মুক্তিযুদ্ধ

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুকে কাঁপন ধরানো নকশী বিওপির যুদ্ধ

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আওতাধীন নকশী বিওপির যুদ্ধ। ব্যাটল অব নকশী ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য সত্যিকার অর্থেই এক চ্যালেঞ্জ। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা নকশী বিওপি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক ঘাঁটি।
নকশী বিওপি যুদ্ধের নকশা।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আওতাধীন নকশী বিওপির যুদ্ধ। ব্যাটল অব নকশী ছিল মুক্তিবাহিনীর জন্য সত্যিকার অর্থেই এক চ্যালেঞ্জ। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা নকশী বিওপি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক ঘাঁটি।

এই ঘাঁটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বড় কারণ ছিল সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার এবং মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে যেন মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করতে না পারে বাংলাদেশে সেই সুরক্ষা দেওয়া। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল।
নকশী বিওপির অবস্থান
নকশী বিওপি ছিল তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার ঝিনাইগাতি থানায়। যা বর্তমানে শেরপুর জেলায় পড়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের অধীনে ছিল নকশী বিওপি। এক প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্য ও দুই প্লাটুন রাজাকারের সমন্বয়ে গঠিত নকশী বিওপি ছিল দুর্ভেদ্য এক ঘাঁটি। বিশেষ করে এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা। বিওপির চারপাশে পুরু দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া, আশপাশের গোলা প্রতিরোধক ও আন্তঃযোগাযোগ সুবিধাসম্পন্ন কংক্রিটের তৈরি বাঙ্কারসহ ৬০০ গজে পুঁতে রাখা অ্যান্টি পার্সোনাল মাইন, বুবি ট্র্যাপস ও বাঁশের কঞ্চি।
যেভাবে রচিত হয়েছিল নকশী যুদ্ধের খসড়া
নকশী ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের আওতাধীন। রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর এ জে এম আমিনুল হক ও সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী। ৩১ জুলাই জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মেজর আমিনুল হক ও ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী নকশী বিওপিতে আক্রমণের পরিকল্পনা আঁটেন। মূল আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন আমীনকে। ঠিক হয় ৩ আগস্ট ব্যাটালিয়নের ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানি এই অপারেশনে অংশ নেবে। কিন্তু এর আগে ৩১ জুলাই থেকে ২ আগস্ট তিন দফা রেকি করা হয়েছিল। এই রেকিতে ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সুবেদার হাকিম। কারণ সুবেদার হাকিম একসময় নকশী বিওপিতে কর্মরত ছিলেন বলে সব নখদর্পণে ছিল তার।
প্রথম রেকি
ক্যাপ্টেন আমীন ও সুবেদার হাকিম প্রথমদিন উঁচু টিলা থেকে বাইনোকুলার দিয়ে বিওপির রান্নাঘর, মাইন ফিল্ড, বাঙ্কার, প্রবেশপথসহ বহু কিছু পর্যবেক্ষণ করেন। বলে রাখা ভালো বিওপির বাবুর্চির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল মুক্তিবাহিনীর। তিনিই প্রথমদিন তথ্য দিয়েছিলেন আজ ৪৫ জন সেনা ও ৪০ রাজাকারের রান্না হয়েছে। শিগগির ৬৫ জন সেনা যুক্ত হবে বিওপিতে।
দ্বিতীয় রেকি
এদিন ক্যাপ্টেন আমীন তার অধীনস্থ প্লাটুন অধিনায়কদের নিয়ে হালজাতি, নালাপথ ও শালবন এলাকা রেকি করে এফইউপি ও ফায়ার বেইসের অবস্থান বুঝিয়ে দেন।
তৃতীয় রেকি
তৃতীয় বা শেষদিন হালছটি গ্রামে নালার পাড়ে রেকি করেন ক্যাপ্টেন আমীন। অপারেশনের আগের দুই রাত রেজিমেন্টে নিঃশব্দে পানিতে হাঁটার অনুশীলন হয়েছিল যেন অপারেশনের সময় নালা অতিক্রমের সময় শব্দ না হয়।
অপারেশন চূড়ান্ত ও সর্বশেষ পরিকল্পনা
এদিনই ফোর্স কমান্ডার জিয়াউর রহমান প্রস্তুতি দেখে অপারেশন চূড়ান্ত করেন। ঠিক হয় চূড়ান্ত আক্রমণ হবে ৩ আগস্ট দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে। এফইউপি বিওপির পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব দিকের শালবন ও ফায়ার বেইস একটি উঁচু টিলায়।
ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে নকশী বিওপির উপর আক্রমণ করবে। একই সঙ্গে আরআর ও মেশিনগান থেকে সাপোর্ট দেয়া হবে। কাট অফ পার্টি থাকবে রাংটিয়ায় যেন ঝিনাইগাতির দিক থেকে বিওপিতে কোনো সাহায্য না আসে, আর পাকিস্তানিরা কেউ পালাতে না পারে। একই সঙ্গে তারা প্রয়োজনে কাভারিং ফায়ার দিবে, রিজার্ভ ফোর্স হিসেবেও থাকবে। ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়া ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডার আমিনুল হক থাকবেন পার্শ্ববর্তী হালজাতি গ্রামে।
অপারেশন শুরু
রাত ১২টায় সম্মিলন স্থান থেকে এফইউপিতে মুক্তিযোদ্ধারা পৌঁছালে রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার শুরু হয়। আর বিওপির দিক থেকে শুরু হয় পাল্টা আর্টিলারি ফায়ার। কিন্তু এফইউপিতে অবস্থানরত স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা কামানের প্রচন্ড আওয়াজে ভয় পেয়ে যায়। কারণ ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে মাত্র ২১ জন ছিলেন বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাকি সবাই স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এমন সময় পাকিস্তানি আর্টিলারির ৩টি শেল মুক্তিবাহিনীর এফইউপিতে এসে পড়ে। শেলের আঘাতে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। এদিকে প্লাটুনের সৈনিকেরা আহতদের সেবার নাম করে এফইউপিতেই থেকে যান। অন্যদিকে আরআর ও মেশিনগান থেকে বিওপির উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। পার্শ্ববর্তী হালজাতি গ্রাম থেকে ২টি ইপিআর প্লাটুন গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা এক্সটেনডেন্ট লাইনের সামনে এগোলে ক্যাপ্টেন আমীন মর্টার গ্রুপকে নালার আড়াল থেকে গোলাবর্ষণ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা নালার আড়াল থেকে আন্দাজের ওপর ফায়ার করতে শুরু করে। এসময় নায়েব সুবেদার কাদের ও বাচ্চুর ৫, ৬ নম্বর প্লাটুন সহযোগে বিওপির গেটের ভিতর দিয়ে ঢোকার কথা। কিন্তু ওই প্লাটুনের সৈনিকরাও আড়াল থেকে এলোমেলো ফায়ার করতে থাকে।

নকশী বিওপি যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম

এমন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নির্দেশ শিথিল হয়ে পড়লে ক্যাপ্টেন আমীন বাধ্য হয়ে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এসময় হাবিলদার নাসির দোর্দণ্ড প্রতাপে এগোতেই ক্যাপ্টেন আমীন নায়েক সিরাজকে নিয়ে ডানদিকের বাংকারের দিকে এগিয়ে যান। এরই মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করেন।
ক্যাপ্টেন আমীন 'চার্জ' বলে আদেশ দিতেই মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি বিওপি আক্রমণের জন্য দৌড়াতে শুরু করে বিওপির ১০০ গজের মধ্যে পৌঁছাতেই বিওপি থেকে একটি আর্টিলারি শেল তাদের ওপর পড়ে। এসময় হাবিলদার নাসিরসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারাও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। বিওপির ৫০ গজের মধ্যে পৌঁছাতেই ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর পায়ে শেলের একটি টুকরা আঘাত হানে। মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হলেও পলায়নরত অবিশ্রান্তভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর গুলি চালিয়েই যাচ্ছে, এসময় মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আলম মাইনের আঘাতে শহীদ হন। অন্যদিকে পায়ে বাঁশের কঞ্চিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান ক্যাপ্টেন আমীন। এসময় এক পাকিস্তানি সেনা তাকে হত্যার জন্য এগিয়ে আসতেই মুক্তিবাহিনীর কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সালাম গুলি করে সেই সেনাকে। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে সেই সেনা। পেছনে নালা থেকে মাথা নিচু করে যারা গুলিবর্ষণ করছিলেন তাদের গুলিতে অনেক মুক্তিযাদ্ধা হতাহত হন।
এদিকে আহত হয়েও ক্যাপ্টেন আমীন তখনো গুলি চালাচ্ছিলেন এবং গার্ড হানিফকে ডান দিকের বাংকারে গুলি করার নির্দেশ দিলেন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ। হানিফ ক্যাপ্টেন আমীনকে বললেন, 'স্যার, আপনি পেছনে চলে যান, আমি কভার দিচ্ছি'! ঠিক এমন সময় ছুটে আসা গুলিতে হানিফ শহীদ হন এবং ক্যাপ্টেন আমীনের পাশের মাটি উড়ে যায়। এদিকে শত্রু তাকে দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে সরতে যাওয়া মাত্রই তার ডান হাতের কনুই গুলিবিদ্ধ হলে, হাত থেকে স্টেনগান পড়ে যায়। ক্যাপ্টেন আমীন দেখলেন চতুর্দিকে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ। বিওপির বাংকারে যেসব মুক্তিযোদ্ধা ঢুকেছিলেন সবাই শহীদ হয়েছেন। গুরুতর আহতাবস্থায় ক্যাপ্টেন আমীন শালবনে ঢুকতেই কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সালাম এলএমজি নিয়ে বিওপির দিকে তেড়ে এসে 'ওরে তোরা আমার মা-বাপ সবাইকে মেরেছিস, আমি তোদেরকে ছেড়ে দেব?' চিৎকার করতে করতে বিওপির ভিতরে ঢুকে যায়।
বৃষ্টির মতো গোলাগুলিতে বিওপি তখন লাশে পূর্ণ। ফায়ার বেইসের মেশিনগান তখনো পিছুহটা মুক্তিযোদ্ধাদের কভার দিয়ে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন আমীন দেখলেন ১০ জনের মতো সেনা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মুক্তিবাহিনী কেউই নেই, এফইউপি শূন্য। পাকিস্তানি সৈন্যরা ৫০ গজের মধ্যে আসতেই তিনি একটি গর্তে আশ্রয় নিলেন।
এদিকে সবাই ভেবেছে ক্যাপ্টেন আমীন শহীদ। তাই তার লাশ উদ্ধারে মেজর আমিনুল হক এসেছেন। এসময় তারা ক্যাপ্টেন আমীনকে গর্তে দেখে তার পা ধরে টেনে নিতেই দেখলেন শত্রু ক্যাপ্টেন আমীনকে হত্যা করতে মাত্র ২৫ গজের মধ্যে এসে পড়েছে। লেফটেন্যান্ট মুদাচ্ছের চিৎকার করে সবাইকে সরে আসতে বলছেন কারণ তিনি শত্রুদের উপর গুলি চালালে কমান্ডারদের উপর গুলি লাগতে পারে। তারা চিৎকার শুনে সরে যেতেই দুই এলএমজিম্যান ফায়ার করে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর। মাত্র দশ গজ সামনে এলএমজির ব্রাশফায়ারে ৬ পাকিস্তানি সৈন্য মুহূর্তেই নিহত হয়, বাকি দুজন দৌড়ে পালিয়ে যায়। ঘড়িতে তখন সময় সকাল ৮টা ১০ মিনিট।
নকশী বিওপি যুদ্ধের ফলাফল
নকশী বিওপির যুদ্ধে মোট ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীসহ আহত হয়েছিলেন ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের দশ দিন পর দশ মুক্তিযোদ্ধার বিকৃত লাশ পাকিস্তানিরা ফেরত দিয়েছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পুরোপুরি সফল হতে না পারলেও এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর অন্যতম পরিকল্পিত এক যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর পুরোপুরি সফল না হওয়ার কারণ; স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও স্বল্প সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা। যাদের পূর্ব যুদ্ধ অভিজ্ঞতা ছিল না। এদিকে নকশী বিওপিতে সব মিলিয়ে এক কোম্পানি উচ্চ প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সৈন্য ছিল। আক্রমণের সামরিক নীতি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ২ কোম্পানি প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সেনা পর্যাপ্ত ছিল না। আর এর মধ্যে মাত্র ২২ জন ছিলেন প্রশিক্ষিত। তবে এই যুদ্ধ  মুক্তিবাহিনীর সব অধিনায়কদের মধ্যে নতুন এক বার্তা দিয়েছিল। 
তথ্য সূত্র- 
১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন/ মেজর জেনারেল (অবঃ) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected] 
 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh's forex reserves

Forex reserves fall by half a billion in a week

It hit $19.45 billion on March 27, down from $19.98 billion on March 20

1h ago