ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহ দিবস আজ

আজ ১৮ আগস্ট ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহ দিবস। ১৯৪৯ সালে যে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বিলুপ্ত হয়েছিল এক বর্বর প্রথার এবং একই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছিল জমিদারী প্রথাও।
নানকার বিদ্রোহে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: সংগৃহীত

আজ ১৮ আগস্ট ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহ দিবস। ১৯৪৯ সালে যে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বিলুপ্ত হয়েছিল এক বর্বর প্রথার এবং একই সঙ্গে বিলুপ্ত হয়েছিল জমিদারী প্রথাও।
নানকার প্রথা কী
নানকার ছিল এক বর্বর শ্রম শোষণের প্রথা। অনেকটা মধ্যযুগীয় দাস প্রথার মতো। নানকার অর্থ রুটির বিনিয়মে যে লোক রাখা হয়। তারা জমিদারের সব ধরনের ফরমায়েশ খাটতো, মজুরি থেকে শুরু করে সব ধরনের কায়িক পরিশ্রম করতো কেবল খাবারের বিনিময়ে। আর সঙ্গে জমিদারদের কাছ থেকে জমির ভোগস্বত্ব পেত। মূলত দু'চার বিঘা তারা চাষ বাস করার বরাদ্দ পেত।
নানকার উৎপত্তি মোঘল আমলে হলেও দিনে দিনে তা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সিলেটের বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ অঞ্চলে এই সামন্ত প্রথা চালু ছিল। তবে এই অঞ্চলে তা আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল। কারণ নানকারদের খাওয়ার দায়িত্ব জমিদার বহন করার চল থাকলেও এই প্রথার ব্যবস্থা অনুযায়ী জমিদারকে তা হাতে তুলে দিতে হতো না। নানকারদের দুই ধরনের জমি বরাদ্দ দেয়া হতো। এগুলোকে যথাক্রমে নান (রুটি) আরেকটি খানে (খাবার জন্য) বাড়িও বলা হতো।
নানকার বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী বিপ্লবী কমরেড অজয় ভট্টাচার্য তার 'নানকার বিদ্রোহ' গ্রন্থে লিখেছিলেন, 'জমি থাকলেই খোরাকি পাওয়া যায় এটা হলো সামন্তবাদী যুগের বিশ্বাস। তাই জমিই হলো মূল্যবান। কিন্তু খোরাকি উৎপাদনে যে শ্রমশক্তির ব্যয় হয় সামন্তবাদী হিসেবে তা মূল্যহীন।... নানকাররা যে জমিজমা চাষাবাদ করতেন তা জমিদারের খাস দখলি এলাকা বলে পরিগণিত হতো। জমিদার তার মর্জিমাফিক এই জমি বিলি- বন্দোবস্ত করতে ও যখন তখন তা হাতবদল করতে পারত, নানকার- প্রজাকে উচ্ছেদও করতে পারত। কোনো আইন-আদালত তার বিরুদ্ধে কিছু বলার অধিকারী ছিল না। তাই জমিদারের মর্জি যুগিয়ে চলাই ছিল নানকার-প্রজার স্বগৃহে টিকে থাকবার একমাত্র শর্ত।'
নিকৃষ্ট এক প্রথা 'নানকার'
সামন্ত ভূ-মালিকদের সিলেট অঞ্চলে মিরাশদার এবং বড় মিরাশদারকে জমিদার বলা হতো। জমিদার বা মিরাশদারবাড়ির কাছে কিছু জায়গায় কিছু প্রজার বসবাসের ব্যবস্থা করা হতো, তারাই ছিলেন নানকার প্রজা।
কারণ জমিদারদের যে কোনো প্রয়োজনে তারা সশরীরে উপস্থিত থাকতে বাধ্য। জমিদারবাড়ির সার্বক্ষণিক গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত থাকতে হতো তাদের। এমনকি গভীর রাতেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জমিদারবাড়ির ডাকে দ্রুত সাড়া না দিলে নেমে আসত অসহনীয় নির্যাতন। এই পরিশ্রমের জন্য কোনো প্রাপ্য জুটতো না। বিনা পয়সার এই পরিশ্রমকে বলা হতো হদ বা বেগারি। নানকার প্রজারা জমিদারের দেয়া বাড়ি ও সামান্য কৃষি জমি চাষবাস করতেন। কিন্তু ওই জমি বা বাড়ির উপর তাদের মালিকানা ছিল না। তারা বিনা মজুরিতে জমিদার বাড়িতে বেগার খাটতেন। একদিকে যেমন ছিলো অস্থায়ী বন্দোবস্ত ঠিক তেমনই সেই জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও প্রজারা স্বাধীন ছিল না। এই জমি বিক্রি বন্ধক তো দূরের কথা স্থায়ী ফল ফসলের কেউ যদি বাগানও করতো তা ভোগ করারও অধিকার তাদের ছিল না।
এই নানকার প্রজারা ছিলেন মূলত ভূমির মালিকের হুকুমদাস; প্রজাই নয় তাদের স্ত্রী-সন্তানরাও বংশানুক্রমে ভূমি মালিকের দাস হতেন। বৃহত্তর সিলেটের ৩০ লাখ জনসংখ্যার ১০ ভাগ ছিল নানকার। ১৯২২ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সহযোগিতায় বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, কুলাউড়া, বালাগঞ্জ, ধর্মপাশা থানায় দানা বাঁধতে থাকলো নানকার আন্দোলন। ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহের সুতিকাগার ছিল বিয়ানীবাজার। সামন্তবাদী শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিয়ানীবাজার অঞ্চলের নানকার কৃষকরা সর্বপ্রথম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
লাউতা বাহাদুরপুর জমিদার বাড়ির সামনে রাস্তায় স্যান্ডেল বা জুতা পায়ে হাঁটা যেত না। ছাতা টাঙ্গিয়ে চলা ও ঘোড়ায় চড়াও ছিল ভয়ংকর অপরাধ। যদি কেউ ভুল করেও অমান্য করতো তবে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো। জমিদারদের এই অসহনীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও তার শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার সাহস কারোরই ছিল না। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেও কেউ জমিদারদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পেতো না।
যেভাবে গড়ে উঠে নানকার বিদ্রোহ
দিনে দিনে জমিদারদের অত্যাচার বাড়তে থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে মানুষের মনের ক্ষোভ, এই অনাচারের প্রতিকার চায় সবাই। তাই গোপনে গোপনে চলে শলাপরামর্শ। কেউ কেউ আবার সাহস সঞ্চার করে এ সময় নানকার ও কৃষকদের সংগঠিত করতে কষক সমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় হয়।
কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে চলতে থাকে নানকার কৃষকসহ সকল নির্যাতিত জনগণকে সংগঠিত করার কাজ। ১৯৪৭-এর আগেই অজয় ভট্টাচার্য আত্মনিয়োগ করেন নানকার প্রজাদের সংগঠিত করতে এবং একাধিকবার গ্রেপ্তার হন ব্রিটিশ ভারতের নিরাপত্তা আইনে। দেশ ভাগের আগে ও পরে দুই ভাগে সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক নানকার বিদ্রোহ, যার অন্যতম রূপকার হলেন কমরেড অজয় ভট্টাচার্য। নিপীড়িত মানুষকে সংগঠিত করতে সে সময় অজয় ভট্টাচার্যের সঙ্গে কাজ করেছিলেন শিশির ভট্টাচার্য, ললিতপাল, জোয়াদ উল্লাহ, আব্দুস সোবহান, ও শৈলেন্দ্র ভট্টাচার্যসহ বহু বিপ্লবী মানুষ। তাদের নেতৃত্বে নানকার কৃষক ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করে জমিদারের বিরুদ্ধে। বন্ধ হয়ে যায় খাজনা দেওয়া এমনকি জমিদারদের হাট-বাজারের কেনাকাটা পর্যন্ত।
বিভিন্ন জায়গায় জমিদার ও তার লোকজনকে ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে ভীত সন্ত্রস্থ জমিদাররা তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের শরণাপন্ন হয়ে এ অঞ্চলের নানকার কৃষকদেরকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করে। জমিদারদের প্ররোচনায় পাকিস্তান সরকার বিদ্রোহ দমনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বিদ্রোহের দিন 
১৮ আগস্ট ছিল পহেলা ভাদ্র। এদিন ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথে পেটোয়া বাহিনী আক্রমণ করে সানেশ্বরে ঘুমন্ত মানুষ ভীতসন্তস্ত্র হয়ে ঘুম ভেঙ্গে দিকবিদিক পালাতে থাকেন। সানেশ্বর গ্রামের লোকজন পালিয়ে পার্শ্ববর্তী উলুউরিতে আশ্রয় নেয়। উলুউরি গ্রামে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন নানকার আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল ও সুরথ পাল।
তাদের নেতৃত্বেই উলুউরিও সানেশ্বর গ্রামের কৃষক, নারী-পুরুষ সরকারী বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়াবার প্রস্তুতি নেয় এবং লাটিসোটা, ঝাটা এসব নিয়ে সানেশ্বর ও উলুউরি গ্রামের মধ্যবর্ত্তী সুনাই নদীর তীরে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয় সরকারি ও জমিদার বাহিনীর সাথে। কিন্তু ইপিআরের অস্ত্রের সামনে লাটিসোটা নিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি কৃষকরা। ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছিলেন ব্রজনাথ দাস, কুটুমনি দাস, প্রসন্ন কুমার দাস, পবিত্র কুমার দাস ও অমূল্য কুমার দাস। এই আন্দোলনের শহীদ হয়েছিলেন ৬ জন। রজনী দাস ১৫ দিন আগে নদীর তীরে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন।

অন্যদিকে অমূল্য কুমার দাস পরবর্তী সময়ে বন্দী অবস্থায় শহীদ হয়েছিলেন। পুলিশের অত্যাচারে নানকার বিদ্রোহে সেদিন আহত হয়েছিলেন হৃদয় রঞ্জন দাস, দীননাথ দাস, অদ্বৈত চরণ দাসসহ বহু বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতাকর্মী। বন্দি হন এই আন্দোলনের নেত্রী অপর্ণা পাল, সুষমা দে, অসিতা পাল ও উলুউরি গ্রামের প্রকাশ চন্দ্র দাস, হিরণ বালা দাস, প্রিয়মণি দাস, প্রমোদ চন্দ্র দাস ও মনা চন্দ্র দাসসহ অনেকে। বিদ্রোহের নেত্রী অন্তঃসত্ত্বা অপর্না পালচৌধুরীর গর্ভপাত ঘটে ঘটনাস্থলেই। অত্যাচারে তিনি পঙ্গু হয়ে যান। শ্রীহট্ট, রাজশাহী ও ঢাকা জেলে তিনি ৫ বছর বন্দি ছিলেন তিনি।
এ ঘটনার পরেই আন্দোলনে উত্তাল হয় সারাদেশ। তাদের এই আত্মত্যাগের ফলেই ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি ব্যবস্থা বাতিল ও নানকার প্রথা রদ করে কৃষকদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
সূত্র- নানকার বিদ্রোহ/ অজয় ভট্টাচার্য
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Freedom declines, prosperity rises in Bangladesh

Bangladesh’s ranking of 141 out of 164 on the Freedom Index places it within the "mostly unfree" category

1h ago