স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশের ৫০ বছর
আজ ঐতিহাসিক ২৯ জুলাই। জাতীয় ডাকটিকিট দিবস। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একযোগে মুজিবনগর, কলকাতার বাংলাদেশ মিশন ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথমবার প্রকাশিত হওয়া ডাকটিকিটের সংখ্যা ছিল ৮টি। ডাকটিকিটগুলোর নকশা করেছিলেন প্রবাসী বাঙালি বিমান মল্লিক।
অবশ্য ডাকটিকিটগুলো সাংবাদিকদের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল তিন দিন আগে তথা মুক্তিযুদ্ধের ২৬ জুলাই, যুক্তরাজ্যের লন্ডনের হাউস অব কমন্সের হারকোর্ট হলে।
পরে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে শিল্পী বিমান মল্লিক সেই আটটি ডাকটিকিট উঁচিয়ে ধরেন। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি জন স্টোনহাউস, বিশিষ্টজনেরাসহ বহু প্রবাসী বাঙালি।
কীভাবে মাথায় এলো সেই ডাকটিকিটের নকশা?
বিমান মল্লিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, '১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ ডাকবিভাগ মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ডাকটিকিট প্রকাশের জন্য নকশা আহ্বান করে। আমার নির্বাচিত নকশা দিয়ে ১৯৬৯ সালের ১৩ আগস্ট মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়। সে নকশার জন্য আমি স্বর্ণপদকও পাই। ব্রিটিশ ডাকবিভাগ সেবারই দেশের বাইরের কোনো ব্যক্তিত্বের ওপর প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
মহাত্মা গান্ধীর ডাকটিকিট নকশা করার সময় ব্রিটিশ এমপি ও ব্রিটিশ ডাকবিভাগের তৎকালীন পোস্টমাস্টার জেনারেল জন স্টোনহাউসের সঙ্গে আমার টেলিফোনে যোগাযোগ হয়। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি আমাকে বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিট নকশা করার অনুরোধ জানান। তার সঙ্গে আমি দেখা করি ১৯৭১ সালের ৩ মে। ২৯ এপ্রিল থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত জন স্টোনহাউসের সঙ্গে আমার অনেকবার সাক্ষাৎ হয়। তার অনুরোধেই আমি বিনা পারিশ্রমিকে বাংলাদেশের ডাকটিকিটের নকশা করি। ১৮ মে আমি আটটি ডাকটিকিটের নকশা জন স্টোনহাউস ও তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে দেখাই। নকশাগুলো তারা অনুমোদন করলেন। এরপর স্টোনহাউস নকশাগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন নেয়।'
কী বার্তা ছিল সেই ডাকটিকিটগুলোতে? কতো মূল্যমানের ছিল?
প্রথম ডাকটিকিটটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র সম্বলিত গাঢ় লাল, নীল ও বেগুনী রঙের। ১০ পয়সা মূল্যের এই ডাকটিকিটের বার্তা হলো আমাদের ভূখণ্ড এবং দেশের পরিচয় বিশ্বকে জানানো। আর ডাকটিকিটে বাংলাদেশের মাঝ বরারর যাওয়া কর্কটক্রান্তি রেখা দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় ডাকটিকিটটি ছিল ২৫ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ডকে ফুটিয়ে তোলা। যেখানে বিমান মল্লিক রক্তলাল ছাপের ওপর হলুদ বর্ণে লিখেছেন "DACCA UNIVERSITY"। উপড়ে নিচে গণহত্যা ও ২৫-২৬ মার্চের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই ডাকটিকিটের মূল্য ছিল ২০ পয়সা। বিমান মল্লিক জানিয়েছিলেন এই আটটি ডাকটিকিটের মধ্যে 'ম্যাসাকার অ্যাট ঢাকা ইউনিভার্সিটি' তার সবচেয়ে প্রিয়।
তৃতীয় ডাকটিকেটে বোঝানো হয়েছে ৭৫ মিলিয়ন তথা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা। ধূসর বর্ণের এই ডাকটিকেটের মূল্য ৫০ পয়সা।
চতুর্থ ডাকটিকিটটি মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকায় গড়া। এই ডাকটিকেটের মূল্য ১ টাকা।
পঞ্চম ডাকটিকেটে তুলে ধরা হয়েছিল ১৯৭০ এর নির্বাচনের ফল। যেখানে ব্যালট বাক্সের উপরে ৯৮ শতাংশ দিয়ে বোঝানো হয়েছে আওয়ামী লীগের ৯৮% ভোট প্রাপ্তি। যেখানে মানুষ গণতান্ত্রিকভাবে আওয়ামী লীগকে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী করেছিল। এই ডাকটিকিটের মূল্য ছিল ২ টাকা।
ষষ্ঠ ডাকটিকিটে মুক্তিযুদ্ধের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসকে বলা হয়েছিল দীর্ঘদিনের পরাধীনতা ও নিপীড়নের শিকল ভাঙা। গাঢ় সবুজ বর্ণ ও পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে সবুজ রাঙা এই ডাকটিকিটে বাকি বর্ণগুলো ছিল নীল রঙে। এই ডাকটিকিটের মূল্য ছিল ৩ টাকা।
সপ্তম ডাকটিকিটটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত। এই ডাকটিকিটের মূল্য ছিল ৫ টাকা।
সর্বশেষ ও অষ্টম ডাকটিকিটটি ছিল একপাশে উজ্জ্বল গোলাপি রাঙা। সেখানে মাঝে বাদামী রঙের আঁকা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। বাম পাশে বেগুনী রঙে লেখা "SUPPORT BANGLADESH" বা বাংলাদেশকে সমর্থন করুন। এই ডাকটিকিটটি ছিল বাংলাদেশকে সাহায্য প্রত্যাশী প্রতীক হিসেবে তৈরি।
কীভাবে, কোথায় ব্যবহার হতো, সেই ডাকটিকিটগুলো
বাংলাদেশে আসার পর সেই ডাকটিকিট মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ও দেশের বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো বিভিন্ন চিঠি, রসদ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রে ব্যবহার হতো। এই ডাকটিকিটগুলো ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে পরিচিত করার বড় মাধ্যম।
আজ ২৯ জুলাই প্রথম প্রহরে সেই ঐতিহাসিক ডাকটিকিটগুলোর নকশাকারী শিল্পী বিমান মল্লিক ফেসবুকে ডাকটিকিট দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নতুন একটি ডাকটিকেটের ছবি প্রকাশ করেন। যেখানে লেখা আছে,
শুভেচ্ছা 50
29 July 1971- 20 July 2021
1971 STAMP DAY GREETINGS 2021
শুভেচ্ছা বাণীতে বিমান মল্লিক বলেন, '১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই বাংলাদেশের জন্য ৮টি ডাকটিকেটের প্রথম সেট ইস্যু করা হয়েছিল। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যরা স্বীকৃতি দেয়নি। তখন ডাকটিকিটগুলিতে লেবেল বা স্টিকার বলা হতো। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তানী হানাদারদের থেকে মুক্তি লাভ করে। এবং তখন সেই ডাকটিকিটগুলো ডাকটিকিট স্ট্যাম্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। আমি জেনেছিলাম ২০০৩ সাল থেকে পিএবই ফিলেটলিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ দিবসটি ডাকটিকিট দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ২৯ জুলাই ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ প্রথম ডাকটিকিটগুলোর নকশাকারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আমি এজন্য গভীরভাবে সম্মানিত বোধ করছি। আমি আশা করি একদিন ২৯ জুলাই বিশ্ব ডাকটিকিট দিবস হিসেবে পালিত হবে। যারা দিবসটি উদযাপন করছেন তাদের সবাইকে আমার শুভেচ্ছা।'
প্রসঙ্গত ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই থেকে ঐতিহাসিক সেই দিনটি বাংলাদেশে 'জাতীয় ডাকটিকিট দিবস' পালিত হয়ে আসছে।
তথ্যসূত্র:
বিমান মল্লিকের ভাষ্য নেয়া হয়েছে এ টি এম আনোয়ারুল কাদির কর্তৃক বিমান মল্লিকের সাক্ষাৎকার থেকে।
স্বাধীন দেশের মুক্ত ডাকটিকিট/ এ টি এম আনোয়ারুল কাদির।
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments