সাংবাদিক হত্যা: দায়মুক্তির সুযোগে ন্যায় বিচার যেন মরীচিকা

কেউ এক দশক আগে, কেউ আবার ২০০০ সালের শুরুর দিকে বা তারও আগে খুন হয়েছেন। তবে, তাদের মধ্যে অসাধারণ মিল আছে। আর তা হলো দায়মুক্তির কারণে কেউ এখনো ন্যায় বিচার পাননি। তাদের সবাই দায়িত্ব পালনের জন্য নিহত সাংবাদিক।
স্টার গ্রাফিক্স

কেউ এক দশক আগে, কেউ আবার ২০০০ সালের শুরুর দিকে বা তারও আগে খুন হয়েছেন। তবে, তাদের মধ্যে অসাধারণ মিল আছে। আর তা হলো দায়মুক্তির কারণে কেউ এখনো ন্যায় বিচার পাননি। তাদের সবাই দায়িত্ব পালনের জন্য নিহত সাংবাদিক।

গত আড়াই দশকে অন্তত ১৩ জন সাংবাদিক হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো দৃশ্যত কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে।

তাদের সবার গল্পই এক। বিচারিক প্রক্রিয়া একটি গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে তদন্ত কখনো শেষ হয় না এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করা যায় না। সব মিলিয়ে তারা সম্পূর্ণ দায়মুক্তি পান।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যরা শুধু বিচারপ্রার্থী। কিন্তু কোনো বিচার না পেয়ে তাদের শুধু হতাশই হতে হয়।

দৈনিক জনকণ্ঠের সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক শামসুর রহমানের ভাই বকুল হতাশা প্রকাশ করে বলেন, 'আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, 'সরকার ন্যায়বিচারের কথা চিন্তা করে না।'

২০০০ সালে যশোরে শামসুর রহমানের অফিসে দুজন অস্ত্রধারী প্রবেশ করে তাকে গুলি করে হত্যা করে। খুলনার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পরিচালনা করলেও গত ২১ বছরেও এ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।

বকুল বলেন, 'মামলাটির বিচার এখনো শুরু হয়নি। কারণ একজন অভিযুক্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছে।'

বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর সহিংসতা ও হত্যার জন্য দায়মুক্তির সংস্কৃতি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকারের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশে অন্তত ২৩ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন।

সেগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকটি মামলার রায় হয়েছে।

এমন একটি পরিস্থিতিতে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি অবসানে আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয় মঙ্গলবার।

এ উপলক্ষে এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, 'সাংবাদিক হত্যার দায়মুক্তি অত্যন্ত বেশি। ইউনেস্কোর মতে, ১০টি মামলার মধ্যে প্রায় ৯টিতেই কেউ শাস্তি পায়নি।'

রিপোর্টিং এবং জনসাধারণের কাছে তথ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য ২০০৬ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ১ হাজার ২০০ জনেরও বেশি সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়মুক্তির অবসান হলো সব নাগরিকের জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মধ্যে একটি।'

অগ্রগতি নেই অনেক মামলার

দেশে নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড অনেক বেশি আলোচিত।

২০১২ সালের এই হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেন।

৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এই দম্পতির পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার এখনো অধরাই রয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কমপক্ষে ৮২ বার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারা চাঞ্চল্যকর এই মামলায় কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি।

বেসরকারি মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া বাড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

সবশেষ অগ্রগতিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ আবারও র‌্যাবকে ২৪ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন।

ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে, দক্ষিণ এশিয়ার আর্টিকেল-১৯-এর আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল মামলাটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

সাগর এবং রুনি আলোচিত নাম হয়ে উঠলেও, কেউ কেউ হয়তো জানেন যে দীপঙ্কর চক্রবর্তীও একই পরিণতি ভোগ করেছিলেন।

বগুড়াভিত্তিক 'দৈনিক দুর্জয় বাংলার' সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতিকে ২০০৪ সালের ৩ অক্টোবর কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

কমপক্ষে ৯ জন তদন্ত কর্মকর্তা মামলাটি নিয়ে কাজ করেছেন এবং পুলিশ কমপক্ষে ৪ বার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করে পরিবার তাদের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন।

গত মাসে, দীপঙ্করের ছেলে অনিরুদ্ধ তার বাবার স্মরণে আয়োজিত একটি স্মৃতিচারণে বলেছিলেন যে, হলি আর্টিজান হামলা মামলার একজন আসামি এবং আরও চার জন নিহত ব্যক্তিকে তার বাবার হত্যাকারী হিসাবে উল্লেখ করে নাম দেওয়া হয়েছিল।

শ্রীমঙ্গলের সৈয়দ ফারুক আহমেদও মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।

শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সভাপতি বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারের সিলেট প্রতিনিধিকে বলেন, 'পুলিশ হত্যা মামলা করেছে এবং তারা কখনোই সেটার আর দেখভাল করেনি।'

'পূবালী বার্তার' সম্পাদককে ২০০২ সালের ৩ আগস্ট হত্যা করা হয়। পুলিশ তার বিকৃত ও খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে।

রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, তার মরদেহটি রেললাইনে পাওয়া যায়। তার আগে ২ মাস ধরে নিখোঁজ ছিলেন তিনি।

নীলফামারীতে 'নীল সাগর' পত্রিকার রিপোর্টার মোহাম্মদ কামরুজ্জামানকে ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলি করে হত্যা করা হয়।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের তথ্য অনুসারে, তিনি নির্বাচনের ফলাফলের বিরুদ্ধে করা এক বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহের সময় নিরাপত্তা রক্ষাকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন।'

পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের জেলা সংবাদদাতা জানিয়েছেন, তার কোনো বিচার হয়নি।

অন্যদিকে, ২৩ বছর ধরে যশোরভিত্তিক 'দৈনিক রানার'-এর সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যা মামলার বিচার চলছে। ১৯৯৮ সালের ৩০ আগস্ট রাতে তার দিকে একটি হাতবোমা ছুড়ে মারা হলে বোমা বিস্ফোরণে তিনি নিহত হোন।

মামলাটি একবার আদালতের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যায়। এরপর ২০০৫ সালে হাইকোর্ট মামলাটির আবারও শুনানি করে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

যশোর প্রেসক্লাবের সভাপতি এস এম তৌহিদুল রহমান বলেন, 'সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম মামলার একজন আসামি ছিলেন। কিন্তু তখন একজন আসামি হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ পেলে মামলাটি অচলাবস্থায় আছে।'

রংপুরের সাংবাদিক মশিউর রহমান উত্সব দৈনিক যুগের আলো পত্রিকায় কাজ করতেন।

তার বোন মোর্শেদা বেগম বলেন, 'তাকে হত্যার ৬ বছর হয়ে গেছে। তার আইনজীবীও মামলার অবস্থা জানেন না। আমি তার মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীকে খুঁজে পাইনি। আমি আদালতে তার মামলার নম্বর খুঁজে পাইনি এবং শুনানির তারিখ কখন হবে, তা কেউ আমাকে জানায় না। আমি নিজেও জানি না আদালতে কী হচ্ছে।'

মাদক ব্যবসায়ীদের সংঘবদ্ধ চক্র উৎসকে কুপিয়ে হত্যা করে।

২১ বছর বয়সী ইহসান ইবনে রেজা ফাগুন প্রিয়ডটকমের সাবএডিটর ছিলেন। ২০১৯ সালের ২২ মে জামালপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে তার মরদেহ পাওয়া যায়। এখনো তার হত্যার বিচার এখনো শুরু হয়নি।

ইহসান ইবনে রেজার বাবা কাকন রেজা বলেন, 'তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। তারা তার সব পরিচয়পত্র কেড়ে নিয়েছিল। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যা ছিল। তবে, পুলিশ ৫ অভিযুক্তের মধ্যে এখনো ৪ জনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। মূল অভিযুক্ত এখনো পলাতক আছেন। তারা তদন্ত বন্ধ করে দিচ্ছে।'

মামলা বাদ দেওয়া হয়েছে অথবা আসামিকে খালাস

নিহত সাংবাদিক নহর আলীর স্ত্রী আসমানী বেগম স্পষ্টভাবে মনেও করতে পারেন না কখন তার স্বামীর মামলাটি আদালত থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। 

আসমানী বলেন, 'দেখুন, তিনি (নহর আলী) ২০০১ সালে মারা যান এবং মামলাটি দুই বছর ধরে চলে। কিন্তু তারপর ডাক্তার আদালতকে বলেছিলেন যে, তিনি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তারপর মামলাটি নিষ্পত্তি করে দেওয়া হয়েছে।'

'৩০ থেকে ৪০ জন লোক তাকে আক্রমণ করে। তার সব হাত পা ভাঙা ছিল। এটি কীভাবে একটি দুর্ঘটনা হতে পারে?'

শেখ হারুনুর রশীদকে ২ মার্চ ২০০২ সালে বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। তার মামলাটি আদালতে খারিজ করে দেওয়া হয়। শুকুর হোসেনকেও গুলি করা হয়েছিল কিন্তু কোন দোষী সাব্যস্ত হয়নি।

দীর্ঘ কয়েক বছর পর মাত্র ৪ জন সাংবাদিকের ক্ষেত্রে কিছু বিচার পাওয়া গেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

'দৈনিক জন্মভূমির' সম্পাদক হুমায়ুন কবির বুলু ২০০৪ সালে নিহত হন। তার পরিবার এ বছরই রায় পেয়েছে।

'নিউ এজের' একুশে পদক বিজয়ী সাংবাদিক মানিক চন্দ্র সাহা হত্যা মামলার রায় দিতে আদালতের সময় লেগেছে ১৩ বছর।

সাংবাদিক বোরহানউদ্দিন মুজাক্কিরের এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

দ্য ডেইলি স্টারের সংবাদদাতাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু অতীতের নমুনা অনুযায়ী প্রশ্ন জাগে, মুজাক্কির কি কখনো ন্যায়বিচার পাবেন?

এই বছর ফয়সাল আরেফিন দীপন, অভিজিৎ রায় ও জুলহাস মান্নান হত্যার বিষয়ে আদালতে রায় পড়ার সময় বিচারকরা তিনটি ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তা হলো- মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রয়োগ করার সাহস থাকার কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছিল।

আদালত যা ইঙ্গিত করেছে তা হলো ক্ষমতার কাছে সত্য কথা বলার জন্য সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়। দায়মুক্তি এই খুনিদের জন্য সত্যর মুখোশ হিসেবে কাজ করে।

 

(আমাদের জেলা সংবাদদাতারা এই প্রতিবেদন তৈরিতে অবদান রেখেছেন)

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন সুমন আলী

 

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

3h ago