৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার নির্দেশ

আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটা সস্পূর্ণ এখতিয়ার বহির্ভূত

রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে ২ শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ ৫ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া, রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, ডিএনএ পরীক্ষা এবং আলামত থেকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই, ধর্ষণের অভিযোগ আনা হলেও এটিকে ধর্ষণ বলা যাবে না। তা ছাড়া, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। এ জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেছেন আদালত।
আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া (বাঁ দিক থেকে)। ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে ২ শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ ৫ আসামিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া, রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, ডিএনএ পরীক্ষা এবং আলামত থেকে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই, ধর্ষণের অভিযোগ আনা হলেও এটিকে ধর্ষণ বলা যাবে না। তা ছাড়া, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে অভিযোগপত্র জমা দিয়ে মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। এ জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনাও করেছেন আদালত।

৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অবহেলা করলে বা প্রভাবিত হলে সে ক্ষেত্রে আদালতের ভর্ৎসনার আইনগত ভিত্তি এবং আদালতের এখতিয়ারের বিষয়ে জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে- আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম, বেলার নির্বাহী পরিচালক ও আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে।

হাসনাত কাইয়ুম বলেন,'ধর্ষণের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা না নিতে আদালত পুলিশকে যে নির্দেশ দিয়েছেন সেটা সস্পূর্ণ এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয়। এটা বলতেও পারে না, বলার কোনো অর্থও নেই। এরা  ম্যাজিস্ট্রেসি চালানোর মতো কোনো যোগ্যতা রাখে না। উচিত হলো, তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া। আইনে পরিষ্কার নির্দেশ আছে, কখন কখন এদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া যায়। উনি যেটা করেছেন, তাতে ওনার ক্ষমতাটা কেড়ে নেওয়া উচিত।'

তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনার বিষয়ে বলেন, 'কোনো অসঙ্গতি পেলে অনেক সময় আদালত ভর্ৎসনা করতে পারেন। উনি যেভাবে ভর্ৎসনা করেছেন এবং তার পরে যে মন্তব্য করেছেন এই দুটো মিলিয়ে দেখলে আমাদের আইনি ভাষায় বলা যায়, উনি কোনো বিচারিক মন্তব্য করেননি। এগুলো হচ্ছে এক ধরনের আইন বহির্ভূত, বিচারকের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত। এ ধরনের ঘটনা ঘটা উচিত না। এ গুলোর বিষয়ে উচ্চতর আদালতের দৃষ্টি দেওয়া উচিত, উদ্যোগ নেওয়া দরকার।'

'অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ কখন মামলা নেবে তার কোনো লিমিট নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মামলা কত বছর পরে নেওয়া হয়েছে? অনেক মামলায় সময়সীমা আছে। সে ক্ষেত্রে সিভিল 'ল' থাকে, আপনি ১২ বছরের পরে অমুক কাজ করতে পারবেন না। ৩ বছরের পরে অমুক কাজ করতে পারবেন না। শিডিউলড করা থাকে। অপরাধ মামলার ক্ষেত্রে এ ধরনের সময়সীমা নেই। যে আদালত এটা বলেছেন, উনি তো কেউ না, উনি এটা বলতে পারেন না। রায়ে উনি কোনোভাবেই এই ধরনের মন্তব্য উল্লেখ্যই করতে পারেন না।'

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন,'ধরেন একজন ধর্ষক কোনো নারীকে ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা একটা জায়গায় আটকে রাখল। পরে সে বের হয়ে এলে আর মামলা দায়ের করতে পারবে না? পুলিশ আর সেই মামলা নেবে না? সাম্প্রতিক সময়ে নারীদের নিয়ে কতগুলো ঘটনা ঘটছে বা যা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে আমরা নারীর অধিকার নিয়ে, নারীর অবস্থান নিয়ে যে সামাজিক কাজ করেছি, সেই কাজের কারণে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে। তা না হলে, এ ধরনের রায় আসে কীভাবে।'

'অনেক বাসায় অনেক কাজের মেয়ে থাকে। বাসার মালিক তাদের ওপর এরকম অত্যাচার করে। কাজের মেয়ে তো সেই বাসা থেকে বেরই হতে পারে না। অনেকদিন পরে যখন সে বের হয়, তখন কী সেই মামলা দায়ের করতে পারবে না। বিচারককে কারা এই কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করল। তাহলে কী ধর্ষণকারীকে শুধু ৭২ ঘণ্টায় অপরাধী হিসেবে মনে করবে এই সমাজ? ৭২ ঘণ্টা পরে কি সে আর অপরাধী থাকবে না? একজন বিচারকের আসনে বসে, উনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটাকে বিচারের বিরুদ্ধে বক্তব্য বলে আমি মনে করি।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে সব নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। তারা কত বছর পরে বিচার পেয়েছিলে? ওই বিচারক যা বলেছেন, সেটা একটা অতি উৎসাহী বক্তব্য। এর সঙ্গে দেশের আইনের ও ন্যায় বিচারের কোনো সম্পর্ক নেই। একজন নারীর ধর্ষণের বিষয়টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার বক্তব্যের মাধ্যমে সেটা প্রতিফলিত হচ্ছে না। হয়তো এটার গভীরতা বোঝার অভাব আছে।'

এ ছাড়া, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করে মুক্তি দেওয়ার উপায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তিনি তো বিচারক। তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তাই তো সব কাজ করে ফেলতে পারত। বিচারক রাখা হয়েছে কেন?'

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, 'আদালত আসলে ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে এই নির্দেশনাগুলো দিয়েছেন। আদালতের আসলে কোনো এখতিয়ারই নেই এ ধরনের নিজেদের মনগড়া নির্দেশনা দেওয়ার। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, উনি আরও একটা অবজারভেশন দিয়েছেন, যেটা হলো মেডিকেল রিপোর্ট না থাকলে যেন ধর্ষণের মামলাগুলো গ্রহণ না করা হয়। এ ধরনের নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার তিনি রাখেন না। এটা সম্পূর্ণভাবে আইনের অপব্যাখ্যা। ধর্ষণের ক্ষেত্রে মেডিকেল এভিডেন্স হচ্ছে একটা এভিডেন্স। তবে, একমাত্র এভিডেন্স না। আরও অনেকগুলো পারিপার্শ্বিক এভিডেন্স থাকে। যেগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মামলার বিচার এগিয়ে চলে। কারও কোন দোষ বা ত্রুটির কথা বলছি না। এখানে কোর্ট যদি স্পষ্টতই এমন কিছু বিধিনিষেধ তৈরি করে, সেটা ভবিষ্যতে এ ধরনের ধর্ষণের ঘটনাগুলোর বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে এবং এটা একটা উদাহরণ তৈরি হয়ে যাবে। বিচারক মহোদয়ের যা করার কোনো এখতিয়ারই ছিল না। তিনি ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে, এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে আইনের পরিবর্তন করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আইন সংক্রান্ত কোনো বিষয়ের যদি রিভিউও করার ক্ষমতা থাকে সংবিধান অনুযায়ী সেটা কেবল সুপ্রিম কোর্টের আছে। নিম্ন আদালতের এই ধরনের কোনো এখতিয়ার নেই। তিনি আগ বাড়িয়ে কথা বলেছেন এবং এই কথার কোনো মূল্য নেই।'

দায়িত্বশীল পদে থেকে এই ধরণের নির্দেশের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'সাধারণ জনগণের কাছে এবং ভুক্তভোগীদের কাছে এর প্রভাব তো খুবই নেতিবাচক হবে। আমি মনে করি আপিলে আসলে অবশ্যই ওনার এই বক্তব্যগুলো প্রত্যাহার করা হবে এবং সুপ্রিম কোর্ট অবশ্যই যথাযথ নির্দেশনা দেবেন।'

'তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়েছেন বলে তাকে যে ভর্ৎসনা করা হয়েছে, সেটা তো কোনো ব্যবস্থা হলো না। এ বিষয়ে পরবর্তী তদন্তের জন্য নির্দেশ দিতে পারতেন। এ বিষয়ে তো বিচারকের কোনো বাধা ছিল না। যদি প্রসিকিউশন থেকে নাও বলে, উনি যদি বুঝতে পারেন যে এরকম একটা রিপোর্ট এসেছে, তাহলে পরবর্তী তদন্তের নির্দেশ দিতে পারতেন। পরবর্তীতে ১০ বার তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তো কোনো বাধা ছিল না।'

তদন্তকারীকে ভর্ৎসনার বিষয়ে আরও বলেন, 'সিআরপিসি অনুযায়ী উনি নিজের মতো করে অভিযোগ গঠন করতে পারতেন। সাক্ষী প্রডিউস করা সাক্ষীদের কে কী বলবে সেগুলোর প্রসিকিউশনের দায়িত্ব। ক্রিমিনাল কেইসে মনে রাখবেন, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিচার শেষ করার দায়িত্ব আসলে প্রসিকিউশনের। অর্থাৎ সরকারের বা রাষ্ট্রের। আদালত হচ্ছে তার কাছে আইন দ্বারা যে অর্পিত দায়িত্ব সেই অনুযায়ী বিচারের ভারটা উনার কাছে। বাকি সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের। পুলিশ প্রভাবিত হয়েছে  মানে, রাষ্ট্র এখানে প্রভাবিত একটা পক্ষ। ক্রিমিনাল কেসে অভিযোগকারীর পক্ষই হচ্ছে রাষ্ট্র। সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে গুরুতর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। দায়িত্ব অবহেলার কারণে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ছিল। কিংবা তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেও যাকে ধর্ষণ করা হলো সে তো কোন প্রতিকার পেল না।'

তিনি আরও বলেন, 'ধরেন কাউকে ধর্ষণ করার পর ৩ দিন আটকে রাখল। সে এসে যদি মামলা করে তাহলে মেডিকেল রিপোর্ট কোথায় পাবে? এই ধরনের নির্দেশ আসলে টিকবেই না। তা ছাড়া ক্ষমতা বহির্ভূত, এখতিয়ার বহির্ভূত এ ধরনের অতিরিক্ত কথাবার্তা বলা আমাদের আইনের, বিচার ব্যবস্থার জন্যও বড় ধরনের ক্ষতির কারণ।'       

Comments

The Daily Star  | English

Freedom declines, prosperity rises in Bangladesh

Bangladesh’s ranking of 141 out of 164 on the Freedom Index places it within the "mostly unfree" category

2h ago