‘মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এটা বলা এক ধরনের নিষ্ঠুর উপহাস’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তুলনামূলকভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চাল, ডাল, আটা, ডিম মাছ, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেশি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তুলনামূলকভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চাল, ডাল, আটা, ডিম, মাছ, মাংসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেশি।

সিপিডির তথ্য মতে, গুঁড়ো দুধের মূল্য ইউরোপের তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। অথচ তাদের তুলনায় আমাদের মাসিক আয় অনেক কম। আমাদের দেশে ডিমের ডজন ১১০ টাকা হলেও আমেরিকায় ১০৩ ও মালয়েশিয়ায় ৮৫ টাকা (১ ডলার‍ = ৮৬ টাকা হিসাবে)। দেশে কোনো কোনো পণ্যের দাম ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ বেড়েছে।

দাম বাড়ার কারণে হিসেবে দেশে বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলার অভাব, চাহিদা-জোগান সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকাসহ বাজার তদারকি ও আইন প্রয়োগে দুর্বলতাকে দায়ী মনে করছে সংস্থাটি। অন্যদিকে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকটি কারণের কথা বলা হচ্ছে। সেগুলো হলো—মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। সরকারের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি সমর্থিত ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

সার্বিক বিষয় নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার টেলিফোনে কথা বলেছে, অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সঙ্গে।

অর্থনীতিবিদরা দাম বৃদ্ধির জন্য সরকারের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করলেও তা মানতে অস্বীকার করেছেন সরকার দলীয়রা। তারা বলছেন এ বিষয়ে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করছেন।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে আমাদের এখানে জিনিসপত্রের দাম ২-৩ গুণ বেড়েছে এটা সত্য। মূলত সিন্ডিকেটের কারণেই এই দাম বেড়েছে। রমজান মাসে যে জিনিসপত্রগুলো বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বেশি বেড়েছে। এর মূল কারণ হলো সরকার তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। প্রতিযোগিতা আইন-২০১২ কার্যকর করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। সরকার কেন এই আইনের ব্যবহার করছে না, সরকারের উদ্দেশ্য কী তা পরিষ্কার নয়।'

প্রতিযোগিতা আইন ২০১২- এর শুরুতেই বলা হয়েছে, 'দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করবার, নিশ্চিত ও বজায় রাখবার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ, মনোপলি ও ওলিগপলি অবস্থা, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা বিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।'

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে উল্লেখ করে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, 'সরকার জিডিপি বাড়ার যে দাবি করছে সেই সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম বাড়লে সে দাবি মিথ্যা হয়ে যায়।'

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'কোনো সমস্যা সমাধান করার জন্য তা আগে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের মূল সমস্যা হলো তারা কোনো সমস্যা স্বীকার করতে চায় না। তারা মনে করে সমস্যা স্বীকার করলে মনে হয় এটি তাদের ব্যর্থতার কারণে হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে যাদের সুবিধা হয়, লাভ হয়, তারা সবাই সরকারের ঘনিষ্ঠ। তাই সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না।'

বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এটা বলা এক ধরনের নিষ্ঠুর উপহাস। শুধু ধনীদের আয় বেড়েছে। এই আয় বৃদ্ধি কখনো গড় আয় বৃদ্ধি হতে পারে না। যারা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, তাদের আয় বাড়েনি। বরং নতুন করে দারিদ্র্য সীমার মধ্যে মানুষ প্রবেশ করেছে। সরকার এই বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।'

মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, 'দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষ, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা এমন কি চিকিৎসা খাতেও তাদের বাজেট কমিয়েছে। সরকার উন্নয়নের গল্প বলে এক ধরনের প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে।' 

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যারা আমদানি করে তাদের সংখ্যা একটু কম হওয়ায় তারা একচেটিয়া প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সরবরাহ প্রক্রিয়া সাবলীলভাবে কাজ করে না। অনেকেই যারা যুদ্ধের আগে আমদানি করেছে তারা যুদ্ধের কারণে দাম বাড়বে এই আশায় পণ্য বাজারে ছাড়ছে না। মজুদ করে রাখছে। যার ফলে মাত্রাভেদে অযৌক্তিকভাবে পণ্যের মূল্য বাড়ছে।'

বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের অনেক দুর্বলতা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'বাজার ব্যবস্থাপনায় তদারকির অভাব আছে এবং সরকারের আইনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। এর ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। আমাদের আয় বাড়ছে এই কথার মধ্যে অসত্যতা হলো সবার আয় একভাবে বাড়েনি। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়েনি বরং করোনার কারণে অনেকের আয় কমেছে। শ্রমজীবী এবং নিম্ন আয়ের মানুষ যেসব পণ্য ভোগ করেন সেগুলো মূল্যস্ফীতি ১২-১৪ গুণ। তাদের তো আয় বাড়েনি। এই মূল্যস্ফীতি কিন্তু আগের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যোগ হয়। শুধু পণ্যের মূল্য বাড়লেও কিন্তু সাধারণ মানুষের বাড়ে না।'

তিনি বলেন, 'গড় আয়ের হিসেব করে মাথাপিছু আয়ের যারা তথ্য দেন তাদের প্রশ্ন করা উচিত, একজন রিকশা চালকের কি আয় বেড়েছে বা একজন নিম্নবিত্ত মানুষের কি আয় বেড়েছে? আমাদের আয়ের ও বণ্টনের বৈষম্য আমাদের ক্রয় ক্ষমতাকে দুর্বল করেছে। সরকার অনেক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।'

মানুষের জীবনযাত্রার মান ঠিক রাখতে হলে মূল্যস্তরকে স্থিতিশীল রাখার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'আয় বাড়িয়ে এটা ঠিক রাখা সম্ভব না। কারণ শুধু সরকারি চাকরিজীবীদের আয় বাড়ালেই হবে না। যারা বেসরকারিভাবে বিভিন্ন পেশায় আছেন তাদের তো আর আয় বাড়ে না। এই জায়গাগুলোতে আমাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে। আয় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, সঠিকভাবে বাজার তদারকি করতে হবে এবং মূল্যস্তর ঠিক রাখতে হবে তবেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে।' 

আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, 'যদি কেউ বলে থাকেন, আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের মূল্য অনেক বেশি সেই তথ্যটি বস্তুনিষ্ঠ নয়। বাস্তবতা হল, মালয়েশিয়ায় সয়াবিন বা পামওয়েলের মূল্য আর বাংলাদেশে মূল্য কোনোভাবেই একরকম হবে না। দ্রব্যের প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে পরিবহন, ক্লিয়ারিং, লোড-আনলোড খরচ, বৈধ ব্যাংক চার্জ, হাত বদলের মুনাফা যুক্ত হয়। তাই দাম বেড়ে যায়।'

ষড়যন্ত্র না করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সৎ ও কার্যকর পরামর্শ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'যারা এ ধরনের তথ্য উপস্থাপন করেন তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ষড়যন্ত্র করছেন। অন্য দেশ কেন জয়পুরহাট আর ঢাকার সবজির মূল্য এক নয়। চট্টগ্রাম আর লালমনিরহাটে সয়াবিন তেলের মূল্য এক নয়। এমনকি কারওয়ান বাজার ও তেজতুরি বাজারেও দ্রব্যমূল্য এক নয়।'

Comments

The Daily Star  | English

Cuet students suspend protests

Say authorities assured them of meeting their major demands

2h ago