শত নির্যাতনেও বলেননি সহযোদ্ধাদের নাম
ঢাকার ইস্কাটনের ধনী পরিবারের ছেলে মাগফার উদ্দিন চৌধুরী আজাদ। তাদের ইস্কাটনের বাড়িটা ছিল দেখার মতো। পৌনে দুই বিঘা জমির উপরে বাড়ি। আজাদ একাধারে ছিলেন ফ্যাশনেবল এবং পড়াশোনায় দুর্দান্ত মেধাবী। এছাড়াও সিনেমার পোকা ছিলেন আজাদ। ছিলেন এলভিস প্রিসলির ভীষণ ভক্ত। সিনেমা হলে কোনো নতুন সিনেমা এলেই সেই সিনেমা দেখা চাই আজাদের। সঙ্গে সঙ্গী খালাতো ভাইয়েরা। আজাদের ছিল উদার হাত। বন্ধু বান্ধবদের যে কোন বিপদ আপদে সবার আগেই এগিয়ে আজাদ।
১৯৬০ সালে আজাদ যখন ক্লাস সিক্সে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়েন তখন তার বাবা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। তার মা মোসাম্মাৎ সাফিয়া বেগম সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। উঠলেন পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের ৬১ বি.কে.দাস রোডের আজাদের খালা শোভনা বেগমের বাড়িতে। আজাদ থাকতেন তাদের ইস্কাটনের সুরম্য বাড়িতে। প্রায়ই মাকে দেখতে আসতেন। ওখানে থাকার সময়েই সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন আজাদ। এর কিছুদিনের মধ্যে মারা গেলেন তার খালা। যার ফলে তার মা জুরাইন মাজারের পাশে এক বাসায় উঠলেন। ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আজাদ গেলেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের উপর অনার্স করতে।
এরই মধ্যে মাকে নিয়ে হাজারো পরিকল্পনা তার। আলাদাভাবে মাসহ থাকবেন আজাদ। তার খালাতো ভাইবোনেরা মিলে একসঙ্গে বাসা নেবেন। ১৯৭০ সালে ইতিহাসের উপর অনার্স শেষ করে দেশে ফিরে এলেন আজাদ। সঙ্গে তার বন্ধু আবুল বাশার। আবুল বাশারের সঙ্গে আজাদের পরিচয় পাকিস্তানের করাচি থাকতেই। করাচিতে আজাদ পড়তেন ইতিহাসে আর বাশার পড়েছিলেন সাংবাদিকতায়। সে বছরই মাকে নিয়ে মগবাজারেই নতুন বাসা নিলেন আজাদ। সঙ্গে সঙ্গী খালাতো ভাইবোন ও বন্ধু আবুল বাশার। ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। আর আবুল বাশার সাংবাদিকতা শুরু করলেন মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। ১৯৭১ এর শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করলেন আজাদ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেখলেন তার বন্ধুরা যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, ফিরে এসেছে আগরতলা থেকে, ট্রেনিং নিয়ে। জুন মাসের শুরুতে অপারেশন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল দিয়ে গেরিলাদের অভিযান শুরু। একে একে গেরিলারা বেশ কয়েকটি অপারেশন করে ফেললো। আজাদের বন্ধুরা আজাদকে বললো, 'চল আমাদের সাথে, অপারেশন করবি। তুই তো বন্দুক পিস্তল চালাতে জানিস। তোর আব্বার তো বন্দুক আছে, পিস্তল আছে, তুই সেগুলো দিয়ে অনেকবার শিকার করেছিস। তুই পারবি চল।'
আজাদ বললেন, 'এই জগতে মা ছাড়া আমার কেউ নেই, আর মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা যদি আমাকে অনুমতি দেয় তবেই আমি যুদ্ধে যাবো।'
একদিন রাতে খেতে বসে মায়ের কাছে আজাদ অনুমতি চাইলে তার মা সাফিয়া বেগম বললেন,'বাবা তুমি অবশ্যই যুদ্ধে যাবে।' মায়ের অনুমতি পেয়ে আজাদ যুদ্ধে গেলেন। একাধিক অপারেশনে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন তার মধ্যে অন্যতম।
২৯ আগস্ট বাড়িতেই ছিলেন আজাদ। সেদিন আজাদের বাবার মামাতো ভাই সেকান্দার হায়াত খানও এসেছেন। আছে জুয়েল ও বন্ধু আবুল বাশার। সেদিন টিভি দেখে ঘরের বাকিরা ঘুমিয়ে গেলে তাস নিয়ে বসলেন আজাদ, জুয়েল, কাজী কামাল এবং আবুল বাশার। ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত ২টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অভিযান চালায় আজাদদের মগবাজারের বাড়িতে।
সে রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শহীদ আজাদের খালাতো ভাই গোলাম গাউসে আজম চঞ্চল। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, 'প্রতিদিনের মতো আমরা খেয়ে দেয়ে টিভি দেখে ঘুমিয়ে গেলাম। আজাদদা, কাজীদা, জুয়েল এবং বাশার ভাই তাস খেলছিলেন। রাত ২টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী রেইড করে আমাদের বাড়িতে। দরজা ভেঙে তারা আমাদেরও ঘুম থেকে তুললো। এসময় তারা বহু খুঁজে তল্লাশি চালিয়ে স্টোর রুমে ফসফরাস পেল, পেয়েছিল একটি থ্রি টু পিস্তল। পিস্তল পেয়ে তারা আমাকে গালি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো 'এটি কি?' আমি বললাম 'আমি জানি না।' তখন আমাকে ঘুষি মারলো। আমি তীব্র ব্যথায় বসে পড়লাম। তখন বাম পায়ের বুটের আঘাত করলে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। এরপর তারা আজাদদাকে খুঁজছিল। মেজর সরফরাজ বলছিলো 'আজাদ কাহা হে? তুম আজাদ হে বলে আজাদদাকে ধরতেই আজাদদা বললেন, 'মাগফার উদ্দিন চৌধুরী। ওটাই তো তার আসল নাম ছিলো। তখন মেজর সরফরাজ তুমি মিথ্যা বলছো। তুমিই আজাদ। আজাদ দাদাকে যখন পাকিস্তানি মেজর সরফরাজ ঘুষি মারলো তখন কাজী দাদা স্টেনগান থাবা দিয়ে নিয়ে ধস্তাধস্তি শুরু করে ব্রাশ ফায়ার করে পালিয়ে যায়। এরপর আজাদ দাদা, জুয়েলদা সহ বাকি সবাইকে আটক করে গাড়িতে তুলে ফেললো।'
এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে আজাদের উপর চালানো হয়েছিলো চরম পৈশাচিক নির্যাতন।
৩১ আগস্ট তাদের রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হলে আজাদের মা আর খালাতো ভাই চঞ্চল রমনা থানায় এসেছিলেন আজাদকে দেখতে। তার সারা গায়ে নির্যাতনের চিহ্ন। কালশিটে দাগ, গাল ফোলা, চোখের কাছে কেটে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে। মা চিনতে পারেন না তার আদরের আজাদকে। মাকে পেয়ে আজাদ বলেন, 'কী করবো আম্মা, এরা তো খুব মারে। সবার নাম বলতে বলে।'
সাফিয়া বেগম বললেন, 'তুমি কি সবার নাম বলে দিয়েছো?'
আজাদ বললেন, 'না বলিনি। যদি আবার মারে! আর তো সহ্য করতে পারছি না।'
সাফিয়া বেগম বললেন, 'ধৈর্যধারণ করো বাবা। মুখ বুজে সহ্য করে থাকো।' তিনি একথা বলে বের হবেন এই মুহূর্তে আজাদ বললো, 'দুদিন ধরে তো ভাত খাই না। কালকে দিয়েছিল খেতে পারি নাই।'
সাফিয়া বেগম বললেন, 'আগামীকাল তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসবো বাবা।'
আজাদের মায়ের সঙ্গে পরদিন রমনা থানায় গিয়েছিলেন আজাদের খালাতো ভাই গোলাম গাউসে আজম চঞ্চল। তিনি বলেন, 'পরের দিন সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ। সেদিন সকাল বেলা আম্মাসহ মগবাজারের বাসা থেকে টিফিনকারীর পাঁচ বাটিতে করে মুরগির মাংস, মাছের চচ্চড়ি আর গরুর মাংস নিয়ে আমরা গেলাম রমনা থানায়। দুপুর দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আজাদদার দেখা পেলাম না। এরপর গেলাম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। আমার দুই ভাই জায়েদদা আর টগরদাকে দেখতে। আগের দিন যে আজাদদার সঙ্গে আম্মার আর আমার যে দেখা হলো সেটাই ছিল শেষ দেখা। বাড়ি ফিরে আম্মা রাতে খেতে গিয়ে বললেন, 'আমার ছেলে ভাত খায়নি, আমিও ভাত খাবো না। আমার ছেলে যেদিন ফিরে আসবে সেদিন আমি ভাত খাবো।'
ধারণা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের ৪ সেপ্টেম্বর ক্র্যাক প্লাটুনের অন্য গেরিলাদের সঙ্গে আজাদকেও হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আজাদ নিখোঁজ হওয়ার ১৪ বছর পর মারা যান সাফিয়া খাতুন। বেঁচে থাকতে কোনোদিন ভাত খাননি আজাদের মা, মাটিতে ঘুমাতেন। স্বাধীন দেশে মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদের স্বপ্ন ছিল রাষ্ট্রদূত হয়ে নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি ঠিক, কিন্তু গোটা বিশ্বকে জানিয়ে গেছেন একটি দেশের জন্য স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য কতোখানি আত্মত্যাগ করা যায়।
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments