‘বাংলাদেশের গবেষণায় সেভাবে জায়গা পায়নি বাংলার পার্টিশন’

দেশভাগের প্রাথমিক অভিঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে কেউ ভাবেনি এই বিভাজন স্থায়ী হবে। তবুও তা হয়েছে। যুগপৎ ঘটেছে দেশভাগ ও স্বাধীনতার মতো দুটি ভয়ংকর ঘটনার। ১৮৫৭ থেকে শুরু, ১৯০৫, ১৯৪৭ হয়ে ১৯৭১। একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত হলেও মাঝখানে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্য। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল, ইতিহাস বলে প্রায় অসম্ভব ও পুরোপুরি অকল্পনীয়। কারণ বহু জাতির দেশ ভারতবর্ষের মানুষের জন্যে প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। তার জন্যই যত সংকট, ট্র্যাজেডির পার্টিশন।
মননকুমার মণ্ডল।

দেশভাগের প্রাথমিক অভিঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে কেউ ভাবেনি এই বিভাজন স্থায়ী হবে। তবুও তা হয়েছে। যুগপৎ ঘটেছে দেশভাগ ও স্বাধীনতার মতো দুটি ভয়ংকর ঘটনার। ১৮৫৭ থেকে শুরু, ১৯০৫, ১৯৪৭ হয়ে ১৯৭১। একটি অন্যটির সঙ্গে যুক্ত হলেও মাঝখানে রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহাকাব্য। ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্টে যে ঘটনাটা ঘটল, ইতিহাস বলে প্রায় অসম্ভব ও পুরোপুরি অকল্পনীয়। কারণ বহু জাতির দেশ ভারতবর্ষের মানুষের জন্যে প্রধান সমস্যাটা ছিল শ্রেণির। তার জন্যই যত সংকট, ট্র্যাজেডির পার্টিশন।

এই পার্টিশন নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন মননকুমার মণ্ডল। অধ্যাপনা করেছেন কলকাতার নেতাজি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে তিনি স্কুল অব হিউম্যানিটিসের অধিকর্তা। তার পরিকল্পনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভাষা, অনুবাদ ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র'র উদ্যোগে শুরু হয় বেঙ্গল পার্টিশন রিপোজিটরি (ডিজিটাল আর্কাইভ)। সেখানে রিফিউজি, বর্ডার, নাগরিকত্ব, স্মৃতি ও সাহিত্য—এসব বিষয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবনের ট্রমা এবং তথা ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালের স্মৃতি সংরক্ষিত হচ্ছে।

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেছেন অধ্যাপক মননকুমার মণ্ডল। পেয়েছেন জওহরলাল নেহেরু মেমোরিয়াল ফান্ড স্কলারশিপ, সাংহাই ওপেন ইউনিভার্সিটি ভিজিটিং ফেলোশিপ। বাংলায় তার প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থ 'আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য প্রসঙ্গে' (তিন খণ্ড), 'পার্টিশন সাহিত্য দেশ কাল স্মৃতি', 'বাংলার পার্টিশন কথা: উত্তর প্রজন্মের খোঁজ'। এ ছাড়া, প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৪০টির বেশি প্রবন্ধ। সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার

দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এখনো দেশভাগের ক্ষত এখনো শুকোয়নি। দুটি দেশ কী পেল, কী হারাল মনে করেন?

দেশভাগের ক্ষত আজ অতীত। দেশভাগ থেকেই উঠে এসেছে দুটি স্বাধীন দেশ—সে অনেক দুঃখ বেদনা, সংগ্রামের পথ। দুটি দেশই সেই সংগ্রাম, আত্মনির্ভরতার পথে অনেক এগিয়েছে, আজও এগোচ্ছে। অতীতের সেই বিভাজিত ইতিহাসের ক্ষত দুটি দেশের সম্পর্কের চলিষ্ণুতায় গুরুত্বপূর্ণ 'পারস্পেকটিভ' রচনা করেছে। কী পেলাম কিংবা কী হারালাম, সেই তালিকা আজ আর তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা একটা বাস্তবতা, একটা নতুন প্রজন্ম পার্টিশনের পরবর্তীতে উঠে এসেছে। তারা দুটি দেশ তথা দুই বাংলার বিভাজিত ও সংলগ্নতার বাস্তবতা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। ফলে 'দেশভাগের ক্ষত' কথাটার তাৎপর্য বদলে গেছে। তারা তো নতুন অনেক সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় পরিপ্রেক্ষিতে। আমি আজকের দিনে ঠিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানোর ছকে গোটা বিষয়টা দেখতে রাজি নই। একটা পরিকল্পের (প্যারাডাইম শিফট) বদল ঘটে গেছে দুই দেশের ভাবনায়, বাস্তবতায়। বাংলা ভাষার প্রকল্প সংহত জমি পেয়েছে—আরও অনেক দূর আমাদের একসঙ্গে যেতে হবে। আজ শুধু—আশার কথা ভাবতেই ভালো লাগছে।

অনেকে মনে করে মুসলিম লীগ-কংগ্রেস দ্বৈরথের ফলশ্রুতি পার্টিশন। জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বও বহুল আলোচিত। আপনার কী মনে হয়? পার্টিশন ঐতিহাসিক কোনো ভুল ছিল?

এ আমাদের উপমহাদেশের এক আশ্চর্য প্রশ্ন! এর অনেকগুলো সঠিক উত্তর আছে। অনেক কারণে, অনেক পরিস্থিতির উদ্ভবের ফলে শেষ পর্যন্ত পার্টিশনের মীমাংসা হয়েছিল। যখন হয়েছিল তখন কিন্তু প্রায় সব মেজর রাজনৈতিক দলের এ বিষয়ে ঐক্য হয়েছিল। এমন একটা সিদ্ধান্তের জন্যে কে দায়ী, কোন পক্ষ কতটা আত্মঘাতী পথে এগিয়েছিল, তা নিয়ে প্রায় ৫০ বছর গবেষকরা অসংখ্য গবেষণাপত্র লিখেছেন। ভারত-বাংলাদেশ শুধু নয়, সারাবিশ্বের দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশের ওপর চর্চার কেন্দ্রগুলোতে এই 'দেশভাগ/পার্টিশন' নিয়ে কাজ হয়েছে।

আমি বলছি, দায় অনুসন্ধান তার একটা বড় পর্যায়। এই দায় অনুসন্ধানের পথে পার্টিশনের ঐতিহাসিকতা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, এর সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর নেই। লীগ-কংগ্রেসের কথা বলছেন—ঠিক কথা; তারাই সে সময়ের দুটি পক্ষ, ব্রিটিশ মধ্যস্থতাকারী, দুই ধর্মের কট্টর সমর্থকরা, ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্র-মোসায়েবি গোষ্ঠীগুলো এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষ—এতগুলো দিকের এক জটিল তন্ত্রের মধ্যে ধরা আছে আমাদের পার্টিশনের ইতিহাস। এখানে ভুল-ঠিকের দৃষ্টি নিয়ে দেখাটা আজ এতদিন পরে আর যথেষ্ট বলে বলে হয় না—একরকম রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অবশ্যম্ভাবিতার পথে এগিয়েছিল দুই বাংলা।

এই প্রক্রিয়া রদের পক্ষে স্বর ছিল দুর্বল। কিন্তু, জনপরিসরে সেই স্বরের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তবুও তা রদ করা যায় নি। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট খণ্ডিত ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পতাকা উত্তোলন করেছিল। নেহেরুর সেই বিখ্যাত অভিভাষণ '… and now the time comes when we shall redeem our pledge, not wholly or in full measure, but very substantially. At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom.' উপনিবেশের শৃঙ্খলমুক্তির যে চেতনা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে, তা অস্বীকার করে পার্টিশন প্ল্যানের প্রস্তাব বিচার করা ঠিক হবে না। যেমনটা ১৯৭১ এর বাংলাদেশ রাষ্ট্র উদ্ভবের ক্ষেত্রেও মনে রাখা দরকার। জাতির মুক্তির সংগ্রামের তাৎপর্য অমলিন।

কিন্তু, এখনো দুই দেশের মধ্যে রয়েছে সীমানা বিরোধ ও পারস্পরিক অবিশ্বাস৷ দেশভাগের ফলাফল তাহলে কোন দিকে?

এভাবে আমি ভাবতে চাই না। দুই দেশের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক, সর্বোপরি প্রতিবেশীর মধ্যে যে সম্পর্ক, সেখানে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা যথেষ্টই রয়েছে। বস্তুগতভাবে পারস্পরিক নির্ভরতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাপেক্ষতা আছে। সেটাই বড় করে দেখা উচিত। সীমান্ত থাকলেই বিরোধ থাকে, রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বী মানুষের আগ্রাসনের মনোভাব থাকে—বিশেষত যেখানে এমন বিভাজনের ইতিহাস আছে। কিন্তু, সেসব রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত কি না, সেটাই বড় কথা। কোনো ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে—বিশেষত নাগরিকত্বের ইস্যুতে। কিন্তু, দুই দেশের পারস্পরিক সাপেক্ষতার চর্চা সেসব থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্র ইতিহাসকে উপেক্ষা করে অমানবিক হয়ে উঠবে না—এমনটা আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে। সেখানেই জোর দিতে হবে।

না ধর্মে, না ভাষায়— কোনোটাই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং যন্ত্রণা, দাঙ্গা এবং শারীরিক ও মানসিক কষ্ট রয়ে গেছেই। তা নিয়ে কী বলবেন?

আমার তা মনে হয় না। দেশভাগকে দেশ-কাল-সমাজ-রাজনীতি থেকে আলাদা করে ভাবাবেগ দিয়ে দেখলে চলবে না। আজকের প্রজন্ম আত্মঘাতী দাঙ্গার প্রজন্ম নয়। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে আমরা বাংলাভাষীরা অনেক এগিয়েছি; বরং ভারতবর্ষেই অন্যান্য ভারতীয় ভাষাগুলোর মতো বাংলাভাষীদের ওপর আগ্রাসনের চাপ নতুন মাত্রা নিয়েছে। আর ধর্মে বিভাজিত তো আমরা ছিলাম, অখণ্ড বাংলাতেও ছিলাম। না হলে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পঞ্চাশ বছরের রাজনীতিতে এমন মাত্রা পরিবর্তন হবে কেন?

মোটা দাগে সে তো একরকম ধর্মের পরিচিতি নিয়েই হয়েছে। কিন্তু দেখুন, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতির বিভিন্ন স্তর থাকলেও হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানের সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্যকে আমরা লঘু করে ফেলি মাঝেমধ্যে। ভিন্ন সাংস্কৃতিক জীবন চর্চা নিয়ে, বিবিধ দ্বান্দ্বিক পরিসরেও সেই ঐতিহ্য অমলিন। একে গুরুত্ব দিতেই হবে। ভাষিক পরিচিতির নিরিখ সেখানে বড় ঠিকই। কিন্তু, সম্প্রীতিময় সংলগ্ন হয়ে থাকা জীবনের ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। দ্বন্দ্ব-সংক্ষুব্ধ-টানাপোড়েনের মধ্যেও তারা একসঙ্গে ছিল। রাষ্ট্র আলাদা করার প্রয়োজন ছিল না! ব্যবস্থা আলাদা হতে পারত—এটাও একটা মত ছিল। যদিও আজ এসব আলোচনার তেমন গুরুত্ব নেই বলেই মনে করি।

রাজনৈতিক নেতারা পার্টিশন উন্মাদনার মধ্যে কি সাধারণ মানুষের কথা ভেবেছিল? না হলে কাদের স্বার্থে পার্টিশন হয়েছে?

দেখুন রাজনীতি মানুষ ছাড়া হয় না। অন্তত কিছু অংশের সাধারণ মানুষ সঙ্গে না থাকলে একজন নেতা হতে পারেন না। দেশভাগের সময়কালে তৎকালীন নেতাদের ভূমিকা পর্যালোচনার মধ্যে আর কিছু পড়ে নেই। অনির্ণেয় থেকেছে বিচার। বড় কথা হলো এই যে, সাধারণ মানুষ এমন বিভাজন মানেননি, এমন সীমান্ত তাদের জীবন থামিয়ে দিতে পারেনি—এর অনেক উদাহরণ আছে। সে সময় অনেকেই ভাবেননি যে এই বিভাজন চিরস্থায়ী হবে। কিন্তু, তা হয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। উদ্বাস্তু-সংকট তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে—তাদের নতুন জীবন পুনর্গঠনের সংগ্রাম এক উজ্জ্বল ইতিহাস রচিত হয়েছে। এমনটা পৃথিবীতে কমই হয়েছে।

আবার সুবিধাভোগী সম্পন্ন হিন্দু-মুসলমান পরিবার পার্টিশন থেকে লাভবানও হয়েছে। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা লাভবান হয়েছে, সে কথাও তো ঠিক। কিন্তু, বিষয়টা কোনো একশ্রেণির বা রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থে হয়েছে, এমনটা বলা ঠিক হবে না। উপনিবেশের শৃঙ্খলমুক্তির পথে সেটা এক জটিল অন্তর্বর্তীকালীন আবর্ত—যা পরবর্তীতে স্থায়ী হয়ে গেছে। যদিও মনে রাখতে হবে 'কাশ্মীর সমস্যার' মতো অলঙ্ঘনীয় অনির্ণেয় সমস্যা দুই বাংলার বিভাজনে নেই; এখানে সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে সূক্ষ্ম ও দীর্ঘস্থায়ী, জটিল। ট্রমার আকস্মিকতা থেকে তার প্রভাব কোনো অংশে কম নয়।

ধর্মীয় বিরোধকে জাতিগত বিরোধের পথে এগিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান৷ ১৯৪৭ সালে যে তত্ত্বের অবতারণা, তারই ফল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ, জন্ম হয় বাংলাদেশের। এই ভাগগুলো সাহিত্য-সাংস্কৃতিকভাবে কতটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে বলে মনে করেন?

এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বাংলার পার্টিশনের সাহিত্যিক প্রতিক্রিয়া অভিঘাত সেভাবে গবেষণার ক্ষেত্রে জায়গা পায়নি। অথচ পাঞ্জাবের পার্টিশনে পেয়েছে। এখানে সমাজতাত্ত্বিকেরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যক্তিক লেখালিখি, গল্প, উপন্যাস সেভাবে আলোচনার মধ্যে আনেননি। অথচ দেখুন ১৯৪৭ এর পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তান শাসনামলের পর জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভবের নেপথ্যে যে বাংলার ভাষিক পরিচিতিসত্তা, তা কিন্তু ধর্মীয় বিরোধকে অতিক্রম করে গেছে। আবার ধর্মীয় পরিচিতিকে রাষ্ট্রীয় পরিসরে পাকিস্তান যেভাবে জায়গা দিয়েছে, পূর্ববঙ্গের মানুষ সেভাবে দিতে চায়নি। সমষ্টিমানসের এই জটিল প্রতিভাস সবচেয়ে ভালো ফুটে উঠেছে আমাদের বাংলা সাহিত্যে, সাধারণের লেখালিখির মধ্যে। আমি নির্দিষ্টভাবে লেখকদের নামোল্লেখ করছি না।

আমাদের পার্টিশন চর্চার ইউরোপকেন্দ্রিকতা, বিদ্যায়তনিক বৃত্তের ঘেরাটোপ এই জটিলতাকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলার সাহিত্য, ব্যক্তিগত লেখালিখির সঙ্গে পরিচয়হীনতা এর অন্যতম কারণ। একাত্তর পরবর্তীতে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রিক পরিচয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম যেভাবে উচ্চকিত হয়েছে, সেভাবে ৪৭ এর পার্টিশন আলোচনায় আসেনি। অবশ্য এর অনেক কারণ রয়েছে। যাই হোক, বাঙালির জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়ে বিভিন্নতার ছায়া-প্রচ্ছায়া, বাংলার সাংস্কৃতিক পরিসরে উভয়ে সহাবস্থানের ঐতিহ্য ইত্যাদির সবচেয়ে উৎকর্ষ দর্পণ বাংলার সাহিত্য। সেখানে নজর দিতেই হবে; কারণ বাংলার পার্টিশনের অভিঘাত অনেক জটিল ও প্রলম্বিত, নিয়ত জায়মান এক সাংস্কৃতিক জট—যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ কোথাও নয়।

বাঙালির পরিচয় ফিরে পাওয়ার এক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই মানুষটার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে ১৫ আগস্ট। পশ্চিমবঙ্গ তার কীর্তি ও বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে দেখে?

১৫ আগস্ট এক আশ্চর্য বিপ্রতীপ তাৎপর্য। কিন্তু, এতে তার অবিস্মরণীয় নেতৃত্ব বিস্মৃত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বাংলাদেশ উদ্ভবের নেপথ্যে যে গণ-আন্দোলন ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার ক্রমপরম্পরা, তার সামনের সারির উজ্জ্বল নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধু। তিনিও এই কলকাতা, ঢাকা, দুই বাংলার গ্রাম শহর থেকেই জটিল রাজনৈতিক আবর্তের ক্লেদ পঙ্কিলতার মধ্যে থেকেই উঠে এসে সাধারণের মনে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন—এটা ভাবতেই অবাক লাগে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যে মানসিক সংগ্রামে নিয়োজিত ছিল, শেখ মুজিব তার অনন্য একনায়ক। হিন্দু-মুসলমান বাঙালির সেকুলার চিন্তার প্রতীক তিনি।

পশ্চিমবঙ্গে আগ্রাসনের মুখে পড়া উদ্বাস্তু বাঙালির মনে তার স্থান চিরকালীন—কেননা তাদের নিজের জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার প্রতীক বঙ্গবন্ধু। একজন বাঙালি জননেতা যিনি সোহরাওয়ার্দী নেতৃত্ব, ভাসানীর নেতৃত্বের মধ্যে কাজ করেও নিজের স্বাধীন দেশপ্রেমী, গণতান্ত্রিক চেতনাকে সাধারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে স্বল্পসময়ের স্বাধীন বাংলাদেশকে সারাবিশ্বের দরবারে পরিচিতি সূচিত করেছিলেন তাকে বিস্মৃত হওয়া অসম্ভব। তার ছয় দফা দাবির আন্দোলন, অন্তরীণ পর্ব, ৭ মার্চের অভিভাষণ বাঙালি চেতনাকে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যেন মনে হয় নির্মোহ দৃষ্টি নিয়ে তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়তো বাংলাদেশের বাইরে থেকেই সম্ভব। ভারতরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের যে সূত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময়পর্বে বাঁধা হয়েছিল, তা আজও বহমান—খুব বেশি তার বাইরে কোনো দেশই যায়নি। ইন্দিরা-মুজিব সম্পর্ক বাঙালির কাছে এক অর্থে স্বপ্নের উদযাপন—পারস্পরিক বন্ধনের নেপথ্যে এক চালচিত্র প্রস্তুত করে রেখেছেন।

আপনার পঠনের অভিজ্ঞতা, দীর্ঘ গবেষণা থেকে যদি বলেন, দেশভাগে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ কী ভূমিকা রেখেছিল? প্রান্তজনের কথা কতটা কেন্দ্রে এসেছে বা তুলে এনেছেন গবেষকরা?

মোটের ওপর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষ। খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের জীবন। নিম্নবর্গীয় নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমান যাদের দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছিল। সেসময় বুদ্ধিবৃত্তির সমাজ অনেক ভালো ভালো কথা বলেছিল বটে। কিন্তু, রাজনৈতিক পরিসরে সেসব কথার বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা ও দেশভাগের জোরালো বিরোধিতা একটা পর্যায়ের পর খুব কাজে আসেনি। এসব নিয়ে সংক্ষেপে বলা যায় না।

বিভাজনের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের আগমন ও নির্গমন তৈরি করে শরণার্থী সংকট। নতুন গবেষকদের কাজে কি সেটা গুরুত্ব পাচ্ছে?

পার্টিশন গবেষণায় প্রান্তজনের অবস্থানের প্রতি নজর পড়েছে দেরিতে। এমনকি নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হতে শুরু করেছে নয়ের দশকের আশেপাশে (উর্বশী বুটালিয়া, কমলা ভাসিন, জয়ন্তী বসু)। জাতপাত ও নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনে যে অভিঘাত, তা আরও পরে (শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র)। এখানে একটা সমস্যা আছে? কোন মানুষকে আপনি প্রান্তজন বলবেন? এমন হলোকাস্টে সব আক্রান্ত মানুষই এক অর্থে প্রান্তজন। কিন্তু, সেই প্রজন্ম শেষ হওয়ার পরেও যখন স্মৃতিচর্চার মধ্যে পার্টিশন-ট্রমা আলোচিত হয়, তখন আমরা সামাজিকভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবনে সেই অভিঘাতকে ধরার চেষ্টা করি। এখন সেটা শুরু হয়েছে। প্রান্তিক মানুষদের লেখালিখি, দৈনন্দিনতার মধ্যে সেই অভিঘাতের একটা ভিন্ন মাত্রা ধরা পড়ে।

নতুন প্রজন্মের গবেষকরা নতুন নতুন কাজ করছেন। পাঞ্জাব ও বাংলার পার্টিশন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার কাজ হচ্ছে। ইয়াসমিন খান, ভাজিরা ফায়জালা, অনন্যা জাহানারা কবীর, পিপ্পা ভারদি, জয়ন্তী বসু, গার্গী চক্রবর্তী, মণিকা মণ্ডল, পৌলমী চক্রবর্তী, আনম জাকারিয়া, হৈমন্তী রায়—এদের গবেষণায় নতুন নতুন প্রশ্ন তুলে ধরার প্রচেষ্টা থাকছে। তারা জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী ভট্টাচার্য, সুগত বসু, আয়েশা জালাল, আশীষ নন্দী, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়া চ্যাটার্জি, অলোক ভাল্লা প্রমুখদের কাজ থেকে উপাদান নিয়ে এগিয়েছেন। অল্প বিস্তর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তিও করেছেন। নবীন প্রজন্মের কাজে কিন্তু 'পিপলস ভিউ' অনেকটা জায়গা পেয়েছে। কিন্তু, এগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে সমাজতত্ত্বের বিদ্যায়তনিক আবর্ত—মেথোডলজি অনেক সময় অস্পষ্ট করেছে মূল কথাকে। বাংলার ব্যক্তিক লেখালিখির পরিসর সেভাবে আসেনি—এলেও খুব সংক্ষিপ্ত সেই পরিসর। প্রান্তজন পর্যন্ত পৌঁছায়নি এসব বিদ্যায়তনিক প্রচেষ্টা।

আপনার উদ্যোগে শুরু হয়েছে বাংলার পার্টিশন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে 'ডিজিটাল আর্কাইভ'। কিছু কাজও করেছেন বাংলাদেশে। কোন দিকটা বিশেষভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে বা পাবে?

আমরা নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ইউজিসির সাহায্য নিয়ে একটি জনগবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করেছিলাম ২০১৫-১৬ সালে। সেটাই আজও চলছে। এই প্রকল্পে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন প্রয়াত দেবেশ রায়, সেলিনা হোসেন, হাসান আজিজুল হক, অমর মিত্র, সাধন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ দুই বাংলার বিশিষ্ট লেখকরা। এই প্রকল্পটি কাজ করছে বাংলার পার্টিশনের মানবিক অভিঘাত নিয়ে—প্রান্তিক মানুষের স্বর তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা বোঝার চেষ্টা করছে। মূলত জেলা, মফস্বল ও শহরের প্রান্তিক মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতি, লেখালিখি, স্মারক ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পরিষদ।

আমরা ১৯০৫, ১৯৪৭ ও ১৯৭১ এই তিনটি ঐতিহাসিক কালপর্বকে একটা কন্টিনিউটিতে দেখতে পারি। সাধারণ ও প্রান্তিক বাংলাভাষী মানুষের জীবনের ছবিতে এই বিভাজন পরিকল্পনা ও তার অভিঘাত আজও জায়মান। বিভাজন স্মৃতির 'রেফারেন্স' বাঙালির জাতিসত্তার অঙ্গীভূত হয়ে গেছে। যে সম্প্রীতি সহবস্থানের ঐতিহ্যের কথা বলছিলাম, তা এই বিভাজনের বিপ্রতীপে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার সমাজের মানুষী প্রতিক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরগুলো চর্চিত হওয়া খুব প্রয়োজন। সাময়িক পত্র-পত্রিকা, লিফলেট, প্যাম্ফলেটে, ডায়েরি, ফটোগ্রাফ, ব্যক্তিগত স্মারক ইত্যাদিত যত্নশীল সংরক্ষণ ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতির গল্প এই চর্চাকে নিবিড় করে তুলবে। বাংলাদেশে উদ্ভাসিত মুসলমান পরিবার, ছোট ছোট আঞ্চলিক সমষ্টি-উদ্যোগের দলিল, কাগজপত্র আমরা সংগ্রহ করছি। এদিকে বেশি নজর পড়েনি। প্রধানত হিন্দু-উদ্বাস্তুদের দেশত্যাগের কথামালায় ঘেরা আছে আমাদের পার্টিশন চর্চা। বাংলাদেশে ১৯৪৭ এর অভিঘাত কিন্তু ৭১-এর অর্জনকে বোঝার জন্যও জরুরি। এই নিয়ে ডিজিটাল আর্কাইভের প্রচেষ্টা নিয়েছি আমরা। মূলত নতুন প্রজন্মের গবেষকদের কাছে এগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।

আপনাদের জনগবেষণা প্রকল্পের সম্পাদিত নতুন বই 'বাংলার পার্টিশন কথা: উত্তর প্রজন্মের খোঁজ' বাংলার পার্টিশন চর্চা ও গবেষণায় নবতম সংযোজন। কোনদিক থেকে এটি ব্যতিক্রমী, সে বিষয়ে যদি কিছু বলেন।

জনগবেষণা প্রকল্পটির কাজের একটি অংশ আমার এই তিন খণ্ডে পরিকল্পিত গ্রন্থগুলো। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। দ্বিতীয় খণ্ড শিগগিরই প্রকাশিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অনেক সাধারণ মানুষের জীবনভাষ্য এখানে ধরা থাকছে, রয়েছে সীমান্তের বিভিন্ন অংশে সমীক্ষামূলক কাজ, ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক প্রতিমান ইত্যাদি। নিম্নবিত্ত, সাধারণ, জেলা-মফঃস্বলের সাধারণ মানুষের স্মৃতিকথা ও জীবনভাষ্য বাংলার পার্টিশন চর্চায় একটু নতুন। খুব বেশি সেই প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি। আর আমরা মূলত সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাদের, যারা লিখতে পারেন না অথবা জীবনের কথা লেখার কথা ভাবেননি। ১৯৭১ এর উদ্বাসনের স্মৃতিও আছে। কীভাবে সেই সংগ্রামের দিনগুলোতে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু মানুষের মানসিক সহমর্মিতা লাভ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের বাহিনী, সেসব কথা আজও কান পাতলে সীমান্ত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে শোনা যায়। নগর কলকাতা ও ঢাকার বাইরে মাইগ্রেশনের ব্যক্তিক স্মৃতির ওপরই আলো ফেলতে চাওয়া হয়েছে।

জেলা সদরগুলোর জনসংগঠনের পরিবর্তন, সীমান্তের মানুষের পেশাগত পরিচয় কীভাবে বদলে যাচ্ছে, পরবর্তী প্রজন্ম এই উদ্বাস্তু পরিচিতি থেকে বেরিয়ে কীভাবে দুই বাংলাকে দেখছে তার অভিজ্ঞতায়—এসব খোঁজই এই কাজের লক্ষ্য। বাংলার পার্টিশন স্মৃতি নিয়ে এত বড় পরিসরে কাজ আগে চোখে পড়েনি। প্রায় ৫০ জন সমীক্ষক এই প্রকল্পে জড়িত আছেন। শুধু বাংলার পার্টিশন অভিজ্ঞতার পরিসরে দুই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোগে বাংলায় এমন কাজ আগে চোখে পড়ে না। তবে, এই কাজ কঠিন, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সেসব মানুষের সংস্পর্শে আসা কঠিন। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিচ্ছি আমরা।

Comments

The Daily Star  | English

Sajek accident: Death toll rises to 9

The death toll in the truck accident in Rangamati's Sajek increased to nine tonight

6h ago