লকডাউনে আয় শূন্য, অনাহারে-অর্ধাহারে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী

‘করোনা আমাদের মারবে না। আমরা মরব লকডাউনে। পেটের ক্ষুধায় আমাদের ছটফট করতে হয়। সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিলেও আমাদের জন্য লকডাউনে কোনো প্রণোদনা বা সহযোগিতা নেই। আমাদের কেউ মানুষ মনে করে না।’
ঢাকায় একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী সেলাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ছবি: ট্রান্সইন্ড

'করোনা আমাদের মারবে না। আমরা মরব লকডাউনে। পেটের ক্ষুধায় আমাদের ছটফট করতে হয়। সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা দিলেও আমাদের জন্য লকডাউনে কোনো প্রণোদনা বা সহযোগিতা নেই। আমাদের কেউ মানুষ মনে করে না।'

কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের ট্রান্সজেন্ডার রুবি।

লকডাউনে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া জনগোষ্ঠীর কীভাবে দিন কাটছে, তা জানতে রুবিসহ ট্রান্সজেন্ডারদের আরও কয়েকজনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। প্রত্যেকেই জানিয়েছেন লকডাউনের মধ্যে তারা সরকারি কোনো সহায়তা না পেয়ে খুব কষ্টে দিন পার করছেন। বিভিন্ন সংগঠন থেকে আগে সহযোগিতা পেলেও এবারের লকডাউনে তাদের কেউ তেমন কিছু দেয়নি।

সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকেও ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য কোনো প্রণোদনা বা লকডাউনে বিশেষ কোনো সহযোগিতা না থাকার কথা জানা গেছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, সরকারি মেডিকেল টেস্টের ভিত্তিতে দেশে ট্রান্সজেন্ডার মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। তবে, ট্রান্সজেন্ডারদের দাবি সংখ্যাটি দেড় লাখের মতো।

ট্রান্সজেন্ডার নারী ইন্সট্রাক্টর ইভান আহমেদ কথা অন্য আরেক ট্রান্সজেন্ডার নারীকে ব্লক-বাটিকের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ছবি: ট্রান্সইন্ড

ট্রান্সজেন্ডারদের মধ্যে খুব কমই বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত বা চাকরির সুযোগ পান। জীবন ধারণের জন্য তাদের অধিকাংশের আয়ের অন্যতম উৎস দোকান এবং গণপরিবহন থেকে টাকা আদায়। কেউ কেউ আবার যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন। নিজেরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করলেও সেই সুযোগ দেশে খুব কম বলে জানান তারা।

লকডাউনের কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় তাদের বর্তমানে আয় প্রায় শূন্য। তেমন কোনো সাহায্য-সহযোগিতা না পেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের।

রুবি বলেন, 'চট্টগ্রামে তিন থেকে চারশ ট্রান্সজেন্ডার আছে। প্রায় সবার সঙ্গেই আমার যোগাযোগ হয়। লকডাউনে কেউ তেমন সহযোগিতা পায়নি। আমরা পরিবার থেকেও কোনো সহযোগিতা পাই না।'

তিনি বলেন, 'বাড়ি ভাড়া দিতে পারি না বলে মালিকরা সবসময় অপমান করে। নিজেরা ঠিকমতো খেতেই পারি না, বাড়ি ভাড়া কোথা থেকে দেব। কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারি না। লকডাউনে সরকার আমাদের পাশে দাঁড়ালে জীবন এত দুর্বিষহ হতো না।'

ট্রান্সজেন্ডার শোভা সরকার বলেন, 'কমিউনিটির লোকজন বর্তমানে অনেকেই ঠিকমতো খেতে পারে না, পরতে পারে না। আগের জমানো কিছু টাকা আর ঋণ করে চলতে হচ্ছে সবাইকে।'

তিনি বলেন, 'আমাদের অনেক কিছু দেওয়া হবে, এটা শুধু শুনেই আসছি কিন্তু কেউ কোনো কিছু দিচ্ছে না। লকডাউনে আমাদের কমিউনিটিকে সহায়তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় হাত বাড়িয়েও কোনো সহযোগিতা পাইনি।'

ঢাকায় করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির মরদেহ দাফন বা সৎকার কার্যক্রমের একটি দলের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ট্রান্সজেন্ডার সঞ্জীবনী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

গুলশান এলাকায় বাস করা ট্রান্সজেন্ডার মুন্নী বলেন, 'আমরা একসঙ্গে ৫০-৬০ জন ছিলাম। লকডাউনে আয় না থাকায় অনেকে গ্রামে চলে গেছে।'

তিনি বলেন, 'অনেকেই ঋণ করে চলছে। অনেক দিন ধরে ঘর ভাড়া দিতে পারি না। এজন্য মালিক অনেক কথা শোনায়। ঘরে তালা দিয়ে দেয়। আমরা দিন আনি দিন খাই, টাকা পাব কোথায়। সরকারের কাছ থেকে লকডাউনে কোনো সহযোগিতা পাইনি।'

'লকডাউনের কারণে গণপরিবহনে টাকা তোলা বন্ধ, দোকানে টাকা তোলা বন্ধ, অনেকে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে, তাদেরও আয় প্রায় বন্ধ। আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে,' যোগ করেন মুন্নী।

গাজীপুরের টঙ্গী থেকে ট্রান্সজেন্ডার রানা বলেন, 'আমার পাশের বাসায় সরকারি ত্রাণ দিয়ে যায়। আমি চাইলে বলে- তোমরা তো অন্য মানুষ, তোমাদের দেওয়া হবে না।'

তিনি বলেন, 'আমাদের ভোটে সরকার-জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আমাদের সুযোগ-সুবিধার কথা আসলে, তখন আর আমাদের মানুষ মনে করা হয় না। আমরাও তো অন্যদের মতোই মানুষ, কিন্তু কেন আমাদের প্রতি এত অবহেলা?'

রানা আরও বলেন, 'লকডাউনের কারণে আমাদের আয় একেবারে বন্ধ। ঠিকমতো তিন বেলা খেতে পারি না। অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়। চিকিৎসা করাতে পারি না। গত লকডাউনে কিছু সহযোগিতা পেয়েছিলাম। কিন্তু এবার কিছুই পাইনি।'

'আমরা কাজ করে খেতে চাই। আমি বুটিকের কাজ জানি। কিন্তু আমাদের কেউ কাজে নিতে চায় না। আমাদের নিজেদের তেমন তহবিলও নেই। তাহলে আমরা যাব কোথায়, খাব কী। এই যে ঈদ গেল, আমাদের কি ইচ্ছে ছিল না নতুন পোশাক পরার। কিন্তু আয় না থাকায় পরতে পারিনি।'

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন ট্রান্সজেন্ডার সঞ্জীবনী। আগে কাজ করতেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কর্মী হিসেবে। বর্তমানে কোয়ান্টাম কসমো স্কুলে নাচের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন তিনি।

সঞ্জীবনী বলেন, 'লকডাউনে আমাদের কমিউনিটির লোকদের কেউ তেমন সহযোগিতা করছে না। সরকারের কাছ থেকে কেউ কোনো সহযোগিতা পায়নি। অনেকেই সাহায্যের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।'

তিনি বলেন, 'কোথাও হাত পাতাটা আসলে খুবই কষ্টের। আমরাও হাত পাততে চাই না। সমাজ বা রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমরাও দেশের সম্পদ হতে চাই। কিন্তু সমাজ আমাদের সেই সুযোগ দিচ্ছে না।'

করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির মরদেহ দাফন করতে যাচ্ছেন সঞ্জীবনী ও তার দলের সদস্যরা। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

'আমরা চাই আমাদের জন্য কর্মক্ষেত্র তৈরি করা হোক, আমাদেরকেও সমাজের সাধারণ মানুষের মতো মানুষ মনে করা হোক। অন্যরা সহযোগিতা করে আমাদের বেশি দিন চালাতে পারবে না। আমরা সবাই যদি আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারি, তাহলে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরাও অবদান রাখতে পারব,' যোগ করেন তিনি।

ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সইন্ড'র প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও লামইয়া তানজিন তানহা বলেন, 'করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই তাদের আয় কমে গেছে। বের হলেও তারা তেমন সহযোগিতা পেতেন না। এবারের লকডাউন একটু বেশি কঠোর হওয়ায় তাদের আয় প্রায় শূন্য হয়ে যায়।'

তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে এমনও রিপোর্ট এসেছে যে, অনেক বাড়িওয়ালা তাদের বের করে দিয়েছেন। তারা নাকি করোনা ছড়ায়। বাধ্য হয়ে অনেকে গ্রামে চলে গেছেন। যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তারা কোনো মতে ঢাকায় থাকছেন।'

'সরকার বলছে, তাদের চাকরি দেওয়া হবে, কিন্তু যোগ্যদের পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের তো তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। আগে তাদের সেই সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তারপর চাকরি দিতে হবে। ২০১৯ সাল থেকে তাদের এনআইডি কার্ড দেওয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অনেকরই এনআইডি নেই। এজন্য তারা টিকাও নিতে পারছেন না। সবমিলিয়ে করোনাকালে তারা খুব খারাপ অবস্থায় আছেন। তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে,' যোগ করেন তিনি।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া জনগোষ্ঠী) মো. শাহ জাহান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনাকালে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য বিশেষ কোনো ভাতা বা প্রণোদনার ব্যবস্থা নেই। তবে, তাদের জন্য মাসিক ভাতা আছে।'

তিনি বলেন, 'যারা ৫০ বছরের ওপরে, শুধু তাদেরকেই মাসিক ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। এমন দুই হাজার ৬০০ জন সারাদেশে ভাতা পান। তাছাড়া বিভিন্ন প্রশিক্ষণের আয়োজন করে তাদের আত্মনির্ভরশীল করার চেষ্টা চলছে। করোনাকালে তাদের জন্য বিশেষ ভাতা থাকলে অবশ্যই ভালো হতো। কিন্তু আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।'

Comments

The Daily Star  | English
Cuet students block Kaptai road

Cuet closed as protest continues over students' death

The Chittagong University of Engineering and Technology (Cuet) authorities today announced the closure of the institution after failing to pacify the ongoing student protest over the death of two students in a road accident

19m ago