মুচলেকা নিয়ে দায়মুক্ত হাসেম ফুডস!
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত প্রত্যেক কর্মীর বিপরীতে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে হাসেম ফুডস লিমিটেড আর কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হওয়া থেকে নিজেদের দায়মুক্ত করেছে।
হাসেম ফুডস প্রত্যেক নিহত কর্মীর পরিবারকে দুই লাখ টাকা দেওয়ার সময় একটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে তারা (মৃত ব্যক্তির পরিবার) ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে আর কোনো ধরনের দাবি জানাতে পারবে না।
এই প্রতিবেদক মুচলেকার একটি কপি সংগ্রহ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় আমাদের হাসেম ফুডস লিমিটেড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো দাবি-দাওয়া অবশিষ্ট নেই।
মুচলেকায় আরও উল্লেখ আছে, 'উক্ত টাকা আমি সাক্ষীদের সহায়তায় নিহতের সব উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আইন অনুযায়ী বণ্টন করতে বাধ্য থাকব। এ ক্ষেত্রে কোনো দাবি উত্থাপিত হলে আমি নিজ দায়িত্বে তা সমাধানে বাধ্য থাকব।'
৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠানটির একটি কারখানায় আগুন ছড়িয়ে পড়লে কমপক্ষে ৫৪ জন শ্রমিক নিহত হন। ভবনটির চতুর্থ তলা থেকে বের হয়ে আসার একমাত্র গেটটি বন্ধ থাকায় ৪৮ জন সেখানেই জ্যান্ত পুড়ে মারা যান।
শ্রম আইন অনুযায়ী নিয়োগকর্তা কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনায় দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তবে ইতোমধ্যে চারটি মানবাধিকার সংস্থা গত ১১ জুলাই হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে প্রত্যেক কর্মীর পরিবারের জন্য পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) ও সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস)। হাইকোর্ট এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি।
মাহতাব উদ্দিন আহমেদ ও আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠান দৃকের একটি দল হতাহতদের পরিবারদের ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন।
মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমরা কর্মীদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তারা সবাই টাকা নেওয়ার আগে মুচলেকায় স্বাক্ষর করেছেন।'
মাহতাব বলেন, 'তবে কাগজে কী লেখা ছিল, তা সবাই পড়তে পারেনি। অল্প যে কয়জনের কাছে স্মার্টফোন ছিল, তারা কাগজের ছবি তুলে পরে আমাদের দিয়েছে।'
উদাহরণস্বরূপ, ৪৪ বছর বয়সী শাহানার স্বামী মাহতাব উদ্দীন গবেষকদের জানান, তিনি জানেন না যে কী ধরনের কাগজে স্বাক্ষর করেছেন এবং কেউ তাকে মুচলেকার বক্তব্য পড়েও শোনায়নি। গবেষকরা যখন জানতে চান কেন তিনি না পড়েই কাগজটিতে স্বাক্ষর করেছেন, তখন তিনি পড়তে না জানার কথা বলেন।
মাহতাব উদ্দীন বলেন, 'অনেক জায়গায় আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র চাওয়া হয়েছে এবং আমরা সেটা দিয়েছি। কীভাবে আমরা না করব?'
দুর্ঘটনায় নিহত ৩৫ বছর বয়সী কর্মী নাজমার ভাই ফারুক তার পরিবারের পক্ষ থেকে টাকা গ্রহণ করেছেন। তিনি ইংরেজিতে লেখা একটি কাগজে স্বাক্ষর করেছেন বলে জানান গবেষকদের।
গবেষকরা ফারুকের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, 'আমি ইংরেজি বুঝি না, তাই কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলাম কাগজে কী লেখা আছে। তারা জানালেন, সেখানে লেখা আছে আমি ক্ষতিপূরণ পাচ্ছি।'
ওই আগুনের ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য গঠিত নাগরিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্মীদের (পরিবার/প্রতিনিধিদের) মুচলেকায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়, যাতে তারা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবিষ্যতে আর কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণের দাবি না জানাতে পারেন।
নাগরিক তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া জানান, এ ধরনের মুচলেকায় স্বাক্ষর করানো অবৈধ।
জাস্টিস ফর অল নাউ-এর (জেএএনও) সমন্বয়কারী তাকবির হুদা এ প্রসঙ্গে বলেন, 'এই মুচলেকা ও দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ভুক্তভোগীদের পরিবারকে ভবিষ্যতে আর কোনো ধরনের দাবি জানানোর অধিকারকে ঢালাওভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করানো আমাদের দেশের শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে থাকা ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার একটি বড় উদাহরণ।'
তাকবির বলেন, 'এটি একইসঙ্গে শ্রম অধিকার ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন, কারণ ভুক্তভোগীরা আরও বেশ কয়েক ধরনের ক্ষতিপূরণের দাবিদার হতে পারেন, যেমন: বকেয়া বেতন, গ্রুপ বীমা স্কিম থেকে পাওয়া ক্ষতিপূরণ এবং ১১ জুলাই চারটি এনজিওর দেওয়া রিট পিটিশনের বিপরীতে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য পাঁচ কোটি টাকার দাবি ইত্যাদি।'
সজীব গ্রুপের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটস) কাজী আবদুর রহমান বলেন, 'মুচলেকা নেওয়ার মানে এই না যে কর্মীরা দাবি জানাতে পারবেন না।'
তিনি বলেন, 'তারা সারাক্ষণই বিভিন্ন রকম দাবি জানাচ্ছেন এবং আমরা সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছি।'
তাকে আদালতে দায়ের করা ক্ষতিপূরণের আইনগত দাবি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানানোর আশ্বাস দেন।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'আমরা এই দুই লাখ টাকাকে দান হিসেবে বিবেচনা করছি। ক্ষতিপূরণের বিষয়টির এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'রানা প্লাজার মামলায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য হাইকোর্ট একটি কমিটি গঠন করেছিলেন এবং কমিটির সদস্যরা প্রতিটি দাবির বিপরীতে ১৭ থেকে ২৫ লাখ টাকা করে দেওয়ার সুপারিশ করেন। মামলাটি এখনও হাইকোর্টে বিচারাধীন আছে।'
তাকবির বলেন, 'সজীব গ্রুপ তাদের কারখানায় অগ্নি দুর্ঘটনায় নিহত কর্মীদের মাথাপিছু মাত্র দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মধ্যে তাদের দায়বদ্ধতাকে সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে, কারণ সুনির্দিষ্টভাবে দেশের বর্তমান শ্রম আইন শিল্প প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত "দুর্ঘটনায়" নিহতদের জীবনের দাম হিসেবে ঠিক এতটুকুই নির্ধারণ করেছে।'
প্রতিবেদনটি অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments