আ. লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে মলিন নির্বাচনী উৎসব

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমতায় যেতে বা চেয়ারম্যান পদে টিকে থাকতে কতটা মরিয়া সেটা প্রমান করে।
ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতারা ক্ষমতায় যেতে বা চেয়ারম্যান পদে টিকে থাকতে কতটা মরিয়া সেটা প্রমান করে।

প্রায় অধিকাংশ ইউপিতে আওয়ামী লীগের তৃনমূল নেতারা দলীয় সিদ্ধান্ত এবং দলের সতর্কতা উপেক্ষা করে মনোনয়ন দাখিল করেছেন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপস্থিতিতে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃনমূল আওয়ামী লীগ নেতাদের এই ক্ষমতায় থাকার প্রতিযোগিতায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগ নিজেই।

আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এ ধরনের তিক্ত দ্বন্দ্বের ফলে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সারাদেশে অসংখ্য সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও, আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান মনোনীত প্রার্থী এবং দলের নেতারা তাদের নানা বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন, যারা তাদের বিরুদ্ধে যাবে, তাদেরকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেওয়া হবে।

দ্য ডেইলি স্টারের সাথে আলাপকালে সুশাসনের জন নাগরিক (সুজন) সভাপতি হাফিজউদ্দিন খান বলেন, 'ক্ষমতাসীন দলের লোকদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও মন্তব্য গণতন্ত্রের জন্য অশুভ লক্ষণ। গণতান্ত্রিক চর্চা থাকলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কখনোই ঘটত না।'

তিনি বলেন, 'গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো নিরপেক্ষ নির্বাচন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমে গেছে। এই ধরনের বক্তব্য শুনে ভোটাররা এখন কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে নিরাপত্তাহীন বোধ করবেন।'

নির্বাচনের সহিংসতা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি।'

মাহবুব তালুকদার বলেন, 'এ ধরনের মন্তব্য করে তারা নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে।'

আগামীকাল বৃহস্পতিবার মোট ৮৪৬টি ইউনিয়নে ভোট হবে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে ২৮ নভেম্বর আরও ১ হাজার ৪টি ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন শুক্রবার ভোটারদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, হুমাইপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থীকে ভোট না দিলে তিনি একে-৪৭ রাইফেল ব্যবহার করবেন।

হুমাইপুর ইসলামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রফিকুল ইসলামের প্রচার সমাবেশে তিনি এ হুমকি দেন। মামুনের বক্তব্যের ৭ মিনিট ১০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, 'আমরা শুধু একে-৪৭ ব্যবহার করব না, যা যা প্রয়োজন হবে তাই করব। প্রশাসন আমাদের, পুলিশ এবং সরকারও আমাদের। আমার আর কিছু বলার দরকার আছে কি?'

মামুন পরে দাবি করেন, তিনি দলীয় লোকদের মন থেকে ভয় দূর করতে একে-৪৭ নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি ভোটের সময় একে-৪৭ রাইফেল ব্যবহার করতে চাননি।

একই দিন মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আফজাল হোসেন মোল্লা বলেন, তিনি ২টি অস্ত্র নিয়ে আসবেন এবং সাহস থাকলে কেউ যেনো তার সামনে হাজির হন।

লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী মজিবুর রহমানের সমর্থনে সুরজামনি বাজারে এক সমাবেশে তিনি বলেন, 'যারা নৌকায় দেবেন না, তাদের এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই।'

আফজাল আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাতিজা।

তার মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আফজাল গণমাধ্যমকে বলেন, যারা ক্ষমতাসীন দলকে মৌখিকভাবে গালিগালাজ করে তাদেরকে তিনি হুমকি দিয়েছেন।

গত ১ নভেম্বর শরীয়তপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল হাসেম তপাদার হুমকি দিয়ে বলেন, ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে ভোট চাওয়ার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। সমাবেশে তার বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী মিজান মোহাম্মদ খানের নির্বাচনী সমাবেশে এই হুমকি দেন।

আবুল হাসেম পরে দাবি করেন, তিনি এমন মন্তব্য করেননি এবং এটি তার বিরুদ্ধে একটি অপপ্রচার। 'আজকাল অনেক কিছুই সম্পাদনা করে প্রচার করা যায়।'

আগামীকালের হতে যাওয়া নির্বাচনে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউপির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী শাহ আলম ১লা নভেম্বর বলেছেন, যারা নৌকাকে ভোট দেবেন না তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হবে এবং মৃত্যুর পর দাফনের জন্য স্থানীয় কবরস্থান তাদের জায়গা দেওয়া হবে না।

গত ৩০ অক্টোবর নাটোর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মাসুদুর রহমান বলেন, ইউপি নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না তাদের ভোট কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না।

নাটোর সদর উপজেলার তেবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ওমর আলী প্রধানের সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।

গত মাসের শেষ দিকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিতালিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, 'চিতালিয়া ইউনিয়নে কোনো নির্বাচন হবে না বলে এমপি স্যারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সবাইকে বিনা ভোটে নির্বাচিত করা হবে। ইকবাল হোসেন এমপি এ কথা বলেছেন।'

ইকবাল হোসেন অবশ্য পরে বলেন, তিনি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।

প্রার্থী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, 'নির্বাচনী প্রচারের সময় কেউ এ ধরনের মন্তব্য করলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ব্যবস্থা নেবেন। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

এ ধরনের মন্তব্য নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করছে এবং ভোটারদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ না করে আমি তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে পারব না। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এমনটা মনে করলে কমিশনকে জানাতে পারেন।'

সংঘর্ষ

আগামীকাল দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতা অব্যাহত আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ও দলীয় 'বিদ্রোহী' প্রার্থীর সমর্থকরা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন। ক্ষমতাসীন দলের সূত্র মতে, আগামীকাল প্রায় ৬৯০ জন 'বিদ্রোহী' প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দ্য ডেইলিকে বলেছেন, নির্বাচনে অন্যান্য বড় রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলের মধ্যে দুর্বল চেইন অব কমান্ড এবং তৃণমূলে প্রার্থী বাছাইয়ে স্বজনপ্রীতি এতো বেশি বিদ্রোহী প্রার্থীর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ দ্য ডেইলিকে বলেন, 'অনেক তৃণমূল নেতা, যারা ধনী হয়ে উঠেছেন, তারা এখন দলীয় নির্দেশনার খুব কমই কর্ণপাত করেন। আবার, বিরোধী দলগুলো 'বিদ্রোহীদের' আর্থিকভাবে সমর্থন দিচ্ছে। এ কারণেই অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী আছে।'

তিনি জানান, তারা তৃণমূল নেতাদের কোনো ধরনের সংঘর্ষে না জড়াতে বলেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, দল 'বিদ্রোহী' প্রার্থীদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে।

তিনি বলেন, 'আগে আমরা 'বিদ্রোহীদের' দলে গ্রহণ করেছি। এবার তাদের গ্রহণ করব না।'

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৪০ জন নিহত হয়েছেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি মাসে নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, নরসিংদী এবং ঢাকার ধামারাই উপজেলায় প্রাক-নির্বাচন সহিংসতায় অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় ১৪৭ জন নিহত হয়েছিলেন।

নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচনী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।

তিনি ৪ নভেম্বর পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত এক বৈঠকে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সব প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে বলেন।

বৈঠকে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঢাকা ও খুলনা বিভাগের ৭ জেলায় নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ে কমিশনকে সতর্ক করেছিলেন।

পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ঢাকা রেঞ্জ) হাবিবুর রহমান বৈঠকে জানান, ঢাকা বিভাগের ৯০টি ইউনিয়নে সহিংসতার সম্ভাবনা আছে। আগামীকাল এ বিভাগের ১৭০টি ইউনিয়নে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন সুমন আলী

Comments

The Daily Star  | English

Trade at centre stage between Dhaka, Doha

Looking to diversify trade and investments in a changed geopolitical atmosphere, Qatar and Bangladesh yesterday signed 10 deals, including agreements on cooperation on ports, and overseas employment and welfare.

3h ago