ফুরিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের মজুদ, ১০ বছর পর কী হবে জানে না কেউ

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র কৈলাশটিলা থেকে ২০১৬ সালে প্রতিদিন প্রায় ৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেটা নেমে এসেছে ২৯ মিলিয়ন ঘনফুটে।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র কৈলাশটিলা থেকে ২০১৬ সালে প্রতিদিন প্রায় ৬৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেটা নেমে এসেছে ২৯ মিলিয়ন ঘনফুটে।

১৯৬২ সালে আবিষ্কৃত এই গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। মোট ৭টি কূপের ৫টি থেকেই এখন গ্যাস উত্তোলন বন্ধ আছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই ৫টি কূপের তিনটির উৎপাদন আগেই বন্ধ হয়েছে। গত বছর দুটো কূপে গ্যাসের বদলে পানি আসায় বন্ধ করা হয়েছে।

কিন্তু এই দুটি কূপ থেকে পানি ওঠাকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন 'অস্বাভাবিক'। কর্তৃপক্ষের তালিকাতেও কূপ দুটো 'সম্ভাবনাময়'। তবে কেন সেখানে পানি আসছে, সেটা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।

দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া অবশ্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বর্তমানে ২০টি গ্যাসক্ষেত্রের বেশিরভাগ থেকেই আগের তুলনায় কম গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে।

সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের হাইড্রোকার্বন ইউনিট থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, মাত্র ৪টি গ্যাসক্ষেত্রে আগের চেয়ে বেশি উৎপাদন হচ্ছে।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানায় প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ২৬টি কূপের মধ্যে চলতি মাসের শুরুতে ৬টির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়।

রমজানের প্রথম দিন থেকেই প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শহরের গ্রাহকেরা গ্যাসের ঘাটতিতে পড়েন বা স্বল্পচাপ অনুভব করেন।

হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৩টি এবং ২টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অধীন পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২০২১ সালে প্রতিদিন ২ হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়। অথচ ২০১৬ সালে দেশে প্রতিদিন ২ হাজার ৬৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হতো।

এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্য বলছে, দেশে মাত্র ৯-১০ বছর ব্যবহারের জন্য গ্যাস মজুদ আছে।
দেশের বার্ষিক গ্যাস ব্যবহার প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৮টি গ্যাসক্ষেত্রের মোট প্রামাণিক মজুদের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট, যা থেকে চলতি মাস পর্যন্ত ১৯ দশমিক ১১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে।

দেশের গ্যাস মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সারসহ অন্যান্য শিল্প কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এবং বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়।

সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে কোনো গ্যাসক্ষেত্র বা কূপের ধারণক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায় এবং এটা স্বাভাবিক।'

'আমাদের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নয়ন কাজ চলছে। তবে কেন কৈলাশটিলার দুটি সম্ভাবনাময় কূপ থেকে উৎপাদন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, সেটি পরীক্ষা না করে বলার উপায় নেই।'

তিনি বলেন, এই পরীক্ষা করানোর অনুমোদনের জন্য প্রকল্প নেওয়ার আবেদন করা হয়েছে, যেটার অনুমোদন একটু দীর্ঘ প্রক্রিয়া।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়া দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয়। তারা নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র ও কূপের জন্য জোরেশোরে অনুসন্ধান চালানোর কথা বলছেন।

তাদের মতে, সরকার সঠিকভাবে গ্যাস অনুসন্ধান চালায়নি। তাই এখনো অনেক জায়গায় গ্যাসক্ষেত্র অনাবিষ্কৃত থাকতে পারে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক শামসুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা সত্য যে গ্যাসক্ষেত্রের মজুত ধীরে ধীরে কমে যায়। একে "ন্যাচারাল ডিফিউশন" বলে। এটা খনির ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, গঠন এবং প্রযুক্তিগত রক্ষণাবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে।'
তিনি বলেন, 'কূপ সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে আরও বেশি গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। বেশিরভাগ গ্যাসক্ষেত্রেই তা করা হয়নি। আমরা এমনও দেখেছি যে পরিত্যক্ত ঘোষণা দেওয়া কূপেও পরবর্তীতে গ্যাস পাওয়া গেছে।'

শামসুল আলম জানান, সরকার পরামর্শক নিয়োগ করে ২০১১ সালে 'গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে পরামর্শ' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। কিন্তু সেই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোও তারা মানেনি।

সুপারিশে বর্তমান কূপগুলো রক্ষণাবেক্ষণ বা ওভারহলিং, সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারে রিস্ক-বেজড পদ্ধতির ওপর জোর দিতে বলা হয়েছিল। উপকূলীয় অঞ্চল এবং পার্বত্য অঞ্চলে গ্যাসের অনুসন্ধানের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) একজন সদস্যও তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের এই সদস্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কমপক্ষে ৪০টি কূপের ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং সেগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০০-৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু সরকার তা করেনি।'

'২০১১ সালের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে,' বলেন তিনি।
অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, 'নতুন কূপ অনুসন্ধানে বিনিয়োগের চেয়ে সরকার তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে বেশি মনোযোগ দিয়েছে।'

'মনে হচ্ছে আমরা গ্যাস অনুসন্ধান করতে চাই না, বরং উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানি করে গ্যাস সংকট কাটিয়ে উঠতে চাই,' বলেন তিনি।
তিনি উদাহরণ হিসেবে বলেন, 'হবিগঞ্জের রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৯ নম্বর কূপটি ২০১৬ সাল থেকে উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু এখনও সেটি চালু হয়নি।'

ভোলা ও ছাতক (পূর্ব) গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখনও গ্যাস উত্তোলন না করায় সরকারের সমালোচনা করে শামসুল আলম বলেন, 'অনুসন্ধান খাতে বর্তমান সরকারের কোনো অর্জন' নেই।

'আমরা এখনো ১৯৯৬ সালে সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলোর ফল ভোগ করছি,' বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বদরুল ইমামও বলেছেন যে প্রতিটি গ্যাসক্ষেত্র তার সর্বোচ্চ উৎপাদনের একটা সীমায় উঠার পর ধীরে ধীরে উৎপাদন কমতে শুরু করে।

তিনি বলেন, 'আমরা এখন সেরকমই একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন অধিকাংশ গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন কমে গেছে। তবে এটাও আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশে এখনো সব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি।'

তিনি বলেন, 'সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ২০ বছরে মাত্র ২৮টি অনুসন্ধানী কূপ খনন করেছে। হাইড্রোকার্বন থাকার সমূহ সম্ভাবনা আছে, এমন একটি দেশের জন্য এই সংখ্যাটি খুবই কম।'

'আমাদের দেশে প্রতি ৩টি কূপ খনন করলে ১টিতে গ্যাস পাওয়া যায়। যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের গড় প্রতি ৫টিতে ১টি,' যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আমাদের অন্তত ৪০টি পরিত্যক্ত কূপ আছে। আমরা যদি সেগুলো ওভারহল করার জন্য বিনিয়োগ করি, তবে আমরা সেগুলোর অবশিষ্টাংশ গ্যাস উৎপাদন করতে পারব এবং এলএনজি আমদানি কিছুটা হলেও কমাতে পারব।'

তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রকল্প নেওয়া উচিত।'

দুটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, বাংলাদেশের মাটির নিচে অন্তত ৩২ ও ৪২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আছে। এ তথ্যের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এই গ্যাসের বিষয়ে সরকারকে জোর অনুসন্ধান চালাতে হবে।'

'যা আমরা সহজে খুঁজে পাই, আমরা সে ধরনের অনুসন্ধানই চালিয়েছি। কিন্তু যেটা একটু কঠিন বা অনুসন্ধানের দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়, সেটা আমরা এখনো শুরুই করিনি,' বলেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, অনুসন্ধান কার্যক্রম পেট্রোবাংলার অধীনে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) একটি নিয়মিত কাজ।

তিনি বলেন, 'ভবিষ্যতে কূপ খননে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। এতে যদি গ্যাস পাওয়া যায়, তবে সেটা তো আমাদের জন্যই ভালো।'

সরকার অনুসন্ধানের চেয়ে আমদানিতে বেশি আগ্রহী, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'যারা এ ধরনের মন্তব্য করেন, আমরা তাদেরকে খনন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাতে পারি।'

'আজকে একটা কূপ খনন করলে কালকেই গ্যাস পাব, বিষয়টা তো এমন না। কিন্তু দেশে গ্যাসের চাহিদা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সেই চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই,' বলেন তিনি।

সমুদ্রে অনুসন্ধান

বিশেষজ্ঞরা জানান, ১৯৭৪ সাল থেকে দেশের সমুদ্র এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হলেও ওই সময়ের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো বড় কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়নি।
২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপের একটি প্রক্রিয়া শুরু করলেও, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সেটি আটকে আছে।

কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির নিচে খনিজ অনুসন্ধানে মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপ একটি মৌলিক কাজ।

২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা জরিপটি পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু জ্বালানি মন্ত্রণালয় তা বাতিল করে পরের বছর নতুন করে দরপত্র দেয়।
দুইবারই নরওয়ের টিজিএস এবং যুক্তরাষ্ট্রের শ্লামবার্জারের একটি যৌথ কনসোর্টিয়াম এতে নির্বাচিত হয়।

কিন্তু সেই দরপত্রের কার্যাদেশ হয় আরও ৩ বছর পর ২০২০ সালের মার্চ মাসে। তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের নভেম্বরে জরিপকাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, তা হয়নি।

সম্প্রতি একটি কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী দাবি করেছেন যে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান চালানো ভবিষ্যতে আর সম্ভব হবে না।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন উল্টো কথা। তাদের মতে, কর্তৃপক্ষ অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার কাজগুলো ঠিকঠাক করছে না।

'এটা তো দেশের বিরুদ্ধে এক ধরনের ষড়যন্ত্র' মন্তব্য করে অধ্যাপক বদরুল ইমাম প্রশ্ন করেন, 'আমরা ২০১৪-১৫ সালে যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলাম, তার কাজ এখনো শুরু হয়নি কেন?'

নসরুল হামিদ জানান, সমুদ্রে অনুসন্ধানের বিষয়ে তিনি এখনই কিছু বলতে পারছেন না।

তিনি বলেন, 'সমুদ্রে কী পরিমাণ গ্যাস আছে, তা জানতে আমাদের আরও অন্তত ১০ বছর সময় লাগবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Dos and Don’ts during a heatwave

As people are struggling, the Met office issued a heatwave warning for the country for the next five days

1h ago