বিমর্ষ ঈদ রানা প্লাজায় নিহতদের সন্তানদের!

ঈদের দিনে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহতদের সন্তানরা। তাদের কারো বাবা নেই, কারো আবার বাবা-মা কেউই নেই। ঈদে যাওয়ার জায়গা নেই অনেকের। 
গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় অর্কা হোমসে থেকে পড়াশোনা করছেন রানা প্লাজা ধসে গার্মেন্টস কর্মীদের সন্তানদের ৩৮ জন। ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

ঈদের দিনে স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহতদের সন্তানরা। তাদের কারো বাবা নেই, কারো আবার বাবা-মা কেউই নেই। ঈদে যাওয়ার জায়গা নেই অনেকের। 

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে নিহত হন ১ হাজার ১৩৬ জন এবং আহত হন আরও  ২ হাজার ৪৩৮ জন গার্মেন্টস কর্মী। নিহত গার্মেন্টস কর্মীদের সন্তানদের মধ্যে ৬-১৮ বছর বয়সী ২৬ জন ছেলেশিশু ও ১২ জন মেয়েশিশু আশ্রয় পেয়েছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় অর্কা (ওআরসিএ) হোমসে।

রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন অর্কা বা দ্য ওল্ড রাজশাহী ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন এই অর্কা হোমস পরিচালনা করেন। ২০১৪ সালে গার্মেন্টস মালিকদের প্রতিষ্ঠান বিজেএমইএ'র মাধ্যমে রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ৫৬ জন শিশুকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে আনা হয় এখানে।

সম্প্রতি সরেজমিনে অর্কা হোমসে গিয়ে কথা হয় বর্তমানে সেখানে অবস্থানরত ৩৮ শিশুর সঙ্গে। জানা হয়, মা-বাবা ছাড়া কীভাবে সেখানে তাদের ঈদ কাটে।

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামের তাহমিনা আক্তার বীথির (১২) মা রওশন আরা বেগম কাজ করতেন রানা প্লাজার ৬ তলায়। ঘটনার দিন ২৪ এপ্রিল জীবন বাঁচাতে ৬ তলা থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি। বুকে আঘাত পেয়ে পঙ্গু হয়ে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি।

বীথি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এর মধ্যে মা মারা গেলেন। মা মারা যাওয়ার আগেই আমি এখানে আসি। মাকে ছাড়া জীবনে প্রথম ঈদ গেল ২০২০ সালে। বাবা-মাকে ছাড়া ঈদের দিন খুব বিমর্ষ কেটেছে আমার।'

রংপুরের বদরগঞ্জের মোকছেদপুর গ্রামের সাগরিকা আক্তার মীমের (১৭) মা জাহানারা আক্তার কাজ করতেন রানা প্লাজার ৮ তলায়। দুর্ঘটনার দিনে মীমরা খুঁজে পায়নি মায়ের মরদেহ। পরে ডিএনএ পরীক্ষার পরে মেলে মায়ের মরদেহের খবর। জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় জাহানারার মরদেহ।

মীম জানান, মায়ের মরদেহ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার ও তার স্বজনদের। কাজে যোগ দেওয়ার ৯ দিনের মাথায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে।

অর্কা হোমসে থেকে মীম ১০ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। সঙ্গে থাকছে ছোট ভাই সাগর হাসান। সে অর্কা হোমসে ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা আর একটা বিয়ে করে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। অর্কা হোমস ছুটি না হলে সাধারণত মীমরা বাড়িতে যান না।

মীম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন মা ছিলেন, আমাদের শৈশবটা ছিল খুব আনন্দের। এখন মা নেই। মাকে খুব মিস করি। ঈদের দিন শুধু চোখের পানিতে কাটে।'

ছবি: মোস্তফা সবুজ/স্টার

মো. আল আমিন ইসলাম (১৭) অর্কা হোমসে আসে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। এখন সে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাড়ি তাদের রংপুরের অভিরামপুর গ্রামে। আল আমিনের জন্মের ২ মাস আগেই তার বাবা নূর হোসেন মারা যান। ছোট আল-আমিনকে নিয়ে কাজের খোঁজে সাভারে পাড়ি জমান মা ফাতেমা বেগম। কাজ পান রানা প্লাজায়। ২৪ এপ্রিল দুর্ঘটনায় ফাতেমা নিহত হন।

আল আমিন বলেন, 'মা যখন বেঁচে ছিলেন ঈদের আগে মায়ের কাছে নানা বায়না করতাম। মা নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতেন। ঈদের দিন বিভিন্ন জায়গায় মায়ের সঙ্গে ঘুরতাম। এখন মা নেই ঈদের দিন নানা-নানীর বাড়ি যাই। ঈদের দিনে মায়ের অনুপস্থিতি খুব কষ্ট দেয়। মাকে ছাড়া একা একা ঘুরে বেড়াই।'

রানা প্লাজা ধসের দিন মো. স্বপন ইসলামের (১৬) মা ফিরোজা খাতুন নিহত হন।

স্বপন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার জন্মের দেড় বছর পর বাবা আনারুল ইসলাম মারা যান। পরে সংসারের অভাব-অনটন মেটাতে মা গার্মেন্টসে কাজ নিতে বাধ্য হন। যেদিন রানা প্লাজার দুর্ঘটনা ঘটে তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। রানা প্লাজা কী তখনো আমি বুঝতাম না। আমি তখন নানা-নানীর সঙ্গে বাড়িতে ছিলাম। পরে টিভিতে দেখি রানা প্লাজার ঘটনা।'

'মা মারা যাওয়ার পরে আমার লেখা-পড়ার দায়িত্ব কেউ নিতে চায়নি। ২০১৫ সালে আমি অর্কা হোমসে আসি,' বলেন স্বপন।

স্বপনদের গ্রামের বাড়ি পাবনার ঈশ্বরদীর মাড়মী গ্রামে। ছোটবেলার ঈদের কথা স্মরণ করে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঈদের দিন মা আদর করে মুখে ভাত তুলে খাওয়াতেন। এখানে অনেকের মা আসেন। সন্তানরা মা বলে ডাকেন। কিন্তু আমার তো মা ডাকার কেউ নেই। ঈদের দিন কেউ আর আমাকে আদর করে মুখে ভাত তুলে দেয় না।'

অর্কা হোমসের পরিচালক জাহিদুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে নিহত এবং আহতদের ছেলে-মেয়েরা অর্কা হোমসে সব ধরনের সুবিধা নিয়ে এখানে লেখাপড়া করছে। মূলত বিজেএমইএ'র মাধ্যমে তাদেরকে এখানে আনা হয়েছে।'

তিনি জানান, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে ২০১৪ সালে মোসলেম একাডেমিতে এই অর্কা হোমস প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের আর্থিক সহায়তায় এবং বিজেএমইএ'র কিছু সহায়তার মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Why planting as many trees as possible may not be the solution to the climate crisis

The heatwave currently searing Bangladesh has led to renewed focus on reforestation efforts. On social media, calls to take up tree-planting drives, and even take on the challenge of creating a world record for planting trees are being peddled

43m ago