মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আরও কঠিন হলো

অভিবাসী কর্মীরা কোনো মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা করলে যারা তাদের বিদেশে পাঠিয়েছে সেসব রিক্রুটিং এজেন্টদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্তত এতদিন পর্যন্ত সেটাই হচ্ছিল।
আর্টওয়ার্ক: দিবারাহ মাহবুব

অভিবাসী কর্মীরা কোনো মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা করলে যারা তাদের বিদেশে পাঠিয়েছে সেসব রিক্রুটিং এজেন্টদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্তত এতদিন পর্যন্ত সেটাই হচ্ছিল।

বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে রিক্রুটিং এজেন্টরা ছলচাতুরীর মাধ্যমে শ্রমিকদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়েছেন। দেশের আইন অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধ মানব পাচারের সমতুল্য।

যেমন: পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট গত মাসেই রিক্রুটিং এজেন্সির ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের মধ্যে আছে স্বাধীন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক। জাল নথি ব্যবহার করে বিদেশে কর্মী পাঠানোর মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে, সরকারের একটি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এখন আর পাচারকৃতদের মামলায় রিক্রুটিং এজেন্টদের সরাসরি গ্রেপ্তার করতে পারবে না।

এর পরিবর্তে এ ধরনের মামলাগুলোকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) কাছে আলোচনা ও সালিশের জন্য পাঠাতে হবে। এ দুটি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলেই কেবল পুলিশি প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

এ বিষয়টি দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। তিনি বলেন, 'যখনই অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে এরকম কোনো মামলা আসবে, তখনই বিএমইটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারা সুপারিশ করবে মামলাটি মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের আওতায় পরিচালিত হবে কী না।'

অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোকে এই সিদ্ধান্ত বিস্মিত করেছে। তাদের যুক্তি, মানব পাচার একটি ফৌজদারি অপরাধ এবং একে কোনভাবেই আলোচনা ও সালিশের মাধ্যমে সমাধান করা উচিত নয়।

তারা আশঙ্কা করছেন সরকারের এ সিদ্ধান্ত অপরাধীদের সুরক্ষা দেবে।

গত অক্টোবর মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক বৈঠকের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকের বিস্তারিত

দুইটি সূত্র থেকে দ্য ডেইলি স্টার ওই বৈঠকের অডিও রেকর্ডিং সংগ্রহ করেছে। পরে বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদকরা। তারা ওই ক্লিপের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন।

একটি অডিও ক্লিপে বাংলাদেশ কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলমকে বলতে শোনা যায়, 'এজেন্টদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে পুলিশের স্বপ্রণোদিত হওয়ার কিছু নেই। যাদের বৈধ লাইসেন্স আছে, তাদেরকে কেন কোর্টে ধরে আনতে হবে?'

'ভুক্তভোগীকে জোর করে অথবা প্রতারণার মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হলে (দেশের বাইরে) মানব পাচারের আইন অনুযায়ী তাদের বিচার হবে। কিন্তু যেহেতু এই মানুষরা (অভিবাসী কর্মী) বিদেশে যাওয়ার জন্য টাকা খরচ করেন ও পাসপোর্ট বানান, তাদেরকে জোর করা হচ্ছে না। তারা নিজেরাই যাচ্ছেন। এ কারণে আমরা মনে করি এ ক্ষেত্রে পুলিশের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া অন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেমন: এজেন্টের লাইসেন্স স্থগিত রাখা যেতে পারে', বলেন তিনি।

'কেউ যদি বারবার একই কাজ করেন, তাহলে আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলব। আমাদের উচিত ভুক্তভোগীদের বোঝানো যে কোনো সমস্যায় পড়লে পুলিশের কাছে না গিয়ে আমাদের কাছে আসতে হবে', যোগ করেন তিনি।

শহিদুলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন।

বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলামের বরাত দিয়ে বৈঠকের সূত্রগুলো জানান, তিনি এ ধরনের সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিকে (বায়রা) সুপারিশ করেন।

তিনি বৈঠকে জানান, নির্দেশনা পাওয়া গেলে তা তদন্তকারী সংস্থাদের কাছে পাঠানো হবে।

বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো আরও জানায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা নিশ্চয়তা দেন যে এ ধরনের কোনো ঘটনায় তারা তাৎক্ষনিক উদ্যোগ নেবেন না।

এখানে সমস্যা কোথায়?

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মানব পাচারের মামলার নিষ্পত্তির হার মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। এ অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত এলো।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এতে দোষী ব্যক্তিরা আরও বেশি সুরক্ষা পেতে যাচ্ছেন।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, 'মানব পাচার একটি ফৌজদারি অপরাধ এবং আলোচনা ও সালিশের মাধ্যমে এর সমাধান হওয়া সম্ভব নয়।'

তিনি জানান, শুধুমাত্র কর্মীরা সময়মত তাদের প্রাপ্য টাকা না পেলে সেই সমস্যা সমাধান করার জন্য এটি একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে।

গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ভয়াবহ মানব পাচারের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ভুক্তভোগী শ্রমিকদের বিএমইটির ছাড়পত্র ও ভিসাসহ বৈধ প্রক্রিয়াতেই বিদেশে পাঠানো হয়েছিল।

উম্মে কুলসুম (১৪) ও নদী আখতারকে (১৩) গত বছর সৌদি আরবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তারা দুজনই বৈধ বিএমইটি কার্ডসহ সেখানে গিয়েছিলেন।

কুলসুমকে পাঠিয়েছিল এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, যারা তার পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করে এবং কাগজপত্রে তাকে ২৫ বছর বয়সী হিসেবে দেখায়। নারী কর্মীদের বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম বয়স ২৫ বছর।

নিয়ম অনুযায়ী, অভিবাসন প্রত্যাশী নারীদের বিএমইটিতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং বিএমইটি কার্ড পাওয়ার জন্য যাচাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

কুলসুম ও নদী যখন রিক্রুটিং এজেন্টদের জানায় যে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে,  তারা কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি।

এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের সত্ত্বাধিকারীকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করা হয় এবং এ বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে। বিদেশে নির্যাতনের শিকার অন্যান্য নারীরাও এই এজেন্টের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন।

তবে বিএমইটি এ ধরনের ঘটনায় রিক্রুটিং এজেন্টদের দায়ী মনে করে না। এমনকি, অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাগজেকলমে ২৫ বছর বয়সী দেখিয়ে বিদেশে পাঠালেও তারা নিরপরাধ।

বিএমইটির মহাপরিচালক শহিদুল গত সপ্তাহে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বয়স সংক্রান্ত নথি নিরীক্ষা করার দায়িত্ব পাসপোর্ট কর্তৃপক্ষের, তাদের নয়।

তার মতে, বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে শিশুদের বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না, সেখানে '১৩ থেকে ৩০ এর মধ্যে সব নারীদের দেখতে একইরকম মনে হয়।'

পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই বললেই চলে

গত বছর মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মোট ৫৩৮টি মামলা হয়। এর মধ্যে মাত্র ১৪টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, মাত্র একটি মামলায় দোষীরা শাস্তি পেয়েছেন।

১৩টি মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মোট ২৪ হাজার ৫৪৯ জন মানুষ এ মুহূর্তে মানব পাচারের মামলার সঙ্গে জড়িত আছেন।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর বিভিন্ন দেশ থেকে নির্যাতিত নারীদের উদ্ধার করে আনার জন্য ৬৯ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪৭৩ জন নারীর মরদেহ দেশে এসেছে। তাদের মধ্যে ৫১ জন আত্মহননের পথ বেছে নেন।

সময়ে সময়ে নিয়োগদাতারা আইনি ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে কর্মীদের বিদেশে পাঠিয়েছেন।

কিন্তু এ অভিযোগ মানতে রাজি নয় বায়রা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অডিও রেকর্ডিং অনুযায়ী, বায়রার সাবেক সভাপতি আবুল বাশার অভিবাসী নারী কর্মীদের নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, 'যেসব নারীদের কারণে আমাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাদেরকে মূলত দেশে ফেরাতে চাইছে তাদের স্বামীরা। নিয়োগদাতারা একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে নারীদের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। নারীরা চাইলেই এভাবে ফিরে আসতে পারেন না।'

কাফালাহ ব্যবস্থায়, যদি কোনো নারী কর্মী তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দেশে ফিরে আসেন, তাহলে রিক্রুটিং এজেন্টকে নিয়োগদাতার কাছে বদলী কর্মী পাঠাতে হয় অথবা দুই হাজার ডলার জরিমানা দিতে হয়।

শরীফুল হাসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিয়োগদাতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না দেখে প্রকৃত অপরাধীদেরকেও চিহ্নিত করা যায় না। রিক্রুটিং এজেন্টরা একইভাবে আরেকজন নারী কর্মী জোগাড় করেন এবং তাদেরকেও অত্যাচারের মুখে ঠেলে দেন।'

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতি বছর 'ট্রাফিকিং ইন পার্সন্স রিপোর্ট' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২১ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'মানব পাচার, পাচার-সম্পর্কিত দুর্নীতি, এবং পাচারকারীদের জন্য দায়মুক্তির ক্ষেত্রে সরকারি সম্পৃক্ততা গুরুতর উদ্বেগের বিষয় ছিল, যা বছর জুড়ে আইন প্রয়োগের উদ্যোগকে বাধা দেয়। সরকার এই ধরনের দাবি স্বীকার করতে বা তদন্ত করতে রাজি নয়।'

এতে আরও বলা হয়, 'পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ করেছেন যে জেলা কর্মসংস্থান এবং জনশক্তি অফিসের কিছু কর্মকর্তা মানব পাচারে সহায়তা করেছেন এবং পল্লী এলাকায় কিছু পাচারকারীদের রাজনৈতিক সংযোগ রয়েছে যা তাদের দায়মুক্ত থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সহায়তা করেছে।'

এতে আরও বলা হয়, কিছু সরকারি কর্মকর্তা এ ধরনের রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থের দ্বন্দ্বে ভোগেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধিরা আরও দাবি জানান, পাচারকারীদের পরিবর্তে যেসব নিয়োগদাতা কর্মীদের ওপর অত্যাচার করছেন, তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এবং কালো তালিকাভুক্ত করতে।

২০১৯ সালের মার্চ মাসে সৌদি আরবে আবিরন বেগম নামের এক বাংলাদেশি গৃহকর্মীকে হত্যা করা হয়। এ পর্যন্ত কেবল এই ঘটনা একজন সৌদি নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই রায় দেওয়া হয়।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Why planting as many trees as possible may not be the solution to the climate crisis

The heatwave currently searing Bangladesh has led to renewed focus on reforestation efforts. On social media, calls to take up tree-planting drives, and even take on the challenge of creating a world record for planting trees are being peddled

18m ago