রাধাপদ রায়ের তৈরি নতুন এক বাদ্যযন্ত্র ‘রঙতাল’

‘কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানি না’- আধ্যাত্মিক এই কবিতার রচয়িতা গ্রামীণ কবি রাধাপদ রায়। গ্রামের মানুষের কাছে নিজের লেখা কবিতা সুরে সুরে আবৃত্তি করে ভাইরাল হয়েছেন তিনি। গেল ১০ বছরে ৯০টি আধ্যাত্মিক ও গ্রামীণ কবিতা রচনা করেছেন রাধাপদ রায়। নিজ গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় তিনি গ্রামীণ কবি হিসেবে পরিচিত।
নিজের তৈরি বাদ্যযন্ত্র হাতে রাধাপদ রায়। ছবি: এস দিলীপ রায়

'কেয়ামতের নমুনা জানি কিন্তু মানি না'- আধ্যাত্মিক এই কবিতার রচয়িতা গ্রামীণ কবি রাধাপদ রায়। গ্রামের মানুষের কাছে নিজের লেখা কবিতা সুরে সুরে আবৃত্তি করে ভাইরাল হয়েছেন তিনি। গেল ১০ বছরে ৯০টি আধ্যাত্মিক ও গ্রামীণ কবিতা রচনা করেছেন রাধাপদ রায়। নিজ গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় তিনি গ্রামীণ কবি হিসেবে পরিচিত।

রাধাপদ রায় ৬ বছর আগে গ্রামীণ একটি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেন। বাদ্যযন্ত্রটির নাম দিয়েছেন রঙতাল। বাংলা বাদ্যযন্ত্রে রঙতালে নাম না থাকলেও রাধাপদ এ বাদ্যযন্ত্র সংযোজন করেছেন। তিনি একাই এ বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন। ৫ জোড়া স্টিলের বাটি দিয়ে তিনি এ যন্ত্রটি তৈরি করেছেন। তার মুখে উচ্চারিত কবিতার সঙ্গে বেজে উঠে রঙতাল। গ্রামের মানুষ সীমাহীন আনন্দ উপভোগ করেন আর আধ্যাত্মিক কবিতায় মুগ্ধ হন।

রাধাপদ রায়ের তৈরি নতুন বাদ্যযন্ত্র ‘রঙতাল’। ছবি: এস দিলীপ রায়

'আমি নিজের প্রয়োজনে রঙতাল বাদ্যযন্ত্রটি তৈরি করেছি। তবে সম্প্রতিকালে কয়েকজন আমার কাছ থেকে এ যন্ত্রটি বানিয়ে নিয়েছেন,' দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন রাধাপদ রায়। 

'মানুষ পরকালের কথা ভুলে গিয়ে রঙে তাল মিলিয়ে জীবনযাপন করছেন। প্রতিদিন রঙ নিয়ে মেতে থাকছেন। তাই আমি এ বাদ্যযন্ত্রটির নাম দিয়েছি রঙতাল,' তিনি বলেন। 

'আমার সামর্থ্য নেই। তবে, আমার লেখা কবিতাগুলো বই আকারে প্রকাশ করতে পারলে তৃপ্তি পেতাম' উল্লেখ করে রাধাপদ বলেন, 'যখন যেভাবে মনে হয়েছে, তখন সেভাবে কবিতার লাইন লিখে রাখি। গেল ১০ বছরে ৯০টি কবিতা লিখতে পেরেছি।'

১৯৪৭ সালের ৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করা গ্রামীণ এই কবি পঞ্চম শ্রেণি পযর্ন্ত পড়ালেখা করেছেন। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার প্রান্তিক এক জনপদ মাধাইখাল গ্রামে জন্মগ্রহন করেন রাধাপদ রায়। পরিবার পরিজন নিয়ে ওই গ্রামে বসবাস করছেন। সম্পদ বলতে রয়েছে, বসতভিটার ৬ শতাংশ জমি আর একটি বাইসাইকেল। এক সময় তিনি ছিলেন গ্রামের বিত্তশালী। 

প্রতিদিন সকালে বাইসাইকেলে চড়ে বের হন রাধাপদ রায়। ছবি: এস দিলীপ রায়

'প্রতিদিন সকালে বাইসাইকেলে চড়ে বাড়ি থেকে বের হই। ফিরে আসি রাতে। দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছি। কবিতা দিয়ে মানুষকে বুঝাই। মানুষকে আনন্দ দেই। তারা খুশি হয়ে বকশিস দেন। এভাবেই চলছে আমার জীবন,' বলেন তিনি।

নিরামিষ ভোজি পল্লী কবি রাধাপদ রায় ১০ বছর আগে বাস করতেন মন্দিরে। ঘুরে বেড়াতেন মন্দিরে মন্দিরে। পরে স্ত্রী সন্তানদের অনুরোধ তিনি বাড়িতে ফেরেন। আবারও টানতে শুরু করেন সংসারের ঘানি। সহায়-সম্বলহীন রাধাপদ বাইসাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে ছুটে যান আয় করতে। সুরে সুরে কবিতা আবৃত্তি করে গ্রামের মানুষকে বিমোহিত করে আয় করছেন সামান্য অর্থ। সংসারে রয়েছেন স্ত্রী নিয়তি বালা বর্মণী আর ছোট ছেলে কাজল চন্দ্র রায়। বড় তিন মেয়ে ও দুই ছেলের বিয়ে হয়েছে। 

'আমি বাইসাইকেল চালিয়ে ৫০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম পযর্ন্ত যাই। আমার মাঝে ক্লান্তি নেই। আমাকে অনেকে বৈরাগি বলে জানেন,' বলেন রাধাপদ। 

তিনি আরও বলেন, 'প্রতিদিন গড়ে ২০৫-৩০০ টাকা রোজগার করি। ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। দারিদ্রতা আমাকে কাঁদায়। পুরানো দিনের কথা মনে হলে কেঁদে উঠি।'

রাধাপদ রায়ের স্ত্রী নিয়তি বালা বর্মনী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'একসময় তাদের গোলাভরা ধান ছিল, গোয়ালভরা গরু ছিল, বাগান ছিল আর বিপুল পরিমাণে আবাদি জমি ছিল। এখন আর কিছুই নেই। ওষুধ কেনার টাকাও জোটে না। যে বয়সে বসে বিশ্রাম নেওয়ার কথা সে বয়সে আমার স্বামী বাইসাইকেলে চড়ে গ্রাম ঘুরে বেড়ান আয় করার জন্য। আমার খুব কষ্ট লাগে। কিন্তু আমি নিরুপায়।'

তিনি আরও বলেন, 'আমার ভালো লাগে আমার স্বামী যখন রঙতাল বাজিয়ে তার নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। আমি বিমোহিত হই, মুগ্ধ হই। এ যেন আমার কাছে শত কষ্টের মাঝে এক চিলতি শান্তি।'

স্থানীয় বাসিন্দা সুরেশ চন্দ্র রায় দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গ্রামীণ কবি রাধাপদ রায়ের রঙতালের সুর আর তার মুখ থেকে সুরে সুরে গাওয়া কবিতা শুনে তারা মুগ্ধ। প্রায় ৭৫ বছর বয়সে তিনি এখনো সুস্থ আর বাইসাইকেল চালাতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে।' 

'আমরা রাধাপদ রায়ের কবিতা থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পাচ্ছি। সমাজে ভালো মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণাও পাচ্ছি,' বলেন সুরেশ চন্দ্র রায়।

     
 

Comments

The Daily Star  | English
Avoid heat stroke amid heatwave: DGHS issues eight directives

Avoid heat stroke amid heatwave: DGHS issues eight directives

The Directorate General of Health Services (DGHS) released an eight-point recommendation today to reduce the risk of heat stroke in the midst of the current mild to severe heatwave sweeping the country

1h ago