যানজটের নাম উন্নয়ন?

৩০০ বছরের শহর কলকাতাকে নিয়ে শিল্পী কবির সুমন লিখেছিলেন, ‘রুমাল চেপে নাকে মুখে/বাঁচতে চাইছি কপাল ঠুকে/মৃত্যু আমায় ডাক পাঠাচ্ছে কলকাতা।’

৩০০ বছরের শহর কলকাতাকে নিয়ে শিল্পী কবির সুমন লিখেছিলেন, 'রুমাল চেপে নাকে মুখে/বাঁচতে চাইছি কপাল ঠুকে/মৃত্যু আমায় ডাক পাঠাচ্ছে কলকাতা।'

তিন শতকের শহর শিরোনামের ওই গানের পরের লাইনগুলোতেই সুমন আবার গেয়েছেন, 'লরির ধাক্কা বাসের গুঁতো/ভাঙা পথে হাঁটার ছুতো/হাঁটছি তোমার জাহান্নামে কলকাতা।'

কলকাতার পাশাপাশি কেবল রাজধানী হিসেবেই ৪০০ বছরের বেশি সময় পার করা ঢাকা শহরের ক্ষেত্রেও সুমনের গানের উল্লিখিত চরণগুলো প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

নানামুখী সমস্যায় প্রায় ২ কোটি মানুষের এই মহানগরে জীবনযাত্রা ক্রমেই আরও বেশি দুর্ভোগময় হয়ে উঠছে। এখানে সবচেয়ে প্রকট ও জটিল সমস্যাটি হলো যানজট। এটা নিয়ে অনেক বছর ধরে অনেক কথা বলা হচ্ছে। যানজট নিরসনে নানা রকমের উদ্যোগের কথাও মাঝেমধ্যে শোনা যায়, কিন্তু এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বরং তা দিনে দিনে আরও প্রকট হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি যানজট নিয়ে বর্তমান সরকারের ২ জন মন্ত্রীর বক্তব্য বেশ আলোচনা তৈরি করেছে।

এরমধ্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গতকাল মঙ্গলবার একনেক সভার পর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'দেশে এত যানজট, ভিড় সবই শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের বহিঃপ্রকাশ।' তাই আপাতত এটা 'সহ্য' করার পরামর্শও দেন তিনি।

অন্যদিকে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম গত ৬ এপ্রিল সংসদে রাজধানীর যানজট নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের সমালোচনার জবাবে বলেন, '২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। তাই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ যদি আরও ৫ বছর ক্ষমতায় থাকে, তাহলে উপজেলাতেও দেখবেন গাড়ির লাইন লেগে যাবে।'

দেখা যাচ্ছে, যানজটের কারণ হিসেবে ২ মন্ত্রীই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি সামনে এনেছেন। বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে নগর বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, স্থপতি ও পরিবেশকর্মী ইকবাল হাবিব এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদের সঙ্গে।

তাদের ভাষ্য, উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন ও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ঠিকঠাক চললে যানজটের এই দুর্ভোগ এতখানি অসহনীয় হয়ে উঠত না। আর যানজটের অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির বিষয়টিকে উন্নয়নের মাপকাঠি ধরা হলে তা ঠিক হবে না। কারণ সব শ্রেণির মানুষের জন্য গণপরিবহন নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বল্পতম খরচ ও দ্রুততম সময়ে পারাপার বা চলাচল নিশ্চিতের মধ্যেই সত্যিকারের উন্নয়ন নিহিত।

যানজট নিয়ে সরকারের এই ২ মন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে নগর গবেষণাকেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, '(কথাগুলো) ওনাদের মতো করে ওনারা বলেছেন। আমরা ভুক্তভোগী। আর একজন নগর গবেষক হিসেবে আমি বলব, এটা হলে তো হবে না। উন্নয়ন হতেই থাকবে আর দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে, এটা তো হয় না। উন্নয়ন অবশ্যই হবে। এর পাশাপাশি ম্যানেজমেন্ট ও গুড গভর্নেন্স তাল মিলিয়ে চালাতে হবে।'

বিশ্বব্যাংক ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে ঢাকার সড়কে যানবাহনের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা কমে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। এআরআইয়ের হিসাবে এখন যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৩৯ কোটি টাকা।

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, 'ওনারা এক হিসেবে বলেছেন উন্নয়ন তো হচ্ছেই। সেটাতেই জোর দিচ্ছেন। আমরা এটা অ্যাপ্রিশিয়েট করি। অভিনন্দন জানাই। এতে আমাদেরও লাভ হচ্ছে অনেকক্ষেত্রে। অনেক দেশেই তো উন্নয়ন হয়, কিন্তু এইভাবে ট্রাফিক ক্যাওসটা হয় না এতটা।'

এ পর্যায়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এই নগর বিশেষজ্ঞ। বলেন, 'তার মানে, এখানে যদি গুড গভর্নেন্স হতো, টেকনিক্যাল ম্যানেজমেন্টটা ভালো হতো, তাহলে এই দুর্ভোগ অনেক কম হতে পারত, সহনীয় পর্যায়ে থাকত। ট্রান্সপোর্ট এক্সপার্ট যারা আছেন, তারা সবসময় এ কথাই বলে আসছেন, আমরাও বলছি। সরকারের যে স্ট্রাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান, সেখানেও এ বিষয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দেওয়াও আছে। সুতরাং (ওই দিক-নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন হলে) এ ধরনের বক্তব্যের প্রয়োজন হতো না।'

অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ভাষ্য, 'উন্নয়ন অবশ্যই হবে। তার পাশাপাশি আরবান প্ল্যানিংটা ভালো হতে হবে, আরবান ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টটা ভালো হতে হবে। এই দুটো একসঙ্গে হওয়া সম্ভব।'

এ ব্যাপারে স্থপতি ইকবাল হাবিবের বক্তব্য, 'যারা সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন ও উন্নয়নের বহিঃপ্রকাশ সম্বন্ধে চিন্তা করেন, পৃথিবী সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, পরিবহন সেক্টরে অন্তত, তারা জানেন উন্নয়নের চিহ্ন হচ্ছে—যখন মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তরাও গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ গণপরিবহন ব্যবহারের প্রাধান্যই হচ্ছে উন্নয়নের মাপকাঠি।'

তিনি আরও বলেন, 'যারা এর উল্টোটা ভাবেন, অর্থাৎ ব্যক্তিগত গাড়িই উন্নয়নের মাপকাঠি, সেটা আমেরিকা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও গ্রহণযোগ্য না। কারণ আমেরিকা একটি কার ড্রাইভেন কান্ট্রি। এই দেশটিতে ভূমির স্বল্পতা নেই, কিন্তু ইউরোপ বা এশিয়ায় অবশ্যই বসবাসযোগ্য ভূমির স্বল্পতা আছে। এটা আছে বলেই এ সমস্ত জায়গায় গণপরিবহনের মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করা হয়েছে। আপনি যদি বলিভিয়া যান, কলম্বিয়ায় যান সবখানে একই চিত্র দেখা যাবে। কারণ তারা এটা অন্তত বুঝেছে যে, গণপরিবহনের ভিত্তিতে সড়কের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।'

ইকবাল হাবিবের ভাষ্য, 'আমরা যদি ক্রমাগত প্রাইভেট কার দিয়ে সড়ক ব্যবস্থাকে একেবারে ভরপুর করে ফেলি, একদম এগজস্টেড করে ফেলি, তারপর সেটাকে উন্নয়নের শিখণ্ডি মনে করে আত্মতুষ্টিতে, আত্মশ্লাঘায় ভুগি, সেটাকে আমি বোকামি ছাড়া আর কিছু বলব না।'

তিনি আরও বলেন, 'বিশ্বব্যাপী যারা এ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, তারা বরং উল্টোটাই বলছেন। সড়কের সর্বোচ্চ ব্যবহার, অনেক বেশি মানুষের স্বল্পতম খরচে, দ্রুততম সময়ে পারাপার বা চলাচল নিশ্চিতের মধ্যেই উন্নয়ন নিহিত। অতএব গণপরিবহন ও পদচারীবান্ধবতার মাধ্যমেই কেবল উন্নয়ন ও উন্নয়নের সাসটেইনেবেলিটি নিশ্চিত করা যাবে।'

যানজট ও উন্নয়ন নিয়ে ২ মন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে বিআইপির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, 'উন্নয়ন তো হবেই। এর কিছু বেদনাও থাকে। তবে, নিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খলভাবে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে এই দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘব করা যায়।'

উপজেলা পর্যায়ে যানজটের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সংসদে দেওয়া স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রসঙ্গে এই নগর পরিকল্পনাবিদের বক্তব্য হলো, 'আমরা তো মনে করি উপজেলাগুলোকে যদি পরিকল্পিতভাবে সাজানো যায় তাহলে বরং ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ উপজেলা পর্যায়ে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, স্বাস্থ্যসেবা যাবে, শিক্ষা যাবে। আমরা তো বিষয়টা এভাবেই দেখি।'

Comments