‘আপনার সন্তান কাঁদলে আমার সন্তানের মুখে অন্ন জুটবে’

‘আপনার সন্তান কাঁদলে আমার সন্তানের মুখে অন্ন জুটবে। আপনার সন্তান কাঁদছে ১০ টাকার একটি খেলনার জন্য, আর আমার সন্তান কাঁদে একমুঠো অন্নের জন্য’- এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ফেরিওয়ালা নুর ইসলাম।
ট্রেনের কামরায় শিশু খেলনাসহ রকমারি জিনিসপত্র বিক্রি করছেন একজন ফেরিওয়ালা। ছবি: স্টার

'আপনার সন্তান কাঁদলে আমার সন্তানের মুখে অন্ন জুটবে। আপনার সন্তান কাঁদছে ১০ টাকার একটি খেলনার জন্য, আর আমার সন্তান কাঁদে একমুঠো অন্নের জন্য'- এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ফেরিওয়ালা নুর ইসলাম।

লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেলরুটে ট্রেনের কামরায় কামরায় হরেকরকম শিশু খেলনাসহ রকমারি জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রি করেন তিনি।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার চুড়িপট্টি গ্রামে বাড়ি নুর ইসলামের। গেল ২০ বছর ধরে তিনি ফেরি করে খেলনা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। বাড়িতে তার ৩ সন্তান ও স্ত্রী আছে।

নুর ইসলাম এক নারী যাত্রীকে বলছিলেন, 'আপনার সন্তান ১০ টাকার একটি খেলনার জন্য কাঁদছে। খেলনাটি পেলে সে চুপ হবে এবং আনন্দ পাবে। আপনি খেলনাটি কিনলে আমি ২-৩ টাকা লাভ করতে পারব। এই টাকা দিয়ে আমি সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারব। আপনি এই খেলনাটি না কিনলে হয়তো আমার সন্তানদের না খেয়ে থাকতে হবে।'

ফেরিওয়ালা নুর ইসলামের কথায় বিস্মিত হলেন ট্রেনের যাত্রী আফিদা বেগম। তিনি আদিতমারী স্টেশন থেকে পাটগ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী মতিউর রহমান ও দুই সন্তান আদনান ইসলাম (৮) ও আরিফুল ইসলাম (৫)।

'আমি ফেরিওয়ালার কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি। ভেবেছি অনেকক্ষণ। তার কাছ থেকে একটি নয়, চারটি খেলনা কিনেছি', বলেন আফিদা বেগম।

তিনি আরও বলেন, 'ফেরিওয়ালা সত্যিই বলেছেন, আমার সন্তান খেলনার জন্য কাঁদছিল আর খেলনা পেয়ে চুপ হয়ে যায়। আমাদের কাছে খেলনা বিক্রি করে যে লাভ হয়, তা দিয়েই ফেরিওয়ালারা তাদের সংসার চালান।'

ফেরিওয়ালা নুর ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টায় বের হয়ে রাত ১০টার পর বাড়িতে ফেরেন। বিভিন্ন ট্রেনে শিশু খেলনাসহ রকমারি জিনিসপত্র বিক্রি করেন তিনি।

'প্রতিদিন গড়ে ১২০০-১৩০০ টাকার খেলনা বিক্রি করে লাভ হয় ৩৫০-৪০০ টাকা। এতে কোনোরকমে সংসার চলে। কোনোদিন ট্রেন বন্ধ থাকলে সেদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে একবেলা উপোষ করে থাকতে হয়', বলেন তিনি।

নুর ইসলাম আরও বলেন, 'লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেলরুটে তার মতো আরও ২০-১৫ জন ফেরিওয়ালা আছেন। তারা প্রত্যেকেই ফেরি করে খেলনা বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালান।'

খেলনা দেখে শিশুরা কাঁদলে তাদের বিক্রি বেড়ে যায় বলেও জানান তিনি।

ট্রেনে অপর ফেরিওয়ালা মজিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, করোনা মহামারিতে লকডাউন দেওয়ায় ট্রেন বন্ধ ছিল, তাই তাদের ব্যবসাও বন্ধ ছিল। এসময় অনেক টাকা ঋণ হয়েছে। এসব ঋণ শোধ করতে তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। এখনও সংসারের অভাব পূরণ করা যাচ্ছে না।

'আমরা সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি আর রাতে যাই। অনেক সময় সন্তানদের সঙ্গে ঠিক মতো কথাও হয় না', বলেন তিনি।

মজিদুল ইসলাম আরও বলেন, 'আমাদের জীবন বিচিত্রময়। ট্রেনে যাত্রীদের অনেক ভালো ভালো গল্প শোনাই। কিন্তু আমাদের জীবনটা শুধু দুঃখের গল্পে ভরা।'

অপর ফেরিওয়ালা আজিজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'খেলনা বিক্রির জন্য যখন যাত্রীদের উদ্দেশ্যে নানারকম বক্তব্য দেই, তাতে তারা বিরক্ত হন, অসন্তুষ্ট হন। আমরা বুঝতে পারি কিন্তু নিরুপায়।'

'সংসার চালাতে, সন্তানদের পেটের জ্বালা মেটাতে আমাদের অনেক কটু কথা শুনতে হয়। এভাবেই চলছে আমাদের জীবন', বলেন তিনি।

আজিজুল আরও বলেন, 'ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের সন্তানদের কান্নাই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।'

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at launch in Sadarghat

No passengers were on board the Barishal-bound launch, says fire service official

32m ago