নির্বাচন

নির্বাচন বিমুখতা বাড়াচ্ছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ীর সংখ্যা

স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে একের পর এক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতাকে গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ও ‍সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে একের পর এক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতাকে গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষক ও ‍সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

তারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল যেমনই হোক না কেন আগে এই নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা প্রচুর উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে অংশ নিতেন। কিন্তু এখন ধরেই নেয়া হচ্ছে, সরকারি দলের টিকিটে যিনি নির্বাচনে অংশ নেবেন, তিনিই জিতবেন। ফলে ভোটার ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ভোটপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি ইতোমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে না পারার জন্য তারা নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে বলেই ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কেন একজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করছেন, সেটা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এতজন জয়ী হওয়াটা প্রমাণ করে মানুষ নির্বাচন বিমুখ।

তিনি বলেন, 'সকল রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি একটি অশনি সংকেতের মতো। আমরা চাই সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হোক। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারি না, যার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করার সিদ্ধান্তও অন্তর্ভুক্ত।'

আজ দেশের ১৬০টি ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) হওয়া নির্বাচনটি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়ার একটি ভালো উদাহরণ হতে পারে।

ইউপি নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের ভোটগ্রহণ চলছে, যেটি মহামারির কারণে এতদিন স্থগিত ছিল।

নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৬০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৫টিতে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন, যার অর্থ প্রায় ২৯ শতাংশ চেয়ারম্যান কোনো ধরনের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছেন।

৪৫ জনের মধ্যে ৩৮ জনই বাগেরহাটের প্রার্থী। তাদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী, জানিয়েছেন আমাদের বাগেরহাট সংবাদদাতা।

জেলার ৬৫টি ইউনিয়ন পরিষদের ভোটগ্রহণ হলো আজ। বাকি ২৭টি ইউপিতে বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ভিন্নমতাবলম্বী বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।

৯টি পৌরসভা নির্বাচনে আজ ভোটগ্রহণ হয়েছে। এর মধ্যে ৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

প্রথম পর্যায়ের ইউপি নির্বাচনের আগের অংশেও একই চিত্র দেখা গেছে। ২০৪ ইউপিতে ২১ জুন ভোটগ্রহণ হয়েছে। তখন ২৮ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।

এছাড়াও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভোটারদের উপস্থিতিও কমেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষ বিশ্বাস করছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয় অনিবার্য।

৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিলেট-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে মাত্র ৩৪ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখা যায়। ২০২০ সালের ২১ মার্চে অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ উপ-নির্বাচনের চিত্র আরও করুণ ছিল, কারণ ওই নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, 'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে কারণ অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীই নির্বাচনে জিতবে ধরে নিয়ে অংশগ্রহণে উৎসাহ পাচ্ছে না।'

তিনি জানান, ভোটাররা মনে করছে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সময় ও অর্থের অপচয়।

'বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়' নির্বাচিত হওয়ার ধারাটি শুধুমাত্র স্থানীয় নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ নেই। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাতীয় সংসদের দুই জন সংসদ সদস্যও উপ-নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং আরও একজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত কুমিল্লা-৭ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, কারণ ওই আসনের উপ-নির্বাচন থেকে অন্য সব প্রার্থী ইতোমধ্যে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।

কুমিল্লার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা দুলাল তালুকদার গত শনিবার দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী মনিরুল ইসলাম তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এই মুহূর্তে এই আসন থেকে সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়ে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত অধ্যাপক প্রাণ গোপাল।

এর আগে বৃহস্পতিবারে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী লুৎফর রেজা তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।

ন্যাপ প্রার্থী মনিরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান পারিবারিক কারণে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। লুৎফর রেজার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

এই আসনের সংসদ সদস্য আলী আশরাফ ৩০ জুলাই ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর আসনটি খালি হয়ে যায়। অক্টোবরের ৭ তারিখে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারিত হয়।

২৬ জুন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আগা খান মিন্টু (ঢাকা-১৪) ও আবুল হাশেম খান (কুমিল্লা-৫) তাদের নিজ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

ঢাকা-১৪ আসনের তিন প্রার্থী, জাতীয় পার্টির মোস্তাকুর রহমান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) আবু হানিফ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের এ ওয়াই এম কামরুল ইসলাম তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন।

রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, তিন জন প্রার্থীই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস মহামারির কথা উল্লেখ করেছেন।

কুমিল্লা-৫ আসনের উপ-নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জসীম উদ্দিন তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন।

দুটি উপ-নির্বাচনই ২৮ জুলাইতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

দলের 'গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের' অভিযোগ তুলে জাতীয় পার্টি লুৎফর রেজা ও জসীম উদ্দিন দুজনকেই বহিষ্কার করেছে জাতীয় পার্টি।

তবে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, দুজন নেতাই টাকার বিনিময়ে নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন।

জাতীয় পার্টির সভাপতি জি এম কাদের গতকাল বলেন, 'টাকার বিনিময়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। কিন্তু তারা জানিয়েছেন বিভিন্ন মহলের চাপে তারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছেন।'

তিনি জানান, দল থেকে নেতা ও কর্মীদের প্রতি নির্দেশ ছিল নির্বাচনী দৌড়ে শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত থাকার।

'আমরা নির্বাচনকে অর্থবহ করতে চাচ্ছি। আমরা একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমও পর্যবেক্ষণ করছি, যেহেতু প্রার্থীদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার দায়িত্ব তাদের', বলেন কাদের।

২০১৯ সালের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে ৪৫৬টি উপজেলায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৯৪ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তাদের মধ্যে ৯৩ জনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত।

২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন, যা একটি নজিরবিহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

উপরে উল্লেখ করা বেশিরভাগ নির্বাচনের ক্ষেত্রেই বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করেছে। কারণ হিসেবে তারা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সম্ভাবনা না থাকার কথা জানান।

ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ এর মধ্যে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নেন। তারপরও, ২৩০টি পৌরসভা নির্বাচনে ১০ জন মেয়র প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।

২০১৯ সালের মে মাসে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ইকরামুল হক টিটু বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ময়মনসিংহের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন।

স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ জানান, সার্বিকভাবে, ভোটার ও প্রার্থী, উভয়ের ক্ষেত্রেই সব ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমেছে।

তিনি বলেন, 'তারা মনে করেন নির্বাচনের ফল আগে থেকেই নির্ধারণ করা আছে।'

তিনি আরও বলেন, 'দেশে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চলছে। ভোটদান প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। রাজনীতি এখন একটি লাভজনক ব্যবসা, আর এ কারণে সেখানে গণতন্ত্রের কোনো স্থান নেই।'

তবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কোনো ধরনের যোগসূত্র নেই।

তিনি বলেন, 'এটি খুবই দুঃখজনক যে অনেক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। আরও দুঃখজনক যে, প্রার্থী হওয়ার পরও অনেকে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন।'

কমিশন সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনার জন্য কী উদ্যোগ নিয়েছে জানতে চাওয়া হলে রফিকুল উত্তর দেন, 'যদি কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিতে না চায়, সেক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি?'

Comments

The Daily Star  | English

Student politics, Buet and ‘Smart Bangladesh’

General students of Buet have been vehemently opposing the reintroduction of student politics on their campus, the reasons for which are powerful, painful, and obvious.

15m ago