তামাকের বিষাক্ত মায়ায় কৃষক

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভাদাই গ্রামের কৃষক নরেন চন্দ্র গেল বছরের তুলনায় চলতি বছর আরও ২ বিঘা বেশি জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি নিয়েছেন। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার এই কৃষক ২৪ বছর আগে তামাক কোম্পানির প্রলোভনে ২ বিঘা জমিতে তামাক চাষ শুরু করেছিলেন। এখন তিনি ১২-১৩ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন।
ছবি: সংগৃহীত

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভাদাই গ্রামের কৃষক নরেন চন্দ্র গেল বছরের তুলনায় চলতি বছর আরও ২ বিঘা বেশি জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি নিয়েছেন। লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার এই কৃষক ২৪ বছর আগে তামাক কোম্পানির প্রলোভনে ২ বিঘা জমিতে তামাক চাষ শুরু করেছিলেন। এখন তিনি ১২-১৩ বিঘা জমিতে তামাক চাষ করছেন।

তার মতে, তামাক চাষ করে লাভবান হয়েছেন তিনি, সংসারেও স্বচ্ছলতা এসেছে।

তামাক মাটি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও কেন তামাক চাষ করছেন জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, তামাক কোম্পানি তাদেরকে বিনামুল্যে বীজ, সার, কীটনাশক দিয়ে থাকে। সেচের পানি সরবরাহের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়। কোম্পানির লোকজন নিয়মিত তামাকখেতে এসে খোঁজখবর রাখেন ও পরামর্শ দেন। নির্ধারিত দামে তামাকপাতা কিনে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হয়।

তিনি বলেন, 'তামাক কোম্পানি চাষিদের অনেক উপকারে আসে। আমাদের বিপদে আপদে তারা এগিয়ে আসে।'

লালমনিরহাট সদর উপজেলার শিবরাম গ্রামে তামাক কোম্পানির সহায়তায় ৪০০ কৃষক একসঙ্গে তামাকের বীজতলা প্রস্তুত করেছেন বলে জানিয়েছেন কৃষক জহুরুল হক। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি জানান, কৃষকরা যেহেতু তামাকপাতা বিক্রি করে লাভবান হয়ে থাকেন সেজন্য তামাক চাষের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি।

তিনি বলেন, 'তামাকচাষে পরিশ্রম আছে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে পরিশ্রম করতে হয়। তবে তামাকপাতা বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই, তাই নির্ভয়ে তামাকচাষ করা যায়।'

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাটে গেল বছর ২০২০-এ তামাক চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে, ২০১৯-এ হয়েছে ৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর, ২০১৮-এ হয়ে্ছে ৯ হাজার ১০০ হেক্টর, ২০১৭-এ হয়েছে ৪ হাজার ৫০ হেক্টর, ২০১৬-এ হয়েছে ৯ হাজার ২২০ হেক্টর এবং ২০১৫-এ হয়েছে ১১ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে।

তবে অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালিয়েন্স (আত্মা)'র সদস্য খোরশেদ আলমের দাবি, কৃষি বিভাগ তামাক চাষে যে পরিমাণ জমি রেকর্ড দেখান বাস্তবে এর দ্বিগুন জমিতে তামাক চাষ হয়ে থাকে। কৃষি বিভাগ থেকে তেমন কোনো সচেতনতামূলক প্রচারনা না থাকায় কৃষকরা তামাক চাষ থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। বরং প্রতিবছর নতুন নতুন চাষি তামাক চাষে যুক্ত হচ্ছেন।

মাঠ পর্যায়ে তামাক কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য বন্ধ হলে কৃষকরা আস্তে আস্তে তামাক চাষ থেকে ফিরে আসবে। জেলার প্রায় ৩৪-৩৫ হাজার কৃষক তামাক কোম্পানির ফাঁদে আটকে তামাক চাষ করছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর দিকটি উল্লেখ করে তামাক চাষ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন সচেতন কৃষকরা।

কৃষক সুবল চন্দ্র জানান, ৮ বিঘা জমিতে নানা জাতের সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন তিনি। এই কৃষকের মতে, তামাকের চেয়ে সবজি চাষে লাভ বেশি।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'সবজি চাষ করে আমি গর্বিত। সবজি চাষে জমির উর্বরতা বাড়ে, পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক থাকে। এতে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয়না। এখন সবজি চাষে প্রচুর লাভও করা যায়।'

'তামাক চাষিরা আমাদের মতো গর্ববোধ করতে পারেন না। শুধু তামাক কোম্পানির বিষাক্তমায়া জালে আটকে থাকার কারণে অনেক কৃষক তামাক চাষ নিয়ে মেতে রয়েছেন,' বলেন তিনি।

আরেক কৃষক আতিয়ার রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তামাক চাষ ক্ষতিকর, আমরা সেটা জানি। তামাক চাষের কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যাচ্ছে এবং তামাক চাষের জমিতে অন্য ফসলের আশানুরুপ ফলন আসছে না। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচের পানির জন্য সহায়তা না করলে, তামাক পাতার দাম পুর্বনির্ধারিত না করলে এবং কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ সহায়তা না দিলে কোনো কৃষকই তামাক চাষ করতো না।'

'আমি চাই তামাক চাষ বন্ধ হোক। ফিরে আসুক মাটির প্রাণ আর বেঁচে থাক সুস্থ পরিবেশ,' বলেন তিনি।

এ বিষয়ে একটি তামাক কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কোম্পানির কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তারা তামাক চাষিদের সব ধরনের সমস্যায় সহযোগিতা করে থাকেন। তারা সরাসরি কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন। কৃষকরা তামাক চাষে লাভবান হওয়ায় তারা কোম্পানির প্রচারনায় তামাক চাষে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

তামাক চাষ থেকে বিরত রাখতে মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শামিম আশরাফ। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'কৃষকরা তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন যে তারা সচেতনতামুলক প্রচারণায় কোনো নজর দিচ্ছেন না। আমরা তো কোন কৃষককে জোড় দিয়ে বলতে পারিনা যে তামাক চাষ করা যাবে না। আমরা শুধু তামাক চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে কৃষকদের সচেতন করছি।'

Comments

The Daily Star  | English

Explosions in Iran, US media reports Israeli strikes

Iran's state media reported explosions in central Isfahan Friday, as US media quoted officials saying Israel had carried out retaliatory strikes on its arch-rival

2h ago