এদিন নৌ-কমান্ডোরা চালনা বন্দরে এক দুঃসাহসিক অপারেশন চালায়। এই অভিযানে ফ্রগম্যানরা লাইটনিং ও আল মুরতজাসহ মোট চারটি জাহাজ ধ্বংস করেন। এই অপারেশনে ফ্রগম্যান আনোয়ার অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
১৬ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কুমারসাইলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের একটি দল হানাদার বাহিনীর বাঙ্কারের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই সময় হানাদার বাহিনী গেরিলাদের উপর শাহবাজপুর থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টারের মাধ্যমে গোলাবর্ষণ ও বৈরাগীটিলা থেকে মাঝারি মেশিনগানের গুলি ছোঁড়ে। মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময়ের পর মুক্তিবাহিনীর দলটি ক্যাম্পে ফিরে যায়।
১৬ অক্টোবর দিনাজপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মর্টারের সাহায্যে বোয়ালগঞ্জে অবস্থানরত হানাদার সেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর ১৭ জন সৈন্য নিহত হয়। এদিন রাতে দিনাজপুরে মুক্তিবাহিনীর আরেক দুর্ধর্ষ আক্রমণে হানাদার বাহিনীর ১০ জন সৈন্য নিহত হয়।
এদিন, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাটে মুক্তিবাহিনীর পৃথক দুটি দল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। মুক্তিবাহিনীর এই দুটি হামলায় বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড
দৈনিক পাকিস্তান ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
দৈনিক ইত্তেফাক ১৭ অক্টোবর ১৯৭১
Comments