মেয়ররা জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে দায়মুক্ত হচ্ছেন

সিটি করপোরেশনের আওতাধীন যেসব জায়গা তাদের কর্মীদের পরিষ্কার করার কথা, সেসব জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় কোনো ধরনের ফগিং বা স্প্রে না করায় এ বছর ডেঙ্গু বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
টায়ার জমে থাকা পানিতে জন্মায় এডিস মশার লার্ভা। ছবিটি গত ১১ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে তোলা। ছবি: পলাশ খান/স্টার

সিটি করপোরেশনের আওতাধীন যেসব জায়গা তাদের কর্মীদের পরিষ্কার করার কথা, সেসব জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। এমনকি কিছু কিছু জায়গায় কোনো ধরনের ফগিং বা স্প্রে না করায় এ বছর ডেঙ্গু বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

(বাম থেকে) নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার। ছবি: সংগৃহীত

তারা জানান, এসব জায়গায় শুধু সিটি করপোরেশনই এডিস মশার লার্ভা নিধন করতে পারে। সেখানে জনগণের কোনো হাত নেই। কিন্তু, তারা তা না করে 'ব্লেমিং গেম' খেলছে। এর ফলে বেড়েছে ডেঙ্গু।

কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ টেলিফোনে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিভিন্ন থানায় জমা করে রাখা জব্দকৃত গাড়ি, সরকারি অফিস ও সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন জায়গায় আমরা এডিস মশার লার্ভা পাচ্ছি। একমাত্র সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব এসব এলাকায় লার্ভা ধ্বংস করা। কিন্তু, তারা তা করছে না। তারা তাদের নিজেদের পরিষ্কার করা জায়গাগুলো সারাবছর পরিষ্কার রাখলে এত বেশি ডেঙ্গু হতো না।'

তিনি আরও বলেন, 'সিটি করপোরেশন বলছে থানার ভেতরে বা এর আশেপাশে যে লার্ভা জন্মায়, সেটা নাকি থানা কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু, তারা কীটনাশক ও মেশিন পাবে কোথায়? এটি এক ধরনের দোষ চাপিয়ে দায় মুক্তি পাওয়া ছাড়া আর কিছু না। বিভিন্ন থানায় যে গাড়িগুলো পড়ে আছে, সেগুলোতে কীটনাশক প্রয়োগ করলে অনেকাংশে এডিস মশা নিধন করা যাবে। তারা বলছে, ডেঙ্গুর জন্য নাকি ৮০ শতাংশ জনগণ দায়ী আর ২০ শতাংশ সিটি করপোরেশন। এটি আসলে সম্পূর্ণ ভুল তথ্য।'

'এই মুহূর্তে অ্যাডাল্ট মশা মারতে হবে। কার্যকরভাবে ফগিং করতে হবে। যা জনগণের হাতে নেই। কিন্তু, তারা তা না করে লার্ভা নিধন করছে, জনগণকে জরিমানা করছে। যা মোটেও উচিত না। এটা সময় ও জনগণের টাকা অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়', যোগ করেন তৌহিদ উদ্দিন আহমেদ।

কীটতত্ত্ববিদ ও বাংলাদেশ প্রাণীবিজ্ঞান সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন থানায় পড়ে থাকা জব্দকৃত গাড়ি, বিভিন্ন নার্সারি, কবরস্থান, গাড়ি রাখার গ্যারেজে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এসব জায়গা পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। কিন্তু, তারা তা করছে বলে আমার মনে হয় না।'

তিনি আরও বলেন, 'তারা থানায় বা এর আশেপাশে কীটনাশক প্রয়োগ করবে না, গাড়ি রাখার গ্যারেজে কীটনাশকের প্রয়োগ করবে না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কীটনাশকের প্রয়োগ করবে না, সরকারি বিভিন্ন ভবনে গিয়ে করবে না, তাহলে তারা করে কী? তারা আসলে কাজের কাজ কিছুই না করে জনগণের ওপর দায় চাপিয়ে এক ধরনের ব্লেমিং গেম খেলছে।'

'ঢাকার মতো মশা নিয়ন্ত্রণে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই। তারা নায়ক-নায়িকা নিয়ে এক ধরনের মিছিল করছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের নামে তারা মজমাস্তি করে বেড়াচ্ছে। এতে করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ তো হচ্ছেই না, বরং তারা জনগণের টাকার অপচয় করছে', যোগ করেন মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী।

বাড়ির ভেতরের মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং সিটি করপোরেশন বাড়ির বাইরের মশা নিয়ন্ত্রণ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'কিন্তু সিটি করপোরেশন তা কার্যকরভাবে করছে না। তারা জনগণকে সচেতন করতেও ব্যর্থ এবং নিজেদের আওতাধীন জায়গাগুলোতেও মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ।'

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসের আশেপাশে, রাস্তার পাশে, বাস স্টেশনের আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের পাত্র, টায়ার পড়ে থাকতে দেখি। এগুলোতে এডিস মশার লার্ভা জন্মায়। সিটি করপোরেশনের কাজ হলো সারা বছর, বিশেষ করে এডিস মশার প্রজনন মৌসুমে এসব পাত্র ও টায়ার পরিষ্কার করা অথবা সরিয়ে ফেলা। কিন্তু, তারা তা করেছে বলে আমার মনে হয় না।'

তিনি বলেন, 'সিটি করপোরেশন যদি সারা বছর শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব পাত্র, টায়ার পরিষ্কার করত এবং নগরবাসী যদি তাদের নিজের বাসার পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখত, তাহলে ডেঙ্গু হয়তো বা এতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করত না।'

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিভিন্ন সরকারি ভবনের ছাদগুলো তালাবদ্ধ থাকে। নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণে এই ছাদগুলোতে মশা জন্মায়। অফিসগুলোর সঙ্গে কথা বলে এগুলো পরিষ্কার করা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। কিন্তু, তারা তা করে বলে আমার জানা নেই।'

তিনি বলেন, 'ঢাকা শহরে কিছু জায়গায় সিটি করপোরেশন যাওয়ার সাহস পায় না বা যায় না। এসব জায়গায় মশা নিধন করতে হবে। এ ছাড়া, বিভিন্ন ভবনের বেসমেন্টে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সিটি করপোরেশন কিছু কাজ করলেও তেমন কার্যকর কিছু করছে না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা মশা জন্ম নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ নেই না। ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার পর মশা মারলে তো আর ডেঙ্গু কমবে না।'

মোবাশ্বের হোসেন বলেন, 'সিটি করপোরেশন মানুষকে দেখানোর জন্যে রাস্তা দিয়ে ফগিং করে মশাকে রাস্তার পাশে থাকা বাড়িগুলোতে পাঠিয়ে দেয়। ফগিং বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায় না। মশা মারার নামে মূলত তারা টাকা অপচয় করছে।'

'সিটি করপোরেশনকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি নগরবাসীকে তাদের বাসার কমোড, এসি, টব ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। তবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে', তিনি যোগ করেন।

সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকা জায়গাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় কি না জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও মুখপাত্র মো. আবু নাছের টেলিফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সব জায়গা পরিষ্কার করি এবং তা নিয়মিত করা হয়।'

সিটি করপোরেশন তাদের আওতাধীন জায়গাগুলো কার্যকরভাবে পরিষ্কার করছে না বলে বিশেষজ্ঞদের মতামতের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, 'যারা বলছেন তারা হয় না জেনেই বলছেন, নতুবা ইচ্ছাকৃতভাবে বলছেন। আমরা দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি। বিশেষজ্ঞরা একেক সময়ে একেক তথ্য দিয়ে থাকেন। তাদের সব কথা তো আর আমাদের পক্ষে শোনা সম্ভব না।'

সরকারি বিভিন্ন জায়গা পরিষ্কারে কী উদ্যোগ নিয়েছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সব জায়গা পরিষ্কার করা তো আর আমাদের পক্ষে সম্ভব না। আমরা তাদেরকে পরিষ্কার রাখার আহ্বান জানিয়েছি।'

সিটি করপোরেশনের আওতাধীন জায়গাগুলো কার্যকরভাবে পরিষ্কার করা হয় কি না, জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সিটি করপোরেশনের আওতাধীন সব জায়গা পরিষ্কার রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আমাদের কর্মীরা নিয়মিতই কাজ করছে। তবে, এক্ষেত্রে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। তারা যদি আমাদের কোথায় টায়ার, পাত্র পড়ে আছে এসব তথ্য দেয় তাহলে কাজটি আমরা আরও ভালোভাবে করতে পারব।'

Comments

The Daily Star  | English

Small businesses, daily earners scorched by heatwave

After parking his motorcycle and removing his helmet, a young biker opened a red umbrella and stood on the footpath.

26m ago